Select Page

জয়া আহসান: এক পূর্ণাঙ্গ অভিনেত্রী

জয়া আহসান: এক পূর্ণাঙ্গ অভিনেত্রী

বাংলাদেশের শোবিজে সংগ্রামটা সম্ভবত একটু বেশিই করতে হয়। এখানে আপনাকে তারকা হতে গেলে অনেককিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনার ক্যারিয়ারের শুরুটা যেমন হবে মধ্যপথটা বা শেষের পথটা তেমন হবে না। কোনো কোনো তারকা নিজগুণে ক্যারিয়ার রঙিন করে তোলেন। জয়া আহসান তাদেরই একজন। বাংলাদেশে যে কয়েকজন অভিনয়শিল্পী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন তাদের মধ্যে গর্বিত নাম।

জ্ঞান হবার পর থেকে যাদের অভিনয় দেখে বড় হলাম জয়া তাদেরই একজন। অর্ণবের ‘সে যে বসে আছে একা একা’ গানটি প্রথমবার দেখে তাহসানের সাথে তার রোমান্টিক মিউজিক ভিডিও খুব ভালো লেগেছিল। তাহসান সাইকেল চালিয়ে রোজ জয়ার বাড়ির সামনে আসত আর জয়া ঝুলবারান্দা থেকে দেখত।

ভালোই যাচ্ছিল দিনক্ষণ কিন্তু ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা তাহসান শেষমেষ হৃদয়ে দাগটা পেল ইন্তেখাব দিনারের জন্য। দিনারের সাথে জয়ার পাশাপাশি দাঁড়ানো বা হাতে হাত রাখা দেখে বুঝতে দেরি হল না যে সে মরীচিকার পিছে ছুটছে। জয়াকে তখন খুব সুইট লাগত। কিংবা বলা যেতে পারে ফয়সালের সাথে তার স্টিল ইমেজগুলো, বিজ্ঞাপনে তাদের রসায়নে অনবদ্য। ক্যালেন্ডার বা কোকাকোলা-র বিজ্ঞাপনের দিনগুলোতে তার ইনোসেন্ট পর্দা উপস্থিতি ভোলা যাবে না।

জন্ম ১ জুলাই। ঢাকায়। বাবা এ এস মাসুদ ও মা রেহানা মাসুদ। দৈনিক ভোরের কাগজে একসময় যোগ দিয়েছিলেন। পরে মডেলিং-এ ফিরে আসেন। তারপর নাটক ও চলচ্চিত্রে থিতু হন।

জয়া তারকার প্ল্যাটফর্মে ধীরে ধীরে নিজেকে শাণিত করেছিল। আজকের অনেক তারকাই তাকে যে আইডল ভাবে তার পেছনে দীর্ঘ একটা সংগ্রাম লুকিয়ে আছে। জয়াই একমাত্র তারকা যে লম্বা সময় ধরে দেশে-বিদেশে নিজের প্রতিভা ছড়িয়েছে। ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা-দের পরে দেশের শোবিজ অঙ্গনে অনেকের থেকে এগিয়ে থাকা একজন।

নাটক/টেলিফিল্মের ভুবনে জয়ার অনবদ্য সব কাজ আছে। যেমন – সংশয়, এনেছি সূর্যের হাসি, চৈতা পাগল, আমাদের ছোট নদী, কফি হাউজ, দরজার ওপাশে, নো ম্যানস ল্যান্ড, লাবণ্যপ্রভা, মানুষ বদল, লীলাবতী, ঊনসত্তর, সম্পর্কের গল্প, আমাদের গল্প, ফেরার পথ নেই থাকে না কোনোকালে, তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে, বিকল পাখির গান, চেরী ফুলের নামে নাম, এবং অতঃপর, এবং বনলতা সেন, কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়, ঘুম, হ্যালোউইন, হরতনের বিবি, কুহক, মায়া অথবা মৃত্যুর গল্প, নির্জন স্বাক্ষর, নক্ষত্র ঘাস অথবা চন্দ্রমল্লিকার রাত, অবাক সন্দেশ, অফবিট, শহরতলীর আলো, তারপর পারুলের দিন, মায়েশা, ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই।

