Select Page

দীপংকর দীপনের রিভিউ : আলতা বানু

দীপংকর দীপনের রিভিউ : আলতা বানু

১. আমার বিশ্বাস ছিল অরুণ দা ভালো করবেন, কিন্তু এতটা ভালো করবেন আর এতটা আধুনিক সিনেমা বানাবেন, আমি সত্যিই আশা করিনি। কারণ আমি জানতাম কতটা কম বাজেট, কতটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাকে কাজটা করতে হয়েছে। স্যালুট অরুণ দা।

২. শহরের সাথে খুব পাল্লা দিয়ে বদলাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামগুলো। পাল্টাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, হচ্ছে নতুন ও পুরনো বিশ্বাসগুলোর মিশ্রণ। তাই আজকের সিনেমায় বদলে যেতেই হবে চরিত্র, চরিত্রের ঘটনা এবং পরিণতিগুলো। সেই পরিবর্তনের হাওয়াটা অনুভব করা যায় জালালের গল্পে, মাটির প্রজার দেশে আর আলতা বানুতে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের নতুন গল্প।

৩. আলতা বানু আমার কাছে আজকের দিনের শেষের কবিতা। শেষের কবিতার মূল উপজীব্য ছিল যুগসন্ধিক্ষণ, সেটার একটা ২০১৮ সালের রূপ আছে আলতা বানুতে। কুসংস্কার, সাইবার ক্রাইম, নারীবাদ, ওমেন ট্রাফিকিং, ছাত্রনেতা, ভালো-খারাপ দু ধরনের পুলিশিং, গার্মেন্টস, সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্ট অন ওয়ার্কিং এরিয়া, ভায়োলেন্ট দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ— তাও আবার ভিকটিম নারীর, দুটো ভিন্ন চেহারার দুটি আধুনিক নারী, জঙ্গিবাদের ইঙ্গিত, প্রতারণা, অব্যক্ত প্রেম— সমসাময়িক অনেক কিছু এসেছে আলতা বানুতে। কিন্তু সবচেয়ে অভাবনীয় বিষয় হচ্ছে এত সব কিছুতে ফোকাস সরেনি— বড়বোনের ছোটবোনকে খুঁজে বেড়ানোর জার্নিটার পরতে পরতে মিশে গেছে কনটেমপরারি কনটেন্টগুলো।

৪. দর্শককে ধরে রাখার ক্ষমতা। আমার দুপুর ১টায় একটা জরুরি কাজ ছিল, যেখানে ছবি শেষ হতে হতে পৌনে দুটা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে যাব, পারিনি, অরুণ দা বসিয়ে রেখেছেন, কাজের বারোটা বাজিয়েছেন— তাতেও অনাবিল সুখ একটা দেশী চলচ্চিত্রই তো আটকে রেখেছে। বাংলাদেশের এক-একটা ভালো সিনেমা আমার বুকের ছাতি আরেক ধাপ বড় করে দেয়।

৫. অভিনয়। মমর অভিনয়ের ক্ষমতার সাথে আমি পরিচিত। ছুঁয়ে দিল মনে তার ছিটে-ফোটাই পেয়েছি। এখানে অনেকটা। স্যালুট করার মত পারফরমেন্স, গর্ব করার মতো শিল্পী। মিলন ভাই আহা। বিদেশের ওমেন ট্রাফিকিং-এর সাথে যুক্ত ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকা নায়ক চরিত্রের পরিণতিতে হয়ে উঠে প্রেমিক— ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে মার খেয়ে ভুত হয়ে যায়, কিন্তু ভেতরের মানুষটা জেগে উঠে। কী সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে চরিত্রটি। আহা মিলন ভাই, অনেকদিন পর তোমাকে পেলাম। রিক্তা, রমিজ রাজু, অন্তু, সাবেরী আপা, দিলারা মা— কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি। ভালো অভিনয়ের মেলা বসেছে আলতা বানুতে। যারা বলে আমাদের ভালো অভিনয়শিল্পী নেই— তাদের বলি আসেন আলতা বানু দেখেন, স্বপ্নজাল দেখেন, আয়নাবাজি দেখেন, নিজের দেশের প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে শেখেন। তবে এর পেছনে একজন অরুণ চৌধুরী, একজন গিয়াস উদ্দিন সেলিম লাগে, একজন অমিতাভ রেজা চৌধুরী লাগে— তাও আমাদের আছে। আছে আরো অনেক নাম। অনেক মেধাবী নির্মাতা।

