স্মরণে সংগীতের মহাজননতুনদের ভরসা আলাউদ্দিন আলী এবং দারাশিকোর সঙ্গে জুটি
শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিও। ৪০ জন যন্ত্রশিল্পী প্রস্তুত। নূর হোসেন বলাই পরিচালিত ইন্সপেক্টর ছবির একটি গান রেকর্ড হবে। রেকর্ডিং পর্যবেক্ষণে চলে এসেছেন সত্য সাহা, আলম খান, রুনা লায়লা, সুভাষ দত্ত, মিতাসহ বেশ কজন স্বনামধন্য শিল্পী। সব দেখে রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন তরুণ কুমার বিশ্বজিৎ। ভয়ে ভয়ে তিনি বের হয়ে যান রেকর্ডিং কক্ষ থেকে। দুরু দুরু বুকে আলাউদ্দিন আলীকে বলেন, ‘আলাউদ্দীন ভাই, আমি চট্টগ্রাম চলে যাব।’ শুনে আলাউদ্দিন আলী কুমার বিশ্বজিৎকে দিলেন এক থাপ্পড়। বকুনি দিয়ে বললেন, ‘এই গান তোমাকে গাইতেই হবে। নাহলে তোমার ক্যারিয়ার শেষ!’

আলাউদ্দিন আলী সেদিন মাথায় হাত বুলিয়ে বিশ্বজিৎকে রাজি করালেন জীবনের প্রথম প্লেব্যাকে। ‘আমরা দুজন’ গানটিতে সেদিন কুমার বিশ্বজিতের সহশিল্পী ছিলেন পাকিস্তানের খ্যাতিমান শিল্পী আলমগীর। বাংলাদেশের প্লেব্যাকে সেটি ছিল তাঁরও অভিষেক। এ রকম বহু ‘প্রথম’ প্লেব্যাক গায়কের অভিষেক হয় আলাউদ্দিন আলীর সুরে। শিল্পী খুঁজে তাঁদের কণ্ঠে নিজের সুর তুলে দিতেন এই সুরস্রষ্টা। যথাযথ কণ্ঠ পেয়ে কালকে জয় করে যাচ্ছে সেসব গান।
ধরা যাক ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ গানটির কথা। শিল্পী মাহমুদুন্নবীর মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া সামিনা চৌধুরীকে বাড়ি থেকে নিয়ে যান আলী। আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি ছবির টাইটেল গান গাইতে দেন তাঁকে। গাওয়ার পর দেখেন, শিশুকণ্ঠে গানটি জুতসই হচ্ছে না। পরে সামিনাকে দেওয়া হয় ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ গানটি। মাত্র এক টেকে সেটি ‘ওকে’ হয়।
বাবা-মায়ের সঙ্গে মাত্র ১৫ বছর বয়সে শিল্পী কনকচাঁপা গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আলীর বাড়িতে। নতুন একটি গান তুলতে হবে! সেই গানের এক জায়গায় ‘আপন কভু পর হয় না রে’-এর ‘হয় না রে’ কথাটা ঠিকমতো হচ্ছিল না। সুরকারের প্রয়াণের পর ফেসবুকে সেদিনের স্মৃতিচারণা করে কনকচাঁপা লিখেছেন, ‘দুনিয়ার কঠিন কঠিন সব গান শেখা মেয়ে আমি, এই ছোট একটা জায়গা হচ্ছিল না। আলী ভাই হাসিমুখে বলেছিলেন, “তোমার বাবা তোমাকে একটু বেশি শিখিয়ে ফেলেছেন। ছবির গানে এত কারুকাজের দরকার নেই। কারুকাজ ভুলে গানে আবেগ আনো”।’ আলীর সুরে শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত বিধাতা সিনেমা দিয়ে প্লেব্যাকে অভিষিক্ত হলেন কনকচাঁপা।
আমজাদ হোসেনের ভাত দে ছবিতে ‘কত কাঁদলাম কত গো সাধলাম’ তপন চৌধুরীর প্রথম প্লেব্যাক। পরে আলীর সুরে তাঁর নিশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি অডিও অ্যালবামটিও ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল। ভারতের শিল্পী মিতালী মুখার্জি প্রথম প্লেব্যাক করেন আলাউদ্দিন আলীর সংগীত পরিচালনায় স্বাক্ষী সিনেমায়। বিভিন্ন সময় তাঁর সুরে গাওয়া মিতালীর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘দিনে কী রাতে সাঁঝ প্রভাতে’, ‘আজ ফিরে না গেলেই কী নয়’, ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি’।