ধারাবাহিক নাটক ‘এনেছি সূর্যের হাসি’ জয়াকে দারুণ জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। তার চরিত্রের নাম ছিল আয়েশা। তিনি নাটকে অভিনয়ের সময় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছেন ‘আয়েশা’ নামে অনেকে মেয়ের নাম রেখেছেন।

‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’ টেলিফিল্মটি অমর হয়ে থাকবে। নির্মাতা অনিমেষ আইচের সাথে জুটি বেঁধে জয়ার পতিতা চরিত্রের টাফ জবটি এত ন্যাচারালি অনবদ্য হয়ে ওঠে যে সে টেলিফিল্ম বারবার দেখলেও মন ভরে না। বাঙালি সমাজে স্বামী যত খারাপই হোক তার জন্য মেয়েরা ভালোবাসা নিয়েই বসে থাকে। তাইতো শ্মশানে নন্দর লাশ সৎকারের সময় আঙুরলতা ( জয়া) ডুকরে কেঁদে ওঠে। কী অসাধারণ তার অভিনয়! এই টেলিফিল্মে অনবদ্য অভিনয় দেখেই টলিউডে এ সময়ের মৌলিক গল্পের সেরা পরিচালক সৃজিত মুখার্জী প্রথমবার জয়াকে তার ছবির জন্য ভাবেন। আরো বলতে পারি ‘ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই’ টেলিফিল্মে ঐ সিকোয়েন্সের কথা যেখানে দীর্ঘদিন পরে প্রবাসী বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ যিনি তাকে ছোটবেলায় কুড়িয়ে পেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নেন। পার্কে সেই বাবার সাথে দেখা করতে আসে স্বামী, সন্তানসহ। দেখা হলেই ‘বাবা’ বলে যে ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে বাবাকে একেবারে জীবন্ত অভিনয়।

‘বিকল পাখির গান’ উল্লেখযোগ্য কাজ। ‘মায়েশা’ ফ্যান্টাসি, হরর, রিয়েলিটি সহযোগে ব্যতিক্রমী নাটক ছিল। ফয়সালের সাথে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর জনপ্রিয় নাটক ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ছিলেন। জীবনানন্দ দাশের গল্প ‘কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়’ থেকে নির্মিত নাটকে অসাধারণ অভিনয় তার। সমকালীন সমাজব্যবস্থার উপর ‘ফেরার পথ নেই থাকে না কোনোকালে’ অনবদ্য ছিল।

নাটক, টেলিফিল্মের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া জয়া চলচ্চিত্রে এসে নিজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মেধা ও প্রতিভা দেখিয়েছেন। এই প্ল্যাটফর্মে এসেই তিনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও কাজ করেন। ছবিগুলো যথাক্রমে- ব্যাচেলর, ডুবসাঁতার, ফিরে এসো বেহুলা, গেরিলা, চোরাবালি, আবর্ত, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী-২, জিরো ডিগ্রী, রাজকাহিনি, ঈগলের চোখ, ভালোবাসার শহর, বিসর্জন, খাঁচা, পুত্র।

