Select Page

হাওয়া: সমুদ্র বাক্সে নয়জন মানুষ

হাওয়া: সমুদ্র বাক্সে নয়জন মানুষ

ভাবতেও পারিনি সমুদ্রের মতো বড় বাক্সে তিনি ‘হাওয়া‘ বানিয়ে ফেলবেন

চার্বাক দর্শন প্রথমেই আমাদের সামনে চড়াদাগে একটা প্রশ্ন রেখে যায়। ঈশ্বর হবে পিতৃতূল্য বা দেবীরূপে মাতৃতূল্য। কিন্তু তাহলে তিনি সন্তানদের এতো দূর্যোগ আর দুঃখ তিনি দেন কেন? কেনইবা তিনি এতো রুঢ় আর নির্মম?  তবে প্রকৃতিকে তো আমরা এতোটা সুপিরিয়র বানাই না। তাহলে ব্লেইমটা প্রকৃতিকে শিফট করিয়ে দিলে বোধহয় এই চাপটা একটু কমে। ঈশ্বরও ব্লেইম গেম থেকে মুক্তি পেলো। তবে চার্বাক দর্শন আরো একটু এগিয়ে ঈশ্বরকে তার সকল জাগতিক এবং ‘ঐশ্বরিক’ সকল কাজ থেকেই মুক্তি দিয়ে বসে। কিন্তু এতোসব প্রশ্ন আর কিঞ্চিৎ সমাধান রেখে এতো way way ahead of time কনসেপ্টটা হাজার বছরের জন্যে হাইবারনেশনে চলে গেলো। ব্যস, আমারও চার্বাক দর্শন নিয়ে জ্ঞ্যানের কলসি অলরেডি ঠনঠন করা শুরু করে দিয়েছে।

তবে প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই গেলো। ঈশ্বর কি দয়াময় নাকি ক্রোধ আর নির্মমতার মতো অতিবেশি মানবীয় ‘দোষগুলো’ও সমানভাবে ধারণ করেন? ঋগ্বেদে যেমন শিবকে রুদ্ররূপে পরিচয় করায়, পূরাণে কালিকে কিংবা ইজিপশিয়ান মিথলজি আইসিসকে। এই বাংলাদেশে জঙ্গল পরিস্কার করতে করতে আর সাপ-খোপের সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিজের বসতিখোঁজা চন্ডালরাও আরেক দেবীকে খুব আপন করে নেয়, মনসা। মনসামঙ্গলের মতো কাব্যে এই মনসা যেন অনেক বেশি নির্মম। শিবভক্ত চাঁদ সওদাগরের কাছে পূজা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হবার পর ক্রোধ, নির্মমতা আর প্রতিশোধের মাঝেই ঘুরপাক খেতে থাকে চরিত্রটি।

বাংলায় বক্স ফিল্ম শেষ কবে হয়েছে জানি না। তবে আগাথা ক্রিস্টির গল্প থেকে মনে হয় কোন একটা ছবি হয়েছিল কয়েক বছর আগে, দেখা হয়নি আর নামটাও মনে পড়ছে না। অন্যদিকে মেজবাউর রহমান সুমন বিজ্ঞাপনে পড়ে থেকে এতোকাল টাকাটুকা কামিয়ে যখন আবার ফিকশন বানাতে নেমেছেন, ঘোষণার পর থেকেই ‘হাওয়া’ নিয়ে আগ্রহের পারদ চড়াটা স্বাভাবিক। শুনেছিলাম যে তিনি সমুদ্রে বানাচ্ছেন ‘হাওয়া’। কিন্তু ভাবতেও পারিনি যে সমুদ্রের মতো বড় বাক্সে একটা জেলে নৌকায় ৯ জন মানুষকে আটকিয়ে তিনি এই ছবিটা বানিয়ে ফেলবেন।

বক্সফিল্মে যেটা হয় আরকি, আপনার সামনে সারাক্ষণ ওই ক্যারেক্টারগুলোই ঘুরবে। তাই আপনাকে এদের মাঝে সাবপ্লট বানিয়ে, ডায়ালগ নিয়ে খেলেই দর্শককে বেধে রাখতে হবে। কিন্তু সুমন এতো বড় বাক্স চ্যুজ করে একটা অ্যাডভান্টেজ পেয়ে যান। বাক্সের যেখানেই ক্যামেরা তাক করেন, একটা ভয়ংকর সুন্দর ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট তৈরি হয়।