আলাউদ্দিন আলীর সুরে প্রথমবার প্লেব্যাক করেন জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু। ফিডব্যাক ও পরে ঢাকা ব্যান্ডের মাকসুদের প্রথম প্লেব্যাক ছিল ‘তোমাকে দেখলে একবার’ গানটি, অঞ্জলী ছবিতে। তরুণদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয় গানটি। জোর যার মুল্লুক তার সিনেমায় ব্যান্ড তারকা হাসান গেয়েছিলেন ‘একই আকাশ নীলে’ গানটি, সহশিল্পী ছিলেন মিতালী মুখার্জি। স্মৃতিচারণা করে হাসান বলেন, ‘শুধু আলী ভাইয়ের সম্মান রাখতে গানটি গেয়েছিলাম। তাঁকে খুব পছন্দ করতাম। সিনেমার গান করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।’ এ রকম আরও অনেক শিল্পী আছেন, যাঁদের প্রথম প্লেব্যাকের অভিজ্ঞতা হয়েছে আলাউদ্দীন আলীর সুরে। নতুন শিল্পীদের সুযোগ দেওয়া যেন ছিল তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।

২
আমাদের দেশে বেশকিছু জননন্দিত পরিচালক-সুরকার জুটি আছেন। তেমনই একটি জুটির কথা শোনা যাক।
সুরকার আলাউদ্দিনর সঙ্গে পরিচালক দারাশিকোর দারুণ এক গাঁটছড়া ছিল। খলঅভিনেতা দারাশিকো প্রযোজক-পরিচালক হিসেবেও সফল।
তার পরিচালনায় ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে আলাউদ্দিন আলী সুর করলেন ‘চোখের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে’। একশ’ বছর পরও এ গানের মরণ হবে না।
‘ফকির মজনু শাহ’ সে যুগের একটা ভাল ছবি। ছবিটা মুক্তির অনেকদিন পর এক সাক্ষাৎকারে দারাশিকো বলেছিলেন, ‘ফকির মজনু শাহ’র ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তাকে তিনটা মারদাঙ্গা বাণিজ্যিক ছবি বানাতে হয়েছিল।
‘ভাইবন্ধু’ ছবিতে আলাউদ্দিন আলী আবার দিলেন শ্রোতানন্দিত গান। এন্ড্রু কিশোর গাইলেন ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’। কাছাকাছি সময়ে ‘প্রেমকাহিনী’ ছবির জন্য আলাউদ্দিন আলী তৈরি করলেন একটা দুর্দান্ত প্রেমের গান ‘আমি যে প্রেমে পড়েছি আমি যে প্রাণে মরেছি’। কুমার বিশ্বজিৎ এই গান গেয়ে রাতারাতি ঢালিউড জয় করে ফেললেন।
দারাশিকোর মৃত্যু অবদি আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে তার যুক্তফ্রন্ট ছিল। শেষের দিকে তারা নীরিক্ষায় নামলেন। শ্রোতাদের ভিন্ন রুচির স্বাদ দিলেন। ‘অঞ্জলী’ ছবিতে মাকসুদ গাইলেন ‘তোমাকে দেখলে একবার মরিতে পারি শতবার’। ‘আজকের বাদশা’ ছবিতে প্রথমবারের মতো সিনেমার গান গাইলেন আইয়ুব বাচ্চু। দারাশিকোর ছেলে চিত্রনায়ক সুস্ময়ের লিপে গিয়েছিল গান দুটি। ‘অঞ্জলী’ ছবির গানটা তখন রীতিমতো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে গিয়েছিল!
২৪ ডিসেম্বর আলাউদ্দিন আলীর জন্মদিন। ২৬ ডিসেম্বর দারাশিকোর মৃত্যুদিন। এই তারিখগুলো প্রতি বছর এসে বলে যায়, শিল্পী চলে গেলেও তার সৃষ্টি থেকে যাবে। চোখের নজর ফুরালেও শিল্পের আবেদন ফুরায় না যে!






