Select Page

ঢাকা অ্যাটাক : লাশের পকেটে হাসি

ঢাকা  অ্যাটাক : লাশের পকেটে হাসি

চোখ ধাঁধানো ট্রেইলার, সাথে একঝাঁক নতুন মুখ নিয়ে কেমন হবে ছবিটি তা নিয়ে দর্শক মহলে আগ্রহের কমতি ছিলো না। গুলশান হামলার পর সিনেমাটি সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সে থেকে শুরু হয় অপেক্ষা কবে মুক্তি পাবে ‘ঢাকা অ্যাটাক’।

অবশেষে ৬ অক্টোবর মুক্তি পেল বহুল প্রতিক্ষিত সিনেমাটি। যৌথ প্রযোজনার নামে দেউলিয়া প্রযোজনার যে চর্চা ইন্ডাস্ট্রিতে চলছে ‘আয়নাবাজি’র পরে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ তার বিরুদ্ধে একটি কড়া জবাব। এ জন্যে প্রথমে ধন্যবাদ পাবার উপযুক্ত প্রযোজক মুহাম্মদ আলী হায়দার কারণ আরিফিন শুভ আর এবিএম সুমনের মত উদীয়মান অভিনেতাদের উপর সাহস করে সাড়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করার জন্য। এমন কিছু সাহসী বিনিয়োগকারীর বড় প্রয়োজন এই রুগ্ন ইন্ডাস্ট্রিতে। তারপর ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার দীপঙ্কর দীপন, দেশের হলমুখী দর্শকদের উপর আস্থা রেখে এমন নান্দনিক একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য।

এবার ছবির কাহিনী বিন্যাসে আসা যাক। সিনেমার শুরুতেই প্রচন্ড সাসপেন্স দিয়ে শুরু হয় আর তা টেনে টেনে শেষ অবধি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো সিনেমা জুড়ে একটিবারের জন্যেও চোখের পাতা ফেলা যায়নি। তবে এই সাসপেন্সে একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ছিলো সেটা হচ্ছে কাহিনী বুঝা যাচ্ছিলো কি হতে যাচ্ছে। প্রথমে অপরাধীকে খুব শক্তিমান করে উপস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের আবার ফেলে দেয়া হয়েছে। সিনেমায় গতি যা এসেছে তার পুরোটাই সাউন্ড আর ক্যামেরার দক্ষতায়।

কাহিনী খুব একটা টান টান উত্তেজনাপূর্ণ ছিলো না। কাহিনী সরল রৈখিক গতিতে এগিয়ে গিয়েছে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কাহিনীতে গতির পরিমিতি ছিলো না। প্রথম অংশে এটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। গতি পড়তেই চাচ্ছিলো না। সিনেমার স্পেসটাকে সুন্দর করে ব্যাবহার করে পরিমিত গতি আবার স্থিতি আবার গতি আবার স্থিতি এভাবে আস্তে আস্তে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে আগানোর প্রবণতা ছিলো না।

এবার চরিত্রায়নের ব্যাপারে আসা যাক। প্রত্যেকটা চরিত্রই তাদের জায়গায় যথাপোযুক্ত ছিলো শুধু মাহিয়া মাহির চৈতি চরিত্রটা ছাড়া। এই চরিত্রটা গল্প থেকে ছেটে ফেলে দিলে গল্পের গতি ও প্রকৃতির তেমন কোনো ক্ষতিই হত না। যদিও সিনেমার একটা বড় অংশ জুড়ে এই চরিত্রটার অবস্থান তবে এই চরিত্রটা নিয়ে খেলার অনেক সুযোগ ছিলো।

সিনেমায় হঠাৎ মালয়শিয়া চলে যাওয়া সেখানে শিপন মিত্রের আবির্ভাব আবার হারিয়ে যাওয়া– এই অংশটাও খুব একটা শক্ত চরিত্রায়ন হয়নি। এবিএম সুমনের আসফাক চরিত্রটা অনবদ্য ছিলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই চরিত্রটা আবিদ রহমান মানে শুভর চরিত্রটাকে ও ছাপিয়ে গেছে।

তাসকিন রহমানের জিসান চরিত্রটা সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। দেখে বুঝা মুশকিল ছিলো যে এটা তার বড় পর্দায় অভিষেক। একাই কাঁপিয়েছেন পুরো সিনেমা। শুরুর দিকে নকল বোমা পেতে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার উপস্থাপনটাও অনেক নান্দনিক হয়েছে।

শতাব্দী ওয়াদুদ এর চরিত্রটা নিয়ে খেলার সুযোগ ছিলো কিন্তু খুবই সরল উপস্থাপন হয়েছে। পুরো সিনেমাটাতেই আবেগের জায়গায় একটু ঘাটতি ছিলো। ঘাটতি ছিলো হাস্যরসেরও।

