Select Page

দেবী – মিসির আলি প্রথমবার

দেবী – মিসির আলি প্রথমবার

দেবী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি ধারাবাহিকের প্রথম উপন্যাস। আশির দশকের শেষের দিকে লেখা এই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন অনম বিশ্বাস। তিনি মূল থিমটা ঠিক রেখে আধুনিক সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর মত করে এই উপন্যাসটি চলচ্চিত্র উপযোগী করেছেন। এই সময়ের সাথে তাল মেলাতে তিনি বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন গল্পে। যারা উপন্যাস পড়েছেন, তারা এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করেছেন এবং করবেন। আর যারা উপন্যাসটি পড়েননি, তারা সম্পূর্ণ নতুন গল্পই পাবেন।

“পুরো ছবিটির আলোচনায় অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ওঠে এসেছে, ফলে যারা এখনো ছবিটি দেখেননি, তাদের জন্য স্পয়লার্ট অ্যালার্ট রইল।”

রানু ছেলেবেলার একটি রহস্যময় ঘটনার পর থেকে অডিটরি হেলুসিনেশনে ভুগছে। রাতে প্রায়ই ঘুমের মধ্যে হাসে, কিংবা ভয় পায়। তার স্বামী আনিস তার এই অবস্থা থেকে উত্তরণের ব্যাপারে খোঁজ নেন এবং তার সহকর্মীর কাছ থেকে মিসির আলির ঠিকানা পান। মিসির আলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইম শিক্ষক, তিনি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি পড়ান। তিনি রানুর ঘটনা শুনেন এবং এ সম্পর্কিত আরও তথ্যাদি সংগ্রহে বের হন। অন্যদিকে, রানু তার অসুস্থতার কারণে গড়ে ওঠা এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন দিয়ে তাদের বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে নীলুকে বিস্মিত করে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নীলু ফেসবুকে এক ফেক অ্যাকাউন্টধারীর সাথে চ্যাট করে এবং পরবর্তীতে তার সাথে দেখা গিয়ে বিপদে পড়ে নীলু। সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের সাথে যোগসূত্র হয় রানুর কিশোরী বয়সের ঘটনার। এই রহস্যময় ঘটনাদ্বয়ের সমাধান কি আছে যুক্তিবাদী মিসির আলির কাছে!

মিসির আলি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। তিনি সবকিছু যুক্তির আরশীতে খণ্ডন করতে পছন্দ করেন। হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি মধ্য বয়স্ক (৪০/৪১ বছর বয়স), রুগ্ন, ও হালকা-পাতলা ঘরনের ব্যক্তি। কিন্তু ছবিতে মিসির আলি চরিত্রে অভিনয় করা চঞ্চল চৌধুরীকে যারপনাই খুব বেশি বয়স্ক দেখানোর একটা তাগিদ ছিল। তার মাথায় পাকা চুল। আলসারের ব্যথায় পীড়া পাচ্ছেন বললেও তাকে যথেষ্ট সুস্থই মনে হয়েছে। এছাড়া রানুর কথা শুনার মুহূর্তে তার মুখাভঙ্গি ‘আয়নাবাজি’ ছবিতে তারই করা নিজাম সাঈদ চৌধুরীর মত ছিল। এটা সম্ভবত দুটি ছবির চিত্রনাট্যকার একই ব্যক্তি বলেই হয়েছে। এখানে দুটি চরিত্রে ভিন্নতা আনয়নের লক্ষ্যে হলেও কিছুটা পরিবর্তন আনা উচিত ছিল। অবশ্য এই বিষয়গুলোতে চঞ্চল চৌধুরীর হাত নেই। তিনি তার অভিনয়টা যথোপযুক্তভাবে করে গেছেন সূক্ষ্মভাবে সব বিচার বিশ্লেষণ ও শরীরী ভাষায়।

রানু চরিত্রটি এই ছবির প্রাণ, তাকে ঘিরেই গল্পটি আবর্তিত হয়েছে।  এই চরিত্রে জয়া আহসানকে দেখে মনে হচ্ছিল বইয়ের রানুকেই পর্দায় দেখছি। রানু চরিত্রের জন্য জয়াকে খাপ খাওয়ানোর জন্য এই চরিত্রের বয়স বছর দশেক বৃদ্ধি করা হয়েছে (১৬-১৭ থেকে মধ্য বিশ)। এতে করে দর্শক জয়ার সাবলীল ও সুন্দর কাজ দেখতে পেয়েছেন। জয়ার কিশোরীসুলভ আচরণ, মিসির আলির সামনে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলতে গিয়ে সচকিত ভঙ্গি, অডিটরি হেলুসিনেশনের সময় তার ভয়ার্ত চেহারা – সব মিলিয়ে তার চরিত্রটিকে মনোরমভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতা মুগ্ধ করেছে। আর খোলা-ছড়ানো চুলে ও কাজল চোখে তাকে দেবী মূর্তিই লেগেছে। তিনি এই ছবির অন্যতম প্রযোজক বলেও হয়ত অভিনয়ে সর্বোচ্চ দেওয়ার একটা উদ্যম ও প্রেরণা কাজ করেছে।

গল্পের অন্যতম চরিত্র রানুর লিগ্যাসি বহন করেছে এবং করবে এমন একটি চরিত্র হল নীলু। ফলে নীলু চরিত্রটিও উপরের দুটি চরিত্রের মতই গুরুত্ব বহন করে। নীলু চরিত্রে শবনম ফারিয়া যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন, কোথাও কম নয়, আবার বেশিও নয়। তার অন্তর্মুখী-স্বভাব, নার্ভাসনেস, রূপের ব্যাপারে নিজেকে কিছুটা হেয় করে দেখা – তিনি স্বচ্ছন্দেই করেছেন।

গল্পের আঙ্গিক বিচারে রানুর স্বামী আনিস চরিত্রটি সাধারণ, অনিমেষ আইচ ফুলটাইম অভিনেতা না হলেও সহজ-সরল ও স্ত্রীর প্রতি প্রেম ও মমত্ব-সম্পন্ন স্বামী চরিত্রে তার কাজ দিয়ে উৎরে গেছেন। অন্যদিকে, সাবেত চরিত্রে ইরেশ যাকের যেমন হঠাৎ পর্দায় অবতীর্ণ হয়েছেন, ঠিক মনে হল হঠাৎই মিলিয়ে গেলেন। তার ভয়াবহতা প্রকাশার্থে, বিশেষ করে নীলুকে আটকে রাখার স্থলে, তার স্ক্রিন টাইম আরেকটু বাড়ানো যেতো। বাকি ছোটখাট চরিত্রে যারা কাজ করেছেন পরিচালক তাদের থেকেও সাবলীল কাজ বের করে এনেছেন।

ছবিটির বেশির ভাগ দৃশ্যায়ন ঘরের ভিতরে হলেও কিছু বাইরের শট, বিভিন্ন লোকশন, যেমন – রানুর যে মন্দিরে যেতো, রানু ও নীলুরা যে বাড়িতে থাকে, মিসির আলির বাড়ির বাইরের দিকটা, এইগুলোর উপস্থাপনা মনোরম ছিল। আর ঘরের ভিতরের দৃশ্যগুলোকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে শিল্প নির্দেশকও সুন্দর কাজ করেছেন। বিশেষ করে, মিসির আলির এলোমেলো ঘরে বিভিন্ন গাছপালার সমাহার, নীলু ও সাবেতের দেখা করা রেস্তোরাঁ, রানুর ঘরের শিশুসুলভ আঁকিবুকি। অন্য চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে রূপসজ্জাকার ঠিকঠাক কাজ করলেও মিসির আলির ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি রকমের মেক-আপ দিয়েছেন, যেটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ছবিতে অনুপম রায়ের গাওয়া একটি গান রয়েছে। “দু মুঠো বিকেল” শিরোনামে গানটি দৃশ্য পরম্পরার ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রা যোগ করে। “দোয়েল পাখি কন্যা রে” গানটি প্রচারণায় ব্যবহার করা হলেও ছবিতে ছিলো না, তবে তা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের গল্প বর্ণনার ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখা যেতো। ছবির আবহ সঙ্গীত বিশেষ প্রশংসার দাবিদার। প্রবুদ্ধ ব্যানার্জির আবহ সঙ্গীতে উত্তেজনা ও ভয় ফুটে উঠেছে। কিছু কিছু মুহূর্ত পিলে চমকে ওঠার মত ছিল। অবশ্য এই মুহূর্তগুলোতে জাম্প-কাটের মাধ্যমে অন্য স্বাভাবিক দৃশ্যে চলে যাওয়া এবং কিছু ভিএফএক্সের কাজ ভাল হলেও কিছু ক্ষেত্রে সম্পাদক সজল সরকার তার পূর্ণ কারিশমা দেখাতে পারেননি।

দেবী শুধু রহস্য চলচ্চিত্র এবং যুক্তিবাদী মিসির আলির যুক্তির খেলা নয়, এতে পরিচালক বিনোদনেরও সুযোগ রেখেছেন। আনিসের মিসির আলির সাথে দেখা করতে আসার পরের দৃশ্য, রানু মিসির আলির মুঠোফোনে যোগাযোগের সময় লটারির ব্যাপারটি, জিতু মিয়ার ‘জল বর্ষণ’ – এই সব বিনোদনও রেখেছেন গল্পকে খুব বেশি গুরু-গম্ভীর না করার জন্য।

উপন্যাসের মূল থিমের উপর আস্থা রেখে অনম বিশ্বাসের আধুনিক সময় উপযোগী ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ সুন্দর। ব্যাখ্যাতীত কিছু রহস্যের সমাধান সম্ভব নয়। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও তার সমাধান দেননি, অনম বিশ্বাসও সে দিকটাতে পা বাড়াননি।

যাই হোক, যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন সংবাদে প্রকাশ হয়েছে ‘দেবী’ এই ক’দিনেই ব্যবসাসফল এবং তার মূলধন ফেরত পেয়েছে। এটি বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখবর এবং যারা ভালোবেসে ছবিটি দেখতে গিয়েছে তাদের জন্যও। হয়ত এই ধারাবাহিকতায় মিসির আলি ধারাবাহিকের অন্য উপন্যাসগুলোও আমরা পর্দায় দেখতে পাবো।

চলচ্চিত্র : দেবী
পরিচালক : অনম বিশ্বাস
শ্রেষ্ঠাংশে : জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, শবনম ফারিয়া, অনিমেষ আইচ, ইরেশ যাকের
মুক্তি : ১৯ অক্টোবর ২০১৮
রেটিং : ৪/৫


মন্তব্য করুন