‘ধর’ : ‘অশ্লীল’ যুগের স্ল্যাং ডিসকোর্স
বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসকে আপনি চাইলে পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে পাঠ করতে পারেন। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসের মতো এরও আছে প্রাচীন, মধ্যযুগ, আধুনিক এবং উত্তারধুনিক যুগের কালভাগ। পৃথিবীর ইতিহাসের মতোই বাংলা সিনেমার একটি যুগকে চিহ্নিত করতে পারেন ‘অন্ধকার’ যুগ হিসেবে। এবার আমার মতো আপনিও প্রশ্ন রাখতে পারেন অন্ধকার যুগ আসলে কতটা অন্ধকার? মানে হরদরে আমরা যে মধ্যযুগকে অন্ধকার এবং বর্বর সময়ে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনি তা আসলে কতটুকু সত্য?
মূলত ইউরেপীয়ান এনলাইটনেমন্ট নিজেকে আলোকিত করার স্বার্থে সব অন্ধকার মধ্যযুগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ এর ভিতর সত্য খুব কমই আছে। আমাদের কলোনিয়াল মনও এনলাইটমেন্টের ধারণাকে বিনা প্রশ্নে এমন মিথ্যা মাথা পেতে নিয়েছে। মধ্যযুগও আমাদের এমন কিছু দিয়েছে যা সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। যে আধুনিকের পক্ষে এত সাফাই গাওয়া হচ্ছে সেও দুটি বিশ্বযুদ্ধের রাজসাক্ষী। যাই হোক সে আলোচনা ভিন্ন, যদিও আমাদের উদ্দিষ্ট থেকে আরো একটি ভিন্ন বিষয় দিয়ে আলাপটা শুরু করবো।
২.
একইভাবে বাংলা সিনেমাতেও একটা সময় মধ্যযুগ এসেছিলো। সেইটা আমরা বাংলা সিনেমার ‘অশ্লীলতা’ পর্ব বলে চিহ্নিত করি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘অশ্লীলতা’র সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা কী? নিশ্চয় অশ্লীলতার দেশ-কাল নিরেপক্ষ কোন সংজ্ঞা এখনো তৈরি হয় নাই। তবে এই ছবিগুলো আসলে একধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছিলো। যেখানে শরীরী প্রোপাগান্ডাটাই মূখ্য হয়ে উঠে। যা হলমুখি দর্শককে অন্যদিকে সরিয়ে দিয়েছিলো। তবে এইসব সিনেমা গণবিচ্ছিন্ন ছিলোনা মোটেই। একটা শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারা হলে গিয়েই এসব ছবি দেখেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত রুচি শুরু থেকেই এই ছবিগুলোকে আগাগোড়া বর্জন করা করেছে এবং সেইসাথে এই ছবিগুলোর বিপক্ষে একধরনের মৌন জিহাদও ঘোষণা করেছিলো। মধ্যবিত্ত হলে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলো। তবে তাতে লাভ কিছু হয়নি। ছবি নির্মাণ হয়েছে দেদারসে।
একশ্রেণীর দর্শক বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ এই ছবিগুলোর ভোক্তা হয়ে উঠে, এমনকি মধ্যবিত্তের ছোট একটা অংশও গোপনে তাদের সঙ্গী হয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি বরাবরই দুর্বোধ্য ও অনিনের্ণয়। এই ছবিগুলোর উত্থানের প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতাকে কোনরূপ আমলে না নিয়ে উল্টো খিস্তি করতে করতে তারা হলে যাওয়ায় বন্ধ করে দিলো। অথচ দরকার ছিলো এইসব ছবির একটা ক্রিটিক্যাল পাঠ। কোন সমাজ-বাস্তবতায় এই ছবিগুলোর বাজার তৈরি হচ্ছে তার কারণগুলো পরখ করে নেয়া, আফসোস তেমন কিছুই হয়নি। যা হয়েছে তাতে সব দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশি সিনেমা এবং তার বাজার। অবশ্য ‘অশ্লীল’ ছবিগুলোকে যে মধ্যবিত্তের রুচি থেকে দূরবর্তী ব্যাপার-স্যাপার ভাবা হচ্ছে তাকে সন্দেহের উর্ধ্বে রাখা যায়না। ইউটিউবে সেসব ‘অশ্লীল’ ছবির হিট দেখলে ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কেবল মাত্র লাখ লাখ নিম্নরুচির মানুষ ইউটিউবে এই ছবিগুলো দেখছে ব্যাপারটা তেমন না মনে হয়। এখানে মধ্যবিত্তসহ অন্যান্য শ্রেণীরও ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। যা তারা খোলামেলাভাবে দেখতে পারেনি, তা ফোন কিংবা ল্যাপটপে বসে দেখে নিচ্ছে।
এই আলাপটি আমরা এখানে শেষ করতে পারি। তবে উপরোক্ত আলাপ নিশ্চিতভাবেই বৃহৎ আলাপের দাবি রাখে। কিন্তু আমি মূলত ‘ধর’ সিনেমা নিয়ে কিছু কথা বলবো। সেদিকেই বরং যাওয়া যাক। ‘অশ্লীলতা’ যুগে নির্মিত এই ছবিটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় এই ছবি নিয়ে যাবতীয় আলাপের অবতারণা। উপরের বক্তটাও সে গ্রাউন্ডকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে দেয়া। সেইসাথে নিজের সাথেও একটা বোঝাপড়া করে নেয়া।
৩.