সংলাপগুলো ‘আয়নাবাজি’র মতো এতটা টান টান ছিলো না। একটু আলগা আলগা লাগছিলো। মালয়েশিয়ান পুলিশের যে অংশটা দেখানো হয়েছে সেখানে সংলাপের সাথে অভিনয় একদমই যাচ্ছিলো না। মাহির সংলাপ আর অভিনয়ে যথেষ্ঠ ন্যাকামো ছিলো। শুভর কণ্ঠটা তার চরিত্রের সাথে যাচ্ছিলো না।

সিনেমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিলো ক্যামেরা, লাইটিং আর আবহ সংগীত। সোয়াটের অভিযানের সময় খুব ক্লোজ থেকে এবিএম সুমনের কিছু ওয়াইড এঙ্গেল শট নেয়া হয়েছে যা খুবই নান্দনিক ছিলো। কাট টু কাট শট গুলোর সাথে উদ্দাম আবহ সঙ্গীত খুবই গতি আনতে সক্ষম হয়েছিলো। আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ডার্ক ব্যাক লাইটিং, জিসানের আস্তানার লাইটিং, টিকাটুলির মোড়ে একটা সিনেমা হল রয়েছে এই গানটার লাইটিং – সব মিলিয়ে লাইটিং অনবদ্য ছিলো।

টিকাটুলির মোড়ে আইটেম গানটা প্লে করার সময় দেখা যায় ক্যামেরা পার্টির ভিতরে থাকার সময় গানটা যে ভলিউমে বাজছে শুভরা পার্টি থেকে আসামি খোঁজার জন্য বাইরে আসলেও গানটা একই ভলিউমে বাজতে থাকে অথচ পার্টি রুমের বাইরে গানটা একটু কম ভলিউমে বাজালে আরো বেশি নান্দনিক হত। সিনেমার কাহিনীটাই কিছু বার্ডস আই ভিঊ শট দাবি করে কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে কোনো বার্ডস আই ভিউ শট ছিলো না। ক্রেন দিয়ে কয়েটা এরিয়াল শট নেয়া হয়েছে তাতে কিছুটা কাজ হয়েছে। তবে ড্রোনের শট আরো বাড়ানো উচিত ছিলো।

পুরো সিনেমার আর একটা নান্দনিক দিক ছিলো প্রপস ও কস্টিউম। বিশেষ করে অস্ত্রগুলো রিয়েল হওয়ার কারণে দৃশ্যায়ন অদ্ভুত দ্যোতনা পায়। তবে আরিফিন শুভ পুরো সিনেমা জুড়ে একটা রিভলবার দিয়ে গোলাগুলি করে যেখানে পুরো টিম সবার হাতেই ছিলো ভারি অস্ত্র – এই কনসেপ্টাটা খুবই বেখাপ্পা লাগে। এবিএম সুমন যেখানে সবগুলো অপারেশনেই হেলমেড ব্যাবহার করেছেন হাতে ছিলো ভারী অস্ত্র সেখানে একই অপারেশনে আরিফিন শুভ ভারী অস্ত্র নেয়া তো দূরের কথা হেলমেড পরারই প্রয়োজন বোধ করলো না! শুভ ও মাহিয়া মাহি দুজনের চুলের কাটিংয়েই কন্টিনিউটির অভাব ছিলো। মাহির চুল মাঝে মাঝে স্ট্রেইট আবার মাঝে মাঝে কার্লি হয়ে যাচ্ছিল; শুভর চুল মাঝে মাঝে পিছনে বড় আবার ছোট হয়ে যাচ্ছিলো যা খুবই যার্ক লাগছিলো।

এত কিছুর পরেও ‘আয়নাবাজি’র পরে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ আবার প্রমান করলো যে এপার বাংলায়ও ভালো সিনেমা হয়; ভালো সিনেমায় ইনভেস্ট করলে টাকা উঠে আসে; প্রেম ভালোবাসা আর যৌণ সুড়সুড়িমূলক গল্প ছাড়াও ব্যাবসা করা যায়; হলমুখী দর্শকের সংখ্যা কম না দরকার শুধু ভালো সিনেমার। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ এমন একটি সিনেমা যা বহুদিন পরে রিকসাওয়ালা ও ভদ্রলোক এ দুই শ্রেণির মানুষকেই সিনেমা হলে টানতে পেরেছে ও আনন্দ দিতে পেরেছে। দেশি সিনেমার এমন সার্বজনীন রূপ অনেকদিন দেখা যায় না।

‘ঢাকা অ্যাটাক’র অন্যতম আকর্ষণীয় সংলাপটি ছিলো ‘লাশের পকেটে হাসি’। এ যেন পুরো ইন্ডাস্ট্রিরই চিত্র – যৌথ প্রযোজনার রাঘব বোয়ালদের তোপে যা মৃতপ্রায়। ‌‘ঢাকা অ্যাটাক’ সে মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রির লাশের পকেটে হাসির মতো নেমে আসুক।


মন্তব্য করুন