Select Page

‘দেবী’ : ছবিটি রহস্য নাকি ভৌতিক!

‘দেবী’ : ছবিটি রহস্য নাকি ভৌতিক!


হ‌ুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেবী’। সাহিত্যের এই জাদুকর ১৯৮৫ সালে এটি প্রকাশ করে পাঠককুলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। বিশেষ করে এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করেন নতুন এক চরিত্র- মিসির আলি।

দীর্ঘ সময় পর পরিচালক অনম বিশ্বাস ও প্রযোজক জয়া আহসান তাদের প্রথম সিনেমায় নিয়ে এলেন মিসির আলিকে। সঙ্গে রেখেছেন উপন্যাসের অন্য চরিত্র রানু, নীলু, আহমেদ সাবের ও আনিসদের।

সেই মিসির আলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কীভাবে হাজির হয় রুপালি পর্দায় তা দেখার তীব্র আগ্রহবোধ ছিল দর্শকের। তাই প্রথমদিন প্রথম শো থেকে দর্শক হলে টানতে সফল হয়েছে ‘দেবী’ টিম। সিনেমা হলে দর্শক পরিপূর্ণ। হিউমারে উচ্চস্বরে হাসি কিংবা সিনেমা শেষে জোরে জোরে করতালি আর শিস, মাঝে মাঝে গা ছমছমে ভয়– নির্মাতা-প্রযোজক-শিল্পীদের এরচেয়ে বেশি স্বস্তির আর কী হতে পারে? কারণ, ছবিটি নাচ-গান-ফাইট আর কমেডি সমৃদ্ধ ট্র্যাডিশনাল কিছু নয়। একেবারেই ফর্মুলার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু দেখতে পেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকরা।

তবু আলোচনা করা যেতে পারে কেমন হলো ‘দেবী’? সাহিত্যের সঙ্গে না মিলিয়ে শুধু একটি সিনেমার ছাঁচে ফেলে দেখা দরকার কতটা সফল হলো?

একজন পরিচালক হিসেবে ‘দেবী’ অনম বিশ্বাসের প্রথম সিনেমা। আবার প্রযোজক হিসেবে জয়া আহসানেরও অভিষেক হলো।

অল্প গল্পে দেবী:

সিনেমা সমালোচনায় গল্প বলতে নেই। যদিও ১৯৮৫ সালে দেবীর গল্প বলেই গেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তবু অল্প কথায় কিছুটা বলা যেতে পারে। রানু আনিসের সাদামাটা সংসার। সেই সংসারে একটা মহা ঝামেলা চলছে। সেটা হলো, রানুকে রাতেরবেলা কেউ ডাকে। একইসঙ্গে রানুর স্বপ্ন সত্য হয়, রানু যা ভাবে তাও সত্য হয়। ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই অলৌকিক ক্ষমতা সে স্বামী আনিসকে জানায়। আনিস চেষ্টা করে রানুর পাশে থাকার। একসময়ে আনিস যায় মিসির আলির কাছে। মিসির আলি খুঁজে দেখার চেষ্টা করে রানুর সমস্যাগুলো। রীতিমত অনুসন্ধান। আর এই অনুসন্ধানে মিসির আলি একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছান ঠিকই। কিন্তু রানুর অলৌকিক ক্ষমতার হিসাব মেলাতে মেলাতে সিনেমার শেষ পর্যায়ে চলে আসে। এর বেশি গল্প আর বলার দরকার পড়ে না।

যা ভালো লেগেছে:

১. দেবীর সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, গল্পের গতি। টানটান উত্তেজনায় বড় একটা সময় দর্শককে আটকে রাখতে পেরেছেন পরিচালক অনম বিশ্বাস।

২. হিউমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেখানে মূল গল্প হ‌ুমায়ূন আহমেদের, সেখানে হিউমার না থাকলে অবিচার হতো। ছোট ছোট হিউমার অর্থাৎ হাসির পাঞ্চগুলোতে দর্শক ঠিকই হেসে মাতিয়ে তুলেছিল সিনেমা হল। যেমন ‘গোবরে পদ্মফুল’ সূত্রকে কাজে লাগিয়ে মিসির আলির কমোডে গোলাপ ফুলের গাছ লাগানোর বিষয়টি!

৩. আলো-আঁধারির খেলা ছিল সিনেমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ। যেহেতু গল্পের মূল বিষয় ‘অলৌকিক শক্তি’, সেহেতু ভৌতিক আবহ তৈরি করাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছায়ার দৃশ্য, কারও হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ, কিংবা নূপুরের শব্দগুলো অন্যরকম আবহ তৈরি করতে পেরেছে সিনেমায়। মানে এসব বিষয় একবারও মনে হয়নি বানানো। বরং সত্যি বলেই বারবার চিকন ঘামের জন্ম দিয়েছে এয়ারকুলার সমৃদ্ধ অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসে।

৪. শব্দ দিয়ে ভৌতিক কিংবা রহস্যের আবহ তৈরির চেষ্টা ছিল। যা মন্দ লাগেনি। রানু বলে ডাক দেওয়া কিংবা হঠাৎ কারও গলার আওয়াজে অনেক দর্শক পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। অনেকেরই ধারণা ছিল আওয়াজ আসছে দর্শক সারি থেকে।

৫. অভিনয়ের প্রসঙ্গ আসলেই রানু চরিত্রে জয়া আহসান অনবদ্য। তার কাছ থেকে এমন অভিনয় প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ, দুই বাংলায় দাপিয়ে বেড়ানো জয়া আহসানের কাছে অভিনয়ের মন্ত্রটা যে এখন হাতের মুঠোয়!
দ্বিতীয়ত, চঞ্চল চৌধুরীর প্রশংসাও করতে হয়। মিসির আলি চরিত্রে অভিনয়ে তাকে মানিয়েছে বেশ। বিশেষ করে তার চুল আর কণ্ঠ- একশতে একশ। তবু কোথায় যেন মিসির আলির কিছু একটা অনুপস্থিত মনে হয়েছে। হতে পারে মেকআপ-গেটআপ। সে দায় অবশ্য চঞ্চলের কাঁধে দেয়া যায় না। স্ক্রিপ্টের মধ্যে থেকে যতটুকু মেলে ধরা যায় তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন চঞ্চল।

৬. অন্য আরেকটি বিশেষ চরিত্র নীলু। অভিনয় করেছেন শবনম ফারিয়া। ছোট পর্দার এ অভিনয়শিল্পীর সকল চেষ্টা ছিল বড় পর্দায় নিজেকে মেলে ধরার। ভালো করেছেন তিনি। খল চরিত্র আহমেদ সাবের হিসেবে ছিলেন ইরেশ যাকের। তার চরিত্রের পরিসরটা ছোট হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও দারুণ করেছেন।
এছাড়াও ছোট ছোট চরিত্রে যারা ছিলেন তারাও তাদের কাজটুকু ঢেলে দিয়েছেন। যেমন সোলায়মান খোকা অন্যতম।

৭. ছবির সিনেমাটোগ্রাফি ও আবহসংগীতের প্রশংসা না করে উপায় নেই। ঝকঝকে পর্দায় ‘দেবী’ উপভোগ করবেন সবাই। বিশেষ একটি দৃশ্যে অসম্ভব সম্মোহিত হয় দর্শক। দৃশ্যটা ছিল জয়া আহসান ছাদে একটি জায়গায় বসে আছেন। বাতাসে গাছের পাতাগুলো তাকে ঢেকে দিতে চায়। তার সামনে একটা পেঁচা বসে আছে। দূর থেকে দুটি ‘ভূত কিংবা আত্মা’ দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য এক অন্যরকম সম্মোহনী তৈরি করে ওই সময়টায়।

৮. এই ছবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় সাউন্ড ডিজাইন, লাইট ও ক্যামেরা ও সম্পাদনার কাজ। ধারণা করা যেতে পারে, এই মানের টেকনিক্যালি সমৃদ্ধ সিনেমা আমাদের এখানে আর হয়নি। অথচ এটি সরকারি অনুদানের ছবি।

যেটুকু মন্দ লেগেছে:

১. অভিনয়ে সবার প্রশংসা করেছি। কিন্তু একজনকে এড়িয়ে যাওয়া হলো। তিনি হলেন আনিস চরিত্রে অভিনয় করা অনিমেষ আইচ। অনিমেষ অত্যন্ত দক্ষ একজন নির্মাতা। তিনি আগেও টুকটাক অভিনয় করেছেন। তবে এবারের ক্যানভাসটা বেশ বড়, জয়া আহসানের স্বামীর চরিত্র। তার অভিনয় খুব মন্দ হয়েছে না বললেও ভালো হয়েছে তা বলা যাবে না। আনিস চরিত্রটি অন্যতম চরিত্র হয়েও কেন যেন অনেকটাই খাপছাড়া মনে হচ্ছিল। এখানে প্রফেশনাল কোনও অভিনেতাকে পেলে বিষয়টি আরও মজবুত হতো।

২. মিসির আলি সবকিছুকে বিচার করেন বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে। এখানেও তার কাজ সেটাই। তার কাজ বিজ্ঞান চিন্তা দিয়ে রহস্য উন্মোচন করা। কিন্তু সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত রহস্যের নাকি ভৌতিক- এই প্রশ্নটা দর্শক মনে থেকেই যায়। মিসির আলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুব একটা জোরালো করে সিনেমায় ফুটে ওঠেনি। অন্তত শেষে নীলুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা সিনেমাটিকে ভৌতিক দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয় বলেই মনে হয়েছে। ফলে ভৌতিক সিনেমাটি দেখতে বসে যারা মিসির আলির প্রতি আস্থা রেখেছেন সমাধানের জন্য- তারা নাখোশ হয়েছেন বটে!