আগেই বলেছি আমাদের আলাপটা ‘ধর’ সিনেমাটা নিয়ে। অশ্লীলতা যুগে নির্মিত ছবিগুলো মধ্যে আমার মতে গুরুত্বপূর্ণ একটা ছবি। কিন্তু ছবিটিও অশ্লীলতার ট্যাগ খেয়ে সেসময়ের বাকি ছবিগুলোর মতো চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়া সেই কঙ্কালসার মুভিটি একটু খতিয়ে দেখা হবে। কাজী হায়াৎ নির্মিত এই ছবিতেও যথারীতি মূল দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মান্না ও ডিপজল জুটি।
কাজী হায়াতের অন্যান্য সামাজিক সচেতনতা নির্ভর ছবিগুলোর মতো এই ছবিতেও তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও অপরাধমূলক দিকগুলোর প্রতি আঙুল তুলেছেন। পুরো ছবিতে মান্না নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘জাওরা’ হিসেবে। ‘শুদ্ধ’ ভাষায় যাকে বলে ‘জারজ’। তবে এই ‘জাওরা’ হওয়ার মধ্যে মান্না নিজে কোনো অসম্মান বোধ করেননি। শুরুতে উস্তাদ ডিপজলের কাছে মান্না যেভাকে নিজেকে পরিচয় করিয়েছে তা বাংলা চলচ্চিত্রের ডিসকোর্সে বিরল এক ঘটনা। ডিপজল যখন খানকির পোলা সম্বোধন করে তার পরিচয় জানতে চায়; তখন মান্না উত্তর ছিলো, খানকির পোলাটাই তার পরিচয়। এমন বোল্ডলি নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করে পুরো ছবিটা জমিয়ে দিয়েছেন কাজী হায়াত। এই ছবিকে আলোচনার বিষয় হিসেবে নেয়ার অন্যতম কারণ এই ছবির ‘গালি’। স্ল্যাংয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। তবে গালিগুলো শুনে একবারও এই গালিগুলো আরোপিত বলে মনে হয়নি। এমন গালির ব্যবহার নিম্নবিত্তের মাঝে প্রচলিত। তবে এই গালিগুলো আমাকে গ্রামের কথা আলাদাভাবে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়রা তার মাকেও খানকি বলে গালি দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গালির কেন্দ্রে সবসময় নারীদেরই রাখা হয়। নারীর সতীত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটাই এখানে গালি হিসেবে বিবেচিত হয়। সে আলাপটা অন্য। তবে আমি গ্রামের গালির যে ব্যবহার তাকে একটু অন্যভাবে দেখতে চাই। এখানে সিগনিফায়ার সবসময় প্রকৃত অর্থকে সিগনিফাইড করেনা। অর্থ্যাৎ শব্দ এবং তার পিছনের অর্থ এক নয়। গালিটা এখানে রাগ, ক্রোধ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই বেরিয়ে আসে। তবে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এসব গালিকে তার রুচি থেকে দূরবর্তী বিষয় হিসেবেই চিন্তা করে। যেমন গ্রামে আমার বয়সী শতভাগ ছেলেমেয়েরা তার মাকে অবলীলায় ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। যা আমাদের শিক্ষিত সমাজের দূরবর্তী কল্পনাতেও আসেনা। বলা বাহুল্য এইসব সম্বোধন সম্পর্কের গভীরতায় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনা।
অনেক আগে আমি একবার দাদু সম্পর্কিত গ্রামের এক বৃদ্ধ স্কুল শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম, কেনো ওরা মাকে তুই বলে সম্বোধন করে? তিনি বলেছিলেন, আপনি কিংবা তুমির চেয়ে তুই অনেক বেশি আপন ডাক। যদিও তার এই যুক্তির মধ্যে ফাঁক আছে, কিন্তু আবেগটা যথার্থই ছিলো। যাই হোক, এসব কথা এজন্য বলা যে ‘ধর’ ছবিতেও মান্না এবং ডিপজল যে হারে ‘স্ল্যাং’ ইউজ করেছে তা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের কান গরম করে দিতে যথেষ্ট। তবে আপনি যদি মনযোগ দিয়ে এই ছবি দেখেন তবে গালিগুলো ছবির মেজাজের সাথে একবারের জন্যও অপ্রাসঙ্গিক মনে হবেনা। বরং মনে হয়েছে, আরে এভাবেই ত তার গালি দেয়ার কথা। এই গালিগুলো মোটেই আরোপিত কিংবা আপত্তিকর কিছু মনে হয়নি। যখন নায়িকার সাথে দেখা করতে গিয়ে মান্না যখন বলে, ‘উস্তাদের হোগাও মারি না।’। তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি এটা ‘অশ্লীল’ কিছু।
