Select Page

জালালদের পিতারা, পিতাদের জালালরা

জালালদের পিতারা, পিতাদের জালালরা

Jalaler-Golpo-2শুনেছি ‘জালালের গল্প’ ছবির নাম শুরুতে রাখা হয়েছিলো ‘জালালের পিতাগণ’। ছবিটা দেখে অনেকেই এমন মত প্রকাশ করেছেন যে আগের নামটাই যথাযথ ছিলো। এ প্রসঙ্গে আমার কোন ভাবনা তৈরি হয়নি। অন্য অনেক প্রসঙ্গেই হয়েছে। সেই ভাবনা প্রকাশ করার তাগিদ থেকেই এই লেখা।

ছবিটা দেখার আগেই বেশ কিছু রিভিউ পড়েছিলাম। পড়েছিলাম পরিচালকের সাক্ষাৎকারও। জেনেছিলাম তিনি সচেতনভাবেই কোন গান রাখেননি ফিল্মে। দেখাতে চেয়েছেন গান ছাড়াও ফিল্ম হয়। বলা বাহুল্য তিনি তা দেখাতে পেরেছেন। অন্তত একটা গান থাকলেই যে ছবির প্রচারণা অনেক সহজ হতো তা জেনেও স্পর্ধার সঙ্গে তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন পরিচালক। সফল তিনি।

জালালের গল্প কী নিয়ে?কাকে নিয়ে? এই গল্পের নায়ক কে? স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়-কেন? জালাল নামের একটা ছেলে! আমার কিন্তু তা মনে হয়নি। নায়কই যদি হবে তাহলে তার উপস্থিতি এত মৃদু কেন? সংলাপ এত কম কেন? কেনইবা তার ওপর আরোপ করা হয়নি নায়কোচিত মহত্ব?

এই গল্প দেখতে দেখতে মনে পড়ে মহাভারতের কর্ণের কথা, রবিঠাকুরের ছোটগল্প পুত্রযজ্ঞের কথা। পিতৃত্ব-ক্ষমতা-পৌরুষ এই তিনের পারস্পরিক যোগাযোগ নিয়ে ভাবায় এই ছবি। সন্তানমাত্রই যে কাম্য নয়, রয়েছে বৈধ- অবৈধ বিভাজন সে কথা মনে করিয়ে দেয় এই ছবি। মনে করিয়ে দেয় সন্তানের ওনারশিপে নারীর স্থান কত নগণ্য!

পেটে ধরা ছাড়া সন্তানের বিষয়ে নারীর যে আর কোন ভুমিকাই নেই,এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কতখানি সীমিত, নিয়ন্ত্রিত- তাও মনে পড়ে। মনে পড়ে মানুষের ইতিহাসে পুরুষানুক্রমের প্রবল প্রতাপের কথা। পুরুষের বৈধ সন্তানের উদগ্র আকাঙ্খার বলি হওয়া নারীর ঐতিহাসিক মহাপরাজয়ের কথাও।

ক্ষমতা-পৌরুষ-পিতৃত্ব – এই তিনের চক্রে আটকে পড়ে জালালের পিতারা। ক্রমাগত তাদের ওন করা এবং ডিজওন করার মধ্যে প্রবাহিত হয় জালালের জীবন অথবা জালালদের জীবন।

এই ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই একটি বিষয়ে বলতে হবে। তা হচ্ছে ছবি তোলার মুন্সিয়ানা, যাকে বলে সিনেমাটোগ্রাফি। ঠিক যেন জীবনানন্দের রুপসী বাংলা। গ্রামের দৃশ্য,ঋতু পরিবর্তন,ছোট ছোট টুকরো টুকরো সৌন্দর্য দিয়ে জোড়া দেওয়া পুরোটা সিনেমা। কবিগুরুর বর্ণনার মতন- ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি। অন্তত দেখতে। দেখে বোঝার উপায় নেই এই গ্রামগুলিতেই রয়েছে কত কুসংস্কার, রেষারেষী, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, নারী নিপীড়ন।

ট্রেনের জানালা থেকে দেখা ছবির মত সুন্দর গ্রামের কদর্য দিক রয়েছে গল্পেই। পানিপড়া,কুফা,আটকুড়া,জ্বিন,কবিরাজ, ঝাড়ফুঁকের নামে ধর্ষণ,ভিলেজ পলিটিক্স,হত্যা,গুম, নারী অপহরণ,গর্ভপাত এবং অনাকাঙ্খিত শিশু পানিতে বিসর্জন। শেষোক্তটিই এই গল্পের প্লটলাইন। গল্প শুরু এক ‘ড্যাগ’ দিয়ে,শেষ আরেক ‘ড্যাগ’ দিয়ে। জালালের গল্প এভাবেই হয়ে ওঠে মহাকাব্যিক। হয়ে ওঠে অর্থবহ।

ছবিটিতে প্রত্যেকটি নারী চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনজন অভিনেত্রীই অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দেখিয়েছেন। নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, অসহায়ত্ব, নিষ্ফল ক্রোধ, মমতা, মাতৃত্ব – প্রতিটি অনুভূতি তারা পর্দায় নিয়ে এসেছেন, দর্শকের মনকে স্পর্শ করেছে ঐ নারীদের হাহাকার। পুত্রের আকাঙ্খায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য জমিদারের লোকেরা যখন জালালকে বস্তায় ভরে ভেলায় করে ফেলে দিতে উদ্যত হয়, সেখানে জমিদারের স্ত্রীর দৌড়ে এসে চিৎকার করা, প্রতিবাদ করা, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য ভয়াবহ ছিলো। এই দৃশ্যে চোখের পানি ধরে রাখার মতো পাষাণ হৃদয় কেউ আছে কিনা আমি জানি না।

Jalaler Golpo (1)এই গল্পের অন্যতম প্রধান দিক নিষ্ঠুরতা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ। মানুষ যেন মানুষ নয়, পথের কুকুর।  কুকুর আর ডিজওনড মানবসন্তান একাকার হয়ে গেছে বেশ কিছু দৃশ্যে। গল্পের বিষাদটুকু ছড়িয়ে গেছে পর্দা জুড়ে। রাস্তার নেড়িকুত্তা যাকে কেউ ওন করে না, যাকে সবাই লাথি দেয়, সে যেন জালালের মতো। অথবা জালালই তার মতো। কেউ চাইলে আদর করে ঘরে নিয়ে পুষতেই পারে। ভালো না লাগলে লাথি মেরে বের করেও দিতে পারে। কারো কিছু এসে যায় না।

পরিচালকের প্রথম ছবি। সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও তাই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।  দর্শক হিসেবে প্রতিক্রিয়া যেহেতু লিখছি, সৎভাবেই লেখা উচিত বলে মনে করছি। সেখান থেকে কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ জানাতে চাই।

ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর অনেকটা উচ্চকিত ছিলো, অ্যামবিয়েন্স ততটা মনযোগ পায়নি। দুঃখের ছবি বলেই হয়তো হাস্যরস তৈরী করে দর্শককে রিলিফ দিতে চেয়েছেন পরিচালক। কিছু কিছু হাস্যরস চমৎকার হলেও কিছু ক্ষেত্রে বাহুল্য মনে হয়েছে।

যে নারীর কাছে প্রথমবারের মতো মাতৃস্নেহ পায় জালাল, যে গর্ভিণী নারী প্রথমে অস্বীকৃতি জানিয়েও পরে মায়ায় পড়ে বুকে তুলে নেয় নিষ্পাপ শিশুটিকে, রাত জেগে বুকে সেঁক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চায় ক্রমাগত পানিতে ভিজে অসুস্থ হয়ে পড়া অসহায় জালালকে, স্বামীর অন্যায় ব্যবসার প্রতিবাদ জানায়, ঠিকভাবে বিকশিত এই চরিত্রটির সঙ্গে বড় রকমের অবিচার করা হয়েছে। জালালকে দ্বিতীয়বার ভাসিয়ে দেওয়ার সময় এই মায়ের যে গভীর প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, পর্দায় তার আভাসটুকুও না আসা দর্শকের জন্য হতাশার। বড় একটা ফাঁক রয়ে গেছে এইখানে।

প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মনযোগ পেয়েছে কবিরাজের চরিত্র। অভিনয় মন্দ ছিল না কবিরাজের। তথাপি চরিত্রটি বিকশিত হতে পারেনি। বিশেষত জমিদার আর তার স্ত্রীর সামনে কবিরাজের উপস্থিতি প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি। অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে তার পোশাকের আরোপিত সজ্জা চোখকে আকর্ষন করেছে।  অথচ পুরো ছবিতেই কস্টিউমের কাজ যারপরনাই ভালো। কোথাও কোন চরিত্রের পোশাক বা মেকআপ অস্বাভাবিক মনে হয়নি, কবিরাজেরটি ছাড়া। তবে শিলার টিশার্টের লেখাটুকু ক্লোজ করে দেখানোর কারণ ধরতে পারিনি। অস্বস্তিকর ঠেকেছে।

কিন্তু এই কয়টি দুর্বলতা পুরো সিনেমাটিকে দুর্বল করে ফেলতে পারেনি। তার কারণ সম্ভবত ট্রিটমেন্ট। পুরো ছবিতেই ছিলো পরিচালকের একটা নিজস্ব স্টাইল। ভালো এডিটিং ছিল বলে কবিরাজের কর্মকাণ্ড লেংথি হয়েও বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারেনি। সংলাপের সময় ক্লোজ করে মুখের ছবি দেখানোর বদলে অ্যাকটিভিটিজ দেখানোকে সিনেমার পরিভাষায় কী বলে আমি ঠিক জানি না। খুব সম্ভবত অফভয়েস (তাসমিয়াহ আফরিন মৌ এর লেখা রিভিউ থেকেও তা-ই মনে হলো)। এই ট্রিটমেন্টটা ভালো লাগার মতো।

আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়। জালালের চরিত্রে ভয়ারিস্টিক বিহেভিয়ার পৌনঃপুনিকভাবে দেখা গেছে। বলা ভালো এই একটি বৈশিষ্ট্যই জালালকে বিশেষায়িত করেছে। ভয়ারিজমের এই ব্যবহার যে সার্থক হয়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শিশু ও তরুণ – দুই জালালই চমৎকার এক্সপ্রেশনে ভয়ারিস্টিক সিচুয়েশনগুলো বাঙ্ময় করেছেন।

সিনেমার তাত্ত্বিকরা বলেন, সিনেমা মাধ্যমটি নিজেই দর্শককে ভয়ার করে তোলে। অথবা মানুষের মৌলিক প্রবণতার ভয়ারিস্টিক দিকটি উস্কে দিলে তবেই সে পায় সিনেমা দেখার আনন্দ। গল্প জুড়ে জালালের চোখ দিয়ে নিষ্ঠুর পারিপার্শ্বিকতা আর ইতিহাসের পৌনঃপুনিকতা দেখতে পাওয়া একভাবে দর্শককে জালালের সঙ্গে একাত্ম করে।

সিনেমার শুরু যেমন আগ্রহ উদ্দীপক, শেষটাও তেমন তৃপ্তিদায়ক। অযথা দৃশ্যটিকে টেনে লম্বা করা হয়নি। দর্শককে ইমোশনের পীড়া দেওয়া হয়নি। কেননা দর্শক ততক্ষণে জেনে গিয়েছে কী হতে যাচ্ছে। এমন ঠিকঠাক ক্লোজার একটি ছবিকে ভালো বলতে বাধ্য করে। বিষাদময় একটি সিনেমা দেখার তৃপ্তি নিয়ে বের হন দর্শক আর ভাবেন- আবার কবে এমন একটা ছবি দেখা যাবে!

পরিচালক আবু শাহেদ ইমনের প্রতি এই প্রশ্ন রইলো। সঙ্গে তার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। আরও অনেক ছবি দেখতে চাই তার কাছ থেকে।


মন্তব্য করুন