গল্পের শুরুটা হয় কিন্তু ডাঙ্গায়। কর্মব্যস্ত জেলে নৌকো ছাড়ার অপেক্ষায় আর পেছনে একজনের গলা যে এর আগে দুইবার এই দরিয়ায় ‘মইরা গ্যাছে’। অনেকটা দুবলার চরের ব্যস্ততা চারপাশে। এরপরই আটজন মাঝি আর হলভর্তি দর্শক নিয়ে যাত্রা শুরু চান মাঝির বোটের। ওহ স্যরি, এর মাঝে একজন মাঝি না, ইঞ্জিনরুম সামলায়, একরোখা আর ঘাড়ত্যাড়া ইব্রা। এর বাইরে নাগু, এজা, উরকেস, পারকেস আরো কে কে যেন। এরপর চুরি করে বেচা মাছের ভাগ নিয়ে ইব্রার সাথে এজার একটা তর্কাতর্কি এবং চানমাঝির বোটে একক কতৃত্বের আশায় ইব্রাকে মেরে দেয়ার ইচ্ছা। কিন্তু তখনি জালে ধরা দেয় একটা লাশ। বেঁচে উঠে হয় আমাদের গুলতি। ওই সামনের ঘরে থাকবে এই গুলতি। বোবা কিন্তু দেখেও যেতে পারে এই গুলতি আর তাই ইব্রাকে মারার ইচ্ছে কদিনের জন্যে পোস্টপন করে চান মাঝি। এরপর? এরপর চান মাঝিও কখন যেন আমাদের অজান্তে নিজের বিগত রাগ দমায় ফেলে আর গল্পকারও ভুলে যায় এই সাবপ্লটের কথা।

তবে ভুলে যাওয়াটা দোষের কিছু না। স্ক্রিনে যখন গুলতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কার আর কী মনে থাকে বলুন তো? একবার ‘quora’তে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিল, যে মনিকা বেলুচ্চিই দুনিয়ার সবচে সুন্দরী নারী কি না। আমি হলে উত্তরে কোন চিন্তা না করেই লিখে বসতাম – সহমত ভাই। তবে অন্য এক বেরসিক উত্তরে লেখেছিলো যে মনিকাকে সব মুভিতে পোট্রেই করা হয় সুন্দরীরূপে আর তাই আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডও এভাবেই ওকে এক্সেপ্ট করে নিয়েছে। তবে আমাদের এই জেলে নৌকোর মনিকাকে পরিচালক হিংসে করে বোবা বানিয়ে রাখলেও ভাগ্যিস চোখ বেধে রাখেনি। অনায়াসে কয়েকটা খুন করে ফেলতে পারে ওই চাহনি। Seduction – শব্দটাতো আমরে আমদানি করলাম এই সেদিন। কিন্তু আমাদের কামদেবের ডিউটি তো সেই আদিকাল থেকে চলছে। একটা ট্রয় জ্বালিয়ে দিতে পারে এই শুকনো কাঠের জেলে নৌকা আর এমনকি।

এভাবেই কতক্ষণ ডার্ক হিউমার, কতক্ষণ সস্তা হিউমার, হলভর্তি মানুষের সাথে লিপে ‘সাদা-সাদা কালা-কালা’ গাইতে গাইতে আমরা ইন্টারভালে যাই। ওহ বলতে ভুলে গেছিলাম। স্ক্রিনে গুলতির সাথে সমান তালে কম্পিট করে যাচ্ছিলো আরেকজন। বলা ভালো তিনি স্ক্রিনের বাইরে কিন্তু তার সৃষ্টি স্ক্রিনে। কামরুল হাসান খসরু৷ নোঙ্গরের সাথে গোপ্রোতে এক্সট্রিম ক্লোজ শট দেখে মুখ ‘হা’ হয়ে যায়নি এমন মানুষ হলে একজনও ছিলো বলে মনে হয় না। তারপর নড়েচড়ে বসে খেয়াল করতে চাইলাম প্রত্যেকটা ফ্রেম। সত্যি বলতে আমাদের চিরাচরিত ‘গোল্ডেন রেশিও’-এর বাইরে নতুন কিছু  নেই। কিন্তু চোখের সামনে শেষমেশ যা দেখছি অদ্ভুতরকম সুন্দর। শেষ কবে, স্যরি ‘কবে’ বাংলা ছবিতে এমন সিনেমাটোগ্রাফি দেখেছি আমি মনে করতে পারছি না। আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে রাশেদ শরীফ শোয়েব। মেঘদলের মতো শহুরে-নাগরিক ব্যান্ডে চিরকাল সুর করা শোয়েব জেলেনৌকোর মেজাজে সুর বানাবেন, কিন্তু আবার সেটা দেখাবেন শহুরে দর্শকদের। এই যে জেলে নৌকোর আবহ আর শহুরে নাগরিক কানের ইয়ার-ড্রামের মাঝখানের যে ক্রিটিকাল গ্যাপটা, সেটা বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছেন শোয়েব। কিন্তু রিপন নাথ ইদানিংকালে খুববেশি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের তলায় সংলাপ চাপা দেয়ার অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছেন৷ বাকি কাজটা দেখে অবহেলায় করেছেন বলতেও পারছি না। কিন্তু এটা কি কোন নতুন ফরম্যাট?  জানি না বাবা, আমার ছোট্ট মাথায় ধরেনি।