৩. মিসির আলির প্রভাব সিনেমায় তেমন নেই। পুরোটাই রানুর অলৌকিক ক্ষমতার গল্প। মিসির আলি খুব বেশি বিকশিত হতে পারেনি। এই আক্ষেপ দর্শক হিসেবে থেকেই যাবে। মিসিরের আরও অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অপেক্ষা করতে করতেই যেন সিনেমাটা শেষ হয়ে গেলো। তার চরিত্র দিয়ে সিনেমায় অন্যরকম থ্রিল অনুভূতি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। সে জায়গা খুব বেশি সফলতা পায়নি গল্পটি। এছাড়াও যখন মিসির আলি গ্রামের পথে পথে ঘুরছেন, রানুর বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, মনে হচ্ছিল গল্পটাও ঝুলে যাচ্ছে।

৪. সবচাইতে বড় সমস্যাটি হলো, একজন জনপ্রিয় লেখকের অন্যতম একটি সৃষ্টি নিয়ে সিনেমা তৈরি করা। যে গল্প পড়া হয়ে গেছে। একবার ছাপা অক্ষরে বলা হয়ে গেছে। সেই গল্পের সিনেমা দর্শককে কেন টেনে ধরে রাখবে? সেই প্রশ্নটাও তৈরি হয়। যারা পড়েননি। তাদের কাছে আগ্রহ তৈরি হবে- এটাও বলা যায়।

প্রচারণায় যেন এক নতুন মাত্রা:

বাংলা সিনেমার দর্শক কমতির দিকে। এই তো সেদিন রাজশাহীর সর্বশেষ সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এমন রুগ্ন এক সিনেমার বাজারে ‘দেবী’ আনা একরকম চ্যালেঞ্জ ছিল প্রযোজক জয়া আহসানের। সেই সব চ্যালেঞ্জ উতরে বলা চলে জাঁকজমকভাবেই এসেছে ‘দেবী’। একটি চ্যানেলে খবর পড়া থেকে শুরু করে সব গণমাধ্যমে সরব ‘দেবী’ নিয়ে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি এ সবকিছুই আগ্রহ জন্ম দিয়েছে সিনেমাটি নিয়ে। সবচাইতে বড় বিষয় হলো- নির্মাতা থেকে প্রযোজক, কলাকুশলী সিনেমাটিকে শেষ পর্যন্ত নিজের মনে করতে পেরেছেন কিনা। কয়টা সিনেমায় দেখা যায় দর্শকের ভেতরে নিজস্বতা তৈরি করার চেষ্টা করেছে কেউ? তাক লাগানো প্রচারণা করে দর্শকদের বোঝাতে পেরেছে এটা আমাদের সবার সিনেমা। কয়টা সিনেমা আজ অবধি পেরেছে? দর্শকদের হৃদয়ে এই বার্তাটা পৌঁছাতে যে এই সিনেমাটা আমাদের সবার। দেবী’র প্রচারণায় একদম পাক্কা একশ’তে একশ।
সবশেষ আলোচনায় বলতে হয়, বাংলা সিনেমায় দেবী’র মতো পরিপাটি সিনেমা আরও বেশি বেশি জরুরি। বাংলা সিনেমার উন্নতির স্বার্থে দেবীর মতো প্রচারণাও জরুরি। অনম বিশ্বাসের মতো তরুণ পরিচালক, জয়া আহসানের মতো প্রযোজক– এমন আরও ক’জন জুটলেই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়া থেকে বেঁচে যাবে বলেই বিশ্বাস।

একনজরে দেবী:
নাম: দেবী- মিসির আলি প্রথমবার
রেটিং: ৭/১০
মুক্তি: ১৯ অক্টোবর ২০১৮
প্রেক্ষাগৃহ: ২৮টি
শিল্পী: জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অনিমেষ আইচ, শবনম ফারিয়া, ইরেশ যাকের প্রমুখ।
পরিচালনা, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: অনম বিশ্বাস
প্রযোজক: জয়া আহসান (সি-তে সিনেমা) ও সরকারি অনুদান
সংগীত: অনুপম রায়, প্রীতম হাসান, এম জি কিবরিয়া
আবহসংগীত: প্রবুব্ধ ব্যানার্জি
শিল্পনির্দেশক: সামুরাই মারুফ
সিনেমাটোগ্রাফি: কামরুল হাসান খসরু
সম্পাদনা: সজল সরকার
প্রচার পরিকল্পনা: রুম্মান রশীদ খান


মন্তব্য করুন