আপকামিং – দেবী, বিউটি সার্কাস, এক যে ছিল রাজা, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম, চৌরঙ্গী। ‘ডুবসাঁতার’-এ জয়া ছিলেন চমকে দেবার মতো। অসাধারণ ছবি। নিজের গণ্ডির মধ্যে পরিস্থিতির ভেতর পড়ে প্রেম, মৃত্যু নিয়ে নির্মিত ছবি। ছবির প্রথম দৃশ্যেই জয়া ছিল অসাধারণ। ‘তোমার খোলা হাওয়া’ এ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি তারই গাওয়া ছিল। ‘ব্যাচেলর’ ছবিতে হাসান মাসুদ জয়ার প্রেমে পড়ে। মজার ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘গেরিলা’-তে শেষ সিকোয়েন্সে শতাব্দী ওয়াদুদের অত্যাচারের মুখে গ্রেনেড হাতে জয়ার ক্লোজ শটের এক্সপ্রেশনটি বলে দেয় সে জাত অভিনেত্রী। ‘জিরো ডিগ্রী’-তে তার দুর্দান্ত অভিনয় নতুন কিছুর স্বাদ দিয়েছে।কলকাতায় নিজের প্রতিভার প্রমাণ রাখতে ‘আবর্ত, রাজকাহিনি’ জয়ার নতুন সংযোজন ছিল। এক্সপেরিমেন্টাল কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ছবিতেও যে জয়া কাজ করেছেন। ‘চোরাবালি, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী-২।’ টলিউডে এখন ব্যস্ত অভিনেত্রী জয়া। কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে দেশের চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের মধ্যে উদাহরণ হয়েছেন বিরলভাবে।

পুরস্কারের ঝুলি অনেক জয়ার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার – গেরিলা (২০১১)
চোরাবালি (২০১২)
জিরো ডিগ্রী (২০১৫)

মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার :
দর্শক জরিপে – ‘এনেছি সূর্যের হাসি’ (২০০৫), শঙ্খবাস (২০০৭), তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে (২০০৯), চৈতা পাগল (২০১০)।

সমালোচক জরিপে – ‘হাটকুড়া'(২০০৬), স্ক্রিপ্ট রাইটার (২০০৭), বিকল পাখির গান (২০০৯), আমাদের গল্প (২০১২)।

চলচ্চিত্র – দর্শক জরিপে সেরা অভিনেত্রী ‘গেরিলা’ (২০১১), ‘চোরাবালি’ (২০১২), পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী (২০১৩)

সমালোচক জরিপে সেরা অভিনেত্রী ‘গেরিলা’ (২০১১), ‘জিরো ডিগ্রী’ (২০১৫)।

বাচসাস পুরস্কার সেরা অভিনেত্রী ‘গেরিলা’ (২০১১)

ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রী – আবর্ত (২০১৩), ঈগলের চোখ (২০১৭), বিসর্জন (২০১৮)

জি সিনে অ্যাওয়ার্ড – বিসর্জন (২০১৮)

‘বিসর্জন’ ছবিটি ভারতে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে।

এছাড়া দেশের মধ্যে চ্যানেল আই পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড, সিজেএফবি অ্যাওয়ার্ড, চারুনিড়ম পুরস্কার ইত্যাদি পেয়েছেন।

এত এত সাফল্য তার ক্যারিয়ারে যে সব বলতে গেলে ঢের সময়ের দরকার। বাঙালি তারপরেও সমালোচনার রাজা।সেটা ‘সমালোচনা’ ‘অ-সমালোচনা’-র কাতারেও হরহামেশাই পড়ে। কিন্তু দিনশেষে জয়ার বড় ক্যারিয়ারের সাফল্য এবং এখনো চলতে থাকা ক্যারিয়ার বলে তিনি এত জলদি থামবেন না। অনেকটা পথ বাকি এখনো। হিশেবনিকেশে যা আসে একজন জয়া আহসান বাংলাদেশের সেই আর্টিস্ট যার কাজই হল অভিনয়ে যে কোনো ক্যারেক্টারে অ্যাটাচমেন্ট করানোর মতো বিরল একজন। তার ক্যারিয়ারের কাজগুলোর দিকে তাকান, জবাবটা পেয়ে যাবেন। অবশ্যই তার জন্য অভিনয়ের দর্শকক্ষুধা থাকতে হবে।

জয়া আহসান তার স্টারডম ও অভিনয় দিয়েই স্ট্রাগল করা ফুল প্যাকেজ তারকা।তার অনাগত সাফল্যের দিকে তাকিয়ে থাকাই হোক আমাদের কাজ। জয়ার জয় হোক।

শুভ জন্মদিন…


মন্তব্য করুন