পর্দার সামনে চঞ্চল চৌধুরী বরাবরই প্রচন্ড স্বার্থপর, নিজের দিকে সবটা আলো টেনে নেন। এবার ফার্স্ট হাফে মনে হলো বাকিদের চান্স দিচ্ছেন, কিন্তু সেকেন্ড হাফে সেই চানমাঝির মাঝির নৌকায় নিজের কতৃত্বের মতো পর্দার দখলও নিয়ে নেন। চান মাঝির সাথে এই দখলের দৌড়ে আরো একজন কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যান, নাসিরুদ্দিন খান। ওনার একেকবার পর্দায় আসার পরে দর্শকদের শিষ আর রেসপন্স দেখে মনে হইলো ওয়েব সিরিজের এই নিউ ওয়েভ সত্যিই অনেক শক্তিমান অভিনেতাকে মঞ্চ থেকে মাসের কাছে টেনে এনেছে। বাকিদের মধ্যে শরীফুল রাজও বরাবরেই মতো অই একই একরোখা টাইপ চরিত্রে ঠিকঠাক। এবার যদি একটু অন্যকিছু করতো, তাহলে গালভরা প্রশংসাও কিছু করতে পারতাম। আর তুষি? আরে ভাই আমি আদ্ধেকটা টাইমতো ওই চোখই দেখছি, অভিনয় জাজ করবো কখন? আর এমনিতেও আমি একটু বায়াজড আছি। তাই ওকে নিয়ে মন্দ-সন্দ কিছু বলতে পারবো না।

অনেকে বলছে যে প্রযোজকের একটা খুব সাহসী বাজি এমন একটা প্রজেক্ট। আমার তা মনে হয় না। রিসেন্ট টাইমে কেন জানি বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের দিয়ে ছবি করা আমার সেইফ বাজি মনে হয়। ‘আয়নাবাজি’ থেকে ‘দেবী’, ছবি যেমনই হোক প্রমোশনে বাজিমাত করা যায়। কিন্তু তারা সবাই মাস ধরতে গিয়ে সবসময়ই কম্প্রোমাইজ করে গেছেন ছবির সাথে। কেউ কেউতো আবার মূল গল্পের বেসকে কবর দিয়ে যাকে-তাকে ভূত দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু এদিক দিয়ে সুমন প্রচন্ড বেশি অনেস্ট। ফার্স্ট হাফে কিছু সস্তা হিউমার হয়তো ছিলো, কিন্তু গল্পে আমি কম্প্রোমাইজ করতে দেখিনি। কিন্তু ২০১২ এর আগের সুমনকে অনেক মিস করেছি। এই সুমন টেকনিক্যালি অনেক সাউন্ড, তবে ওই সুমন কিন্তু চারপাশকে আরো অনেক নিবিড়ভাবে দেখতেন আর আমাদেরও দেখাতেন।

ওহ আচ্ছা, ইন্টারভ্যালে ছিলাম। তো এরপর যা হয়। কামদেবের একার খেলায় কিন্তু শেষ না। আদিম রিপু ক্লাবের বাকি মেম্বাররাও জয়েন করে সেকেন্ড হাফকে অনেক বেশি ফাস্ট ফেসড করে। হিংসা, লোভ, লড়াই, প্রতিশোধ কী ছিলো না সেখানে। ‘হাওয়া’র চাঁদ সওদাগরও কিন্তু গোয়ার, জেদী আর একরোখা। আর মনসাও প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। মনসার একা চাঁদ সওদাগরের উপর প্রতিশোধের কোপে কিন্তু পড়ে সপ্তডিঙ্গা মধুকরের সবাই। আর মনসার লোভ ছিলো ওই একটু পূজাইতো। কেঊ দেবীজ্ঞান করলে আত্মসমর্পণও করতে পারে বৈকি। আমাদের গল্পে কিন্তু যীশুও আছে। একা পুরো মানবজাতীর দায় নিজের কাঁধে নেয়। আসলে তাতে বাকিরা কি পাপমুক্ত হয়? ধর্মে হয় হয়তো, কিন্তু, ওহ, আমরা না চার্বাক দর্শনে ছিলাম?


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন