Select Page

রাজ্জাককেন্দ্রিক পনেরো সিনেমা

রাজ্জাককেন্দ্রিক পনেরো  সিনেমা

নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে কিছু ছবি তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ছবির গল্প, চরিত্রায়ণে তিনিই মুখ্য এবং তাঁকে কেন্দ্র করে গল্পে অন্যান্য চরিত্র এসেছে। এ ধরণের ছবিগুলোকে রাজ্জাককেন্দ্রিক ছবি বলা যায়। সেই ছবিগুলো নিয়েই আজকের আয়োজন।

১. বাবা কেন চাকর (১৯৯৭)
রাজ্জাক পরিচালিত ‘বাবা কেন চাকর’ যে কোনো দিক থেকেই রাজ্জাককেন্দ্রিক ছবিতে প্রথম স্থানে থাকবে। ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারহিট এ ছবিটি কালজয়ী হয়ে আছে। ছবির গল্পে চিরন্তন একটি অনভূতিকে তুলে ধরা হয়েছে। বাবা চরিত্রের রাজ্জাক তার শেষ জীবনে বড় ছেলের কাছে বোঝা হয়ে যায়। ছেলে মিঠুনের জন্য অফিসে খাবার নিয়ে গেলে একজন লোক মিঠুনের সামনেই রাজ্জাককে ‘চাকর’ বললে মিঠুন কিছুই বলে না। প্রচণ্ড কষ্টে রাজ্জাক অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। জীবনসঙ্গিনী ডলি জহুরকেও হারাতে হয়। বড় ছেলে অকৃতজ্ঞ হলেও ছোট ছেলে বাপ্পারাজ ও মেয়ে কাজল বাবা-মার দেখাশোনা করে। একজন বাবার জীবনের করুণ বাস্তবতার গল্পে অনেক বাবার জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়ার চিরন্তন আবেদনে ছবিটি কালজয়ী। রাজ্জাকের লিপে খালিদ হাসান মিলু-র কণ্ঠে ‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারো জীবন’ গানটিও কালজয়ী হয়ে আছে।

২. রংবাজ (১৯৭৩)
জহিরুল হক পরিচালিত ‘রংবাজ’ ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম অ্যাকশন ছবি। রাজ্জাকই রংবাজ চরিত্রের প্রধান অভিনেতা। তাঁকে ঘিরেই যাবতীয় ঘটনা ঘটতে থাকে ছবিতে। লোকাল ক্রাইমের সাথে রাজ্জাক বিভিন্নভাবে মিশে যান। তাঁকে জব্দ করতেও অনেকে দাঁড়িয়ে যায়। জসিমের সাথে রাজ্জাকের লড়াই হয়। কবরী ছিল রাজ্জাকের নায়িকা। তাদের লিপে ‘হৈ হৈ হৈ রঙ্গিলা’ গানটি জনপ্রিয়।

৩. অতিথি (১৯৭৩)
আজিজুর রহমান পরিচালিত এ ছবিতে রাজ্জাক অতিথি। তাঁর চরিত্রটি ছিল এমন যে তিনি সবার জন্য তাঁর জন্য যেন কেউ নয়। শাবানা তাঁকে ভাইয়ের মর্যাদা দেয়। আলমগীরের সাথে শাবানার প্রেম হয়। বাধা আসে। রাজ্জাক দায়িত্ব পালন করে। বাধা তার সামনে আসলেও নিজে সাহসের সাথে মোকাবেলা করে। নিজের কাছে নিজেই যেন তিনি অতিথি। খুব চমৎকার ছিল চরিত্রটি।

৪. বেঈমান (১৯৭৪)
‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই
মানুষ যদি মোরