
দেশের বিজ্ঞাপন বাজারের ৮০ শতাংশ একটি গ্রুপের হাতে
বছরে আনুমানিক চার হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনী বাজারের ৮০ ভাগই দখলে রেখেছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং প্রয়াত আলী যাকের পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক গ্রুপ। আমার দেশের এক প্রতিবেদন অনুসারে, অন্তত ১৭টি ভিন্ন কোম্পানি রয়েছে এ গ্রুপে, যা বিগত দেড় দশকে বিজ্ঞাপনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ধরনের একচেটিয়া ব্যবসা দেশের কোনো আইনের লঙ্ঘন কিনা, তা উল্লেখ না করলেও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ তুলেছে পত্রিকাটি। তবে অভিযোগগুলো অস্বীকার করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজ পাওয়ার কথা বলছে এশিয়াটিক।।

যেখানে বলা হচ্ছে, দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার এশিয়াটিকের দখলে রাখতে বহু বছর ধরেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন এ দেশে নিয়োজিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ২০১৫-১৬ সালে বাংলালিংকের ডাইরেক্ট মার্কেটিং বা একটিভেশন এজেন্সি মার্কেট অ্যাক্সেস এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা ক্যারটের ব্যবসা বন্ধ করতে চাপ দেওয়া হয়। এই দুই কোম্পানির চেয়ারম্যানকে দেশছাড়া করা হয় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ তুলে। বলা হয়, এই দুই কোম্পানির চেয়ারম্যান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। বাধ্য হয়ে তিনি বিজ্ঞাপন ব্যবসা গুটিয়ে নেন। এরপর বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনের কাজ বাগিয়ে নেয় এশিয়াটিক গ্রুপ। কিছুদিন পর বাংলালিংকের মিডিয়া প্ল্যানিং ও বায়িংয়ের সেবাদানরত এজেন্সি টপ অব মাইন্ড নামের সংস্থাটির ব্যবসাও হাতিয়ে নেয় এশিয়াটিক গ্রুপ।
তবে এ বিষয়ে বাংলালিংকের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলালিংক যা করেছে, তা শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে যথাযথ নীতিমালা মেনেই করেছে। সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন অনুসারে তারা সরবরাহকারী নির্বাচন করে থাকে।
আমার দেশের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৬ সালে ইউনিলিভার থেকেও ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ক্যারটের সহযোগী ডাইরেক্ট মার্কেটিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মার্কেট অ্যাক্সেসকে। তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের চাপে মার্কেট অ্যাক্সেসকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞাপন ও প্রচার-প্রকাশনার কাজ দেওয়া হয় এশিয়াটিক গ্রুপকে। এর আগে বাংলালিংক থেকেও মার্কেট অ্যাক্সেসকে বিদায় জানানো হয়। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বন্ধু বলে পরিচিত বাংলালিংকের এক কর্মকর্তা চাপ দিয়ে তাদের বাদ দেন।
এশিয়াটিক গ্রুপ নিজেদের মালিকানায় ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে কমপক্ষে ১৭টি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। প্রকাশনা ও প্রচারণা, সৃজনশীল উদ্ভাবন, কৌশলগত পরিকল্পনা, মিডিয়া স্পট ক্রয়, জনসংযোগ, একটিভেশন, ডাইরেক্ট মার্কেটিংসহ সব কাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই তারা এতগুলো কোম্পানি খুলেছে। এ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯০-এর দশকে প্রতিটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিজ্ঞাপন বাজারের সব বিভাগের কাজই করত এবং নিজেকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞাপন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করত। তবে সময়ের পরিক্রমায় এখন নানা ধাপে কাজ হয়। এগুলোর মধ্যে আছে জনসংযোগ, সৃজনশীল সেবা, মিডিয়া প্ল্যানিং ও বায়িং-সংক্রান্ত সেবা। বিশেষায়িত সেবাদানকারী নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বিজ্ঞাপন বাজারে।
এশিয়াটিক গ্রুপ বা এশিয়াটিক থ্রি-সিক্সটি গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে- এশিয়াটিক এমসিএল, এশিয়াটিক সোশ্যাল, এশিয়াটিক টকিং পয়েন্ট, মাইন্ড শেয়ার বাংলাদেশ, এমবিএ, ওয়েভ মেকার, আউট অব দ্য ব্লু ডিজাইন স্টুডিও, ধ্বনিচিত্র, ফোরথট পিআর, ব্ল্যাকবোর্ড স্ট্যাটেজিজ, স্টেনসিল বাংলাদেশ, এশিয়াটিক এক্সপেরিমেন্টাল, অপটিমাম সার্ভিস, রেডিও স্বাধীন, এশিয়াটিক ডিজিটাল, এ মাইনর স্টুডিও এবং এশিয়াটিক টিএমএস। এর বাইরেও অন্য নামে কোম্পানি থাকতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে আমার দেশ তা নিশ্চিত হতে পারেনি।
প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়াটিক গ্রুপ গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনের কাজ করে। আবার রবি বা বাংলালিংকের কাজও করে। অথচ তিনটি টেলিকম কোম্পানিই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রচলিত বিজ্ঞাপন নীতির আওতায় এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, এশিয়াটিক গ্রুপ ভিন্ন তিনটি কোম্পানি তৈরি করে একাই এই বড় বড় তিনটি টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে।
প্রয়াত আলী যাকের ছিলেন এশিয়াটিক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তার মৃত্যুর পর গ্রুপটির দায়িত্ব নেন নীলফামারীর আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তবে হাসিনার পলায়নের পর আসাদুজ্জামান নূরকে এশিয়াটিক গ্রুপ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমার দেশ-এর লিখিত প্রশ্নের উত্তরে গ্রুপটি জানিয়েছে, গত বছর আগস্টে এশিয়াটিক গ্রুপের সব শেয়ার ছেড়ে দেন আসাদুজ্জামান নূর। তবে কারা এই শেয়ার কিনেছে এবং আগস্টের কোন সময়ে তিনি চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন, সে বিষয়ে কিছুই বলেনি এশিয়াটিক গ্রুপ। যদিও এ বিষয়ে তাদের কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে এশিয়াটিক গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রয়াত আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকের। ছেলে ইরেশ যাকের রয়েছেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। আর মেয়ে শ্রেয়া সর্বজয়া রয়েছেন রেডিও স্বাধীনের দায়িত্বে। আসাদুজ্জামান নূরের ছেলে সুদীপ্ত এশিয়াটিক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুদীপ্ত আরিকুজ্জামান কাজ করতেন এশিয়াটিক গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান ফোর থট পিআরে। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি এখানে আছেন কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেনি এশিয়াটিক গ্রুপ।
আমার দেশ বলছে, আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে যেমন খুনের অভিযোগ আছে, তেমনি এশিয়াটিক গ্রুপের মাধ্যমে দেশের গণমাধ্যম শাসনের অভিযোগও রয়েছে। তার ক্ষমতার দাপটে বিজ্ঞাপনের বাজার যেমন শুধু এশিয়াটিকনির্ভর হয়ে পড়ে, তেমনি কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিল আটকে দিয়ে গণমাধ্যমগুলোকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তিনি। আরো বলা হয়, আসাদুজ্জামান নূরের গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের নানা কৌশলের অন্যতম ছিল মাসের পর মাস কোনো কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলকে বয়কট করা।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি দেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওয়ামী ‘গবেষণা’ প্রতিষ্ঠান সিআরআই। গবেষণার নামে মূলত বিরোধী মতাদর্শের নেতাকর্মীদের দমনের ছক কষা হতো এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনও নিয়ন্ত্রণ করত। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে চালাত মিথ্যা প্রচারণা। তথাকথিত এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআইর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে এশিয়াটিক গ্রুপের এমডি ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এ উপলক্ষে গোটা বাংলাদেশকেই সাজিয়েছিল হাসিনা সরকার। এ সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনে। সেই ইভেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হাসিনার বিশ্বস্ত এশিয়াটিক গ্রুপকে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেটের ইভেন্ট ছিল মোদি আর কোবিন্দকে কেন্দ্র করে। আওয়ামী লীগের রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সমন্বয় করে সেসব কাজ করেন ইরেশ যাকের।
প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে, এশিয়াটিককে দেওয়া একটি দরপত্রের কাগজ এসেছে আমার দেশ-এর হাতে। এতে দেখা যায়, মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে শুধু গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিওডি) ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকেই ৯৮ কোটি ৫১ হাজার ৬৭ টাকা নিয়েছে এশিয়াটিক গ্রুপ। এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন এ পরিমাণ টাকা নিয়েছে সংসদ ভবনের সামনে একটি মঞ্চ তৈরি, নায়ক-নায়িকাদের জন্য ছোট আকারের একটি গ্রিন রুম, অতিথিদের বসার ব্যবস্থা এবং একটি ছোট অস্থায়ী তাঁবু দিয়ে অফিস রুম স্থাপনের জন্য। সেই সঙ্গে তিন দিনের অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহ, জেনারেটর ভাড়া ও সিসি টিভি ভাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল এর মধ্যে।