এই ছবিতে মান্না একজন পিতা-মাতাহীন, ঘরহীন স্ট্রিট চিল্ড্রেন থেকে বড় মাস্তান হয়ে উঠা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যার নিজের কোন ঘর নেই। সে পকেটেই তার সমস্ত ঘর-সংসার নিয়ে চলাফেরা করে। কথায় কথায় মানুষ খুন করার মতো পাগলামি তার আছে। নিজের পরিচয় নিয়ে তার মধ্যে দুঃখবোধ আছে, সমাজের প্রতি ক্রোধ আছে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ তার বাবা কিংবা মায়ের প্রতি প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তার উদ্দিষ্ট অপরাধী হলো, এই সমাজ কাঠামো। এমনকি তার এই পরিচয় নিয়ে সে মোটেই লজ্জিত না। সে যখন ডিপজলকে বলে, তার মা পাগলী ছিলো। অনেকেই তার সাথে মেলামেশা করেছে। কে বলতে পারে, তার মধ্যে উস্তাদও (ডিপজল) থাকতে পারেন। তার এই বলার মধ্যে ক্ষোভের চেয়ে সমাজের প্রতি কটাক্ষটাই বেশি ছিলো। এই কটাক্ষ লক্ষ্য করা গেছে সিনেমার পরতে পরতে।
আরেক জায়গায় মন্ত্রীর সাথে দেখা করার পর ডিপজলকে মান্না জিজ্ঞেস করে ‘ওস্তাদ ঐ লোক আপনার ওস্তাদ?’ ডিপজল বলে ‘হ, উনি আমার ওস্তাদ’, মান্না বলে ‘গোয়া মারা’ ডিপজল বলে ‘কি কইতে চাস?’ মান্না বলে ‘আপনি আমার ওস্তাদ, আপনি হইলেন এক গাঁজাখোর, আমি হইলাম এক জাউরা, আর আপনার ওস্তাদ হইলো মন্ত্রী, তাইলে তো দেশের গোয়া মারা’। এছাড়া ডিপজলও যথারীতি ভিলেন হিসেবে তার সেরাটাই ঢেলে দিয়েছে। গালাগালিতে সিদ্ধহস্ত এই ভিলেন এই ছবিতেও স্ল্যাং ইউজে কোন কমতি রাখেননি।
এই ছবির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সে সময়ের শরীর প্রদর্শনের রমরমা সময়ে এই ছবিতে ভিজুয়্যাল ‘অশ্লীলতা’র তেমন কোন উপস্থিতিই ছিলোনা। এই ছবিতে ডিপজলের রক্ষিতা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা। ববিতা ও তার বোন একা মূলত বিহারী। শেষ দৃশ্যে এই বিহারীদের পক্ষে বলতে গিয়ে মান্না বলেন, এদের কোন দেশ নেয়, এরা কোন জায়গায় বিহারি, কোন জায়গায় রিফিউজি আবার কোন জায়গায় মহাজের। মানুষ হিসেবে ওদের কোন জায়গায় পরিচয় হয় নাই। সেইসাথে আরো একজন অপূর্ব (ছবিতে মান্নার নাম) জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়ায় কিভাবে ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং রাজনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে তার দিকে আঙুল তুলেছে এই ছবি। এই ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্র হচ্ছে কবি ও মন্ত্রীর পিএস। এ দুজন ছবির বিভিন্ন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ওয়ান লাইনারগুলো থ্রু করেছেন। তারাই মূলত এই ছবিতে ইন্টারপ্রিটারের কাজ করেছেন। সেইসাথে ছবির মোরাল গ্রাউন্ডগুলোও তৈরি করে দিয়েছেন। বিশেষ করে মান্না ‘অপূর্ব’ নামটি দেয়ার পিছনে কবির যে যুক্তি তা বেশ অভিনব। আরেক জায়গায় পিএস মন্ত্রীকে বলেন, অপূর্ব অন্য ধাঁচের। সে হয়তো মন্ত্রীর মতোই জ্ঞানী কোনো লোকের কর্মের ফল। এভাবে অনেক জায়গায় এই দুজন ছবির টিকা-ভাষ্যগুলো দিয়েছেন।
সবমিলিয়ে এই ছবি সমসাময়য়িক রাজনীতি এবং সামাজিক স্থলনের একটি ওপেন টেক্সট। যা হয়তো আরো দশটি সাধারণ বাংলা সিনেমার চেয়ে আলাদা কিছু বলে নাই। কিন্তু সে একই কথাটা এখানে কাজী হায়াত ভদ্রলোকের ভাষায় বলেননি কিংবা বলতে চান নি। কিন্তু যে ভাষাতে বলেছেন তা আপনাকে কান খাড়া করেই শুনতে হবে।
লেখাটি ‘অন্তর্জাল ডটকম’য়ে পূর্বে প্রকাশিত