৬. নো স্পুন ফিডিং। আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি আলতা বানু ছবির এই বৈশিষ্টটাতে। আলতা বানুর গল্পটা বুঝতে হলে আপনাকে মাথা খাটাতে, অরুণ দা আপনাকে চামচে করে খাইয়ে দেবেন না। মূল গল্পের অনুষঙ্গ বুঝতে হলে, দেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক উপাদানগুলোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আপনাকে কিছু লিঙ্ক মিলিয়ে নিতে হবে, যে লিঙ্কগুলো ছবির পরতে পরতে অরুণ দা দিয়ে গেছেন। আমি তাই আলতা বানুকে স্মার্ট সিনেমার কাঁতারে রাখবো। আমার মতে স্মার্ট সিনেমার মূল গুণ এটাই।

৭. আলতা বানু ছবির শেষে গিয়ে আর দুটি বোনের গল্পে হয়ে থাকে না- মানবতার গল্প হয়ে উঠে। স্পয়লারের কারণে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। আর সেখানেই আলতা বানু একটি মহৎ সিনেমা হয়ে উঠে। আহা।

৮. বন্ধুরা আমাকে বলে আমি নাকি কোন সিনেমাকে ভালো বলতে শুরু করলে অনেক বেশি ভালো বলে ফেলি, ভুল-ক্রটিগুলো আমার চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে, কিন্তু সেগুলো আমার কাছে বড় হয়ে উঠে না। কারণ আমি তো জানি সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়? অন্যকে টেনে নামানোর দৌড়ে আমি নেই। সম্ভাবনা দেখলে চাতকের মত তাকিয়ে থাকি। একটা ভালো সিনেমার আশায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাময় দিকগুলো তুলে ধরতে ধরতে আমরা একটি সারা বিশ্বের কাছে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রের দেশ হয়ে উঠবো।

আপনার পছন্দ নাও হতে পারে এরকম কিছু কিছু বিষয় আছে আলতা বানুতে- তবে পজেটিভ মন দিয়ে দেখলে সেগুলো আপনি ইগনোর করতে পারবেন অনেক অনেক ভালো বিষয়ের ভিড়ে। ইনফ্যাক্ট সেগুলো নিয়ে কথা বলার সময়ই পাবেন না। তবে একটা বিষয়— অরুণ দা চাইলে পারতেন গানে একটু জোর দিতে। তাহলে আমরা পুরনো কিছু গানের নতুন রূপ না পেয়ে নতুন কিছু গান পেতাম, সেটা বেশি আবেদনও রাখতো হয়তো। সম্পাদনা খুব ভালো, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ঠিক মানিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় আলতা চরিত্রের অস্থিরতা খানিকটা সিনেমাটাকে সংক্রমণ করেছে আর তাতেই জাস্টিফিকেশন হয়েছে অস্থিরতাটা, তবে দু-একবার থিতু হয়ে বসলে কাঁদলে-কাঁদালে খারাপ লাগতো না হয়তো।

৯. আমাদের কাজটা কী এবার? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটা। আলতা বানুর প্রচার এত কম কেন, এত কম হল কেন? এরকম ভালো অনেক ছবি এক সপ্তাহ পরে হল থেকে নেমে গেছে— আসুন না আলতা বানুর পাশে দাঁড়াই। অরুণ দা নিভৃতচারী মানুষ, তার পাশে গিয়ে না দাঁড়ালে তিনি হয়তো একলাই যতটা পারবেন লড়ে যাবেন। আলতা বানুর কথা ছড়িয়ে দেই, আলতা বানু হলে গিয়ে দেখি, অন্যকে দেখতে বলি।

আমার এই লেখাটি শেয়ার করি, সাংবাদিকরা এই লেখাটি ছাপেন, দেখেন , লেখেন। ঢাকা অ্যাটাক যাদের ভাল লেগেছিল তাদের কাছে খানিক দাবী নিয়েই অনুরোধ করছি- আলতাবানু দেখেন, দেখান, দেখতে বলেন। আলতা বানুর পাশে দাঁড়ান- একবারে খাঁটি একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পাশে দাঁড়ান- বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান। দেশটা আমাদের- চলচ্চিত্র আমাদের- ভালবাসা আমাদের। তাই পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আর আলতা বানু সেটা ভালমতই ডিসার্ভ করে।


মন্তব্য করুন