এ বিষয়ে এশিয়াটিক গ্রুপ দাবি করেছে, ইরেশ যাকের কখনোই আওয়ামী রিসার্চ উইং সিআরআইর উপদেষ্টা সদস্য বা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। সিআরআই’র প্রতিষ্ঠাতা রেহানাপুত্র ববি বা সিআরআইর অন্য কারো সঙ্গে ইরেশ যাকেরের ব্যক্তিগত কিংবা এশিয়াটিক থ্রি-সিক্সটি গ্রুপের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক কোনো দিনই ছিল না। তারা আরো দাবি করে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানের ওয়ার্ক অর্ডারপ্রাপ্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি এশিয়াটিক থ্রি-সিক্সটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা মেনে সম্পন্ন করেছে। তবে এ বক্তব্য পাঠানোর পর আমার দেশ অনুসন্ধান করে দেখতে পায় হাসিনার ভাগনে বা শেখ রেহানার সন্তান ববির সঙ্গে ইরেশ যাকেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ববির পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইরেশ যাকেরকে দেখা গেছে।
এশিয়াটিক গ্রুপ শুধু বিজ্ঞাপনী বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেই ব্যবসা করেনি, বরং গত ১৬ বছরে প্রতিটি জয়বাংলা কনসার্টের অন্যতম আয়োজক হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রচারণার কাজটিও করেছে। নির্বাচনের আগে শত শত কোটি টাকা খরচে দেশে এবং বিদেশে শেখ হাসিনা সরকারের ‘উন্নয়ন প্রচারণা’ চালানোর দায়িত্ব পালন করেছে এশিয়াটিক। বিদেশে হাসিনার ইতিবাচক প্রচারণার জন্য এশিয়াটিকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ফোরথট লবিস্ট নিয়োগ করত।
২০২৩ সালের ডামি নির্বাচনের আগে মুজিব সিনেমার সম্পূর্ণ প্রচার (টিভি রেডিও আউটডোর, ডিজিটাল) এশিয়াটিক গ্রুপ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছে। বিদেশেও একই ছবির ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় ফোরথট পিআর ও মাইন্ডশেয়ারের মাধ্যমে।
গত বছর ৫ জুলাই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে অনুষ্ঠিত সমাপনী অনুষ্ঠানের জনসংযোগ কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে এশিয়াটিক গ্রুপ। এতে খরচ হয়েছিল ৫ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল ২০২২ সালের ২৫ জুন। সেই অনুষ্ঠানের কাজও পেয়েছিল এশিয়াটিক গ্রুপ। তবে এশিয়াটিকের বক্তব্য হচ্ছে, যথাযথ সব প্রক্রিয়া মেনেই তারা এই ইভেন্টের কাজ করেছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রি-সিক্সটি ও মিডিয়া এজেন্সি গ্রুপএমের যৌথ উদ্যোগে ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার লিমিটেড। মূলত এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার দেশের প্রায় ৮০ ভাগ বিজ্ঞাপনী বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রুপএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ আলম গত বছর ৫ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ‘হ্যাঁ, আমরা অনেক বড় প্রতিষ্ঠান; এখন প্রায় ৭০ শতাংশ বাজার হিস্সা আমাদের। আমরা একদিকে গ্রাহকের জন্য মিডিয়া প্ল্যান করছি; কোথায়, কোন মিডিয়ায়, কী পরিমাণ বিনিয়োগ করা দরকার, কোথায় বিনিয়োগ করলে সবচেয়ে বেশি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যাবে, সে সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছি।’
কী কী কোম্পানি তাদের দখলে আছে, তাও জানিয়েছিলেন মোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধিকাংশের সঙ্গেই আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে ইউনিলিভার, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, কোকা-কোলা, ম্যারিকো, নেসলে, ডাবর, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, দারাজ, বিকাশ, কোলগেট, রেকিট বেনকিজার, হোন্ডা, বাজাজ ও নিউজিল্যান্ড ডেইরি অন্যতম। দেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে মেঘনা গ্রুপ, বিএসআরএম, এসিআই, ওয়ালটন, ইফাদ উল্লেখযোগ্য। মোটা দাগে বর্তমান বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ কোম্পানির সঙ্গে আমরা যুক্ত।’ তবে প্রতিযোগী অন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর দাবি অনুযায়ী এশিয়াটিক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মোট বিজ্ঞাপনী বাজারের ৮০ শতাংশ।
এশিয়াটিক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রুপএমের এমডি মোরশেদ আলম আরো বলেন, মিডিয়া বায়িং এবং প্ল্যানিং-সংক্রান্ত কাজের জন্য তাদের চারটি কোম্পানি কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে আছে মাইন্ডশেয়ার, ওয়েভমেকার, এমবিএ এবং এমপাওয়ার। এ ছাড়া ইনফ্লুয়েন্সার ম্যানেজ করার জন্য তদারকিতে রয়েছে তাদের স্ট্যাকমিস্ট নামের আরেকটি কোম্পানি। এই পাঁচটি কোম্পানিরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন মোরশেদ আলম।
এসব কোম্পানিতে তার মালিকানা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবটাতেই নিজের ‘মাইনরিটি শেয়ার’ রয়েছে। তিনি জানান, এসব কোম্পানির অন্য মালিকরা হলেন আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, ইরেশ যাকের এবং শ্রেয়া সর্বজয়া যাকের। আসাদুজ্জামান নূর কোম্পানিগুলোর সাবেক চেয়ারম্যান হলেও গত বছর ৫ আগস্টের পর সারা যাকেরকে চেয়ারম্যান করার কথা জানান তিনি। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সারা যাকের কোম্পানিগুলোর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন বলে উল্লেখ করেন মোরশেদ আলম।
তার দাবি, আসাদুজ্জামান নূর বর্তমানে কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান পদে আর নেই এবং পরিচালনা পর্ষদেরও বাইরে রয়েছেন। উনি শুধু কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আছেন বলে উল্লেখ করেন মোরশেদ আলম।
এ ছাড়া বিজ্ঞাপন জগতের ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল সেবার জন্য এশিয়াটিক গ্রুপের প্রধান প্রতিষ্ঠান হলো এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড, যা এশিয়াটিক এমসিএল হিসেবে বেশি পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন ফেরদৌস হাসান নেভিল। কোম্পানির মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডার হিসেবে নেভিল কাজ করলেও মালিকানায় রয়েছেন আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, ইরেশ যাকের এবং শ্রেয়া সর্বজয়া যাকের। এখানেও আসাদুজ্জামান নূরকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের পর কোনো একসময় চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ দিয়ে সারা যাকেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে জানান মোরশেদ আলম।
ইভেন্ট এবং অ্যাকটিভেশন এজেন্সি হিসেবে এশিয়াটিক ইএক্সপি লিমিটেডের কথাও উল্লেখ করেন মোরশেদ আলম। তিনি জানান, এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ইরেশ যাকের। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়ও রয়েছেন আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, ইরেশ যাকের, শ্রেয়া সর্বজয়া যাকের এবং এশিয়াটিক এমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস হাসান নেভিল। এখানেও ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের পরপর আসাদুজ্জামান নূরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে সারা যাকেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। আসাদুজ্জামান নূর এই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ থেকেও অব্যাহতিপ্রাপ্ত হন।
এ ছাড়া এশিয়াটিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত জনসংযোগ সেবাদানকারী এজেন্সি হিসেবে দুটো এজেন্সির নাম উল্লেখ করেন মোরশেদ আলম। এগুলো হচ্ছে ফোরথট পিআর এবং ব্ল্যাকবোর্ড পিআর। এই দুটি জনসংযোগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ইকরাম মঈন চৌধুরী, যার হাতে রয়েছে কোম্পানি দুটির মাইনরিটি শেয়ার। এখানেও মালিকানায় রয়েছেন একই মালিকরা যেমন আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, ইরেশ যাকের, শ্রেয়া সর্বজয়া যাকের প্রমুখ।
এই কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান পদ থেকেও আসাদুজ্জামান নূরকে সরিয়ে সারা যাকেরকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছিল ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর পর। আসাদুজ্জামান নূর পরিচালনা পর্ষদ থেকেও অব্যাহতিপ্রাপ্ত হন এবং শুধু কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আছেন এখন।
বাংলাদেশের বাইরে আরব আমিরাতে বা অন্য কোনো দেশে এশিয়াটিক গ্রুপের মালিকানাধীন কোনো কোম্পানি কার্যকর আছে কিনা জানতে চাইলে মোরশেদ আলম বলেন, এ বিষয়ে তিনি পুরোপুরি অবগত নন। এফিলিয়েট এজেন্সি হিসেবে প্রিন্সিপালগুলোকে রয়্যালটি বা ফি হিসেবে অর্থ পরিশোধ করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা অডিট সাক্ষেপে নিয়মিত রয়্যালটি বাবদ অর্থ পরিশোধ করেন তাদের সংশ্লিষ্ট প্রিন্সিপালকে। কীভাবে সেই অর্থ পরিশোধ করেনÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে প্রচলিত আইনেই তারা অর্থ পরিশোধ করেন।
কালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞাপন নির্মাণ সংস্থা হিসেবে ইস্ট এশিয়াটিক লিমিটেড নামে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে। কালের কণ্ঠ উল্লেখ না করলেও জানা যায়, এটি অবাঙালি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল।
এর আগে থেকেই করাচিতে এশিয়াটিকের হেড অফিসে কপিরাইটার হিসেবে চাকরি করতেন আলী যাকের। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকলীন সরকার এর মালিকানা নিয়ে নেয়। এ সময় আলী যাকের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইস্ট এশিয়াটিক লিমিটেডে। এরপর সরকার প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে দিলে আলী যাকের প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার হন।
১৯৯৪ সালে ইস্ট এশিয়াটিক নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড। আন্তর্জাতিক কোনো বিজ্ঞাপন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানও হচ্ছে এশিয়াটিক।
/প্রতিবেদনটি স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি বিএমডিবি। তবে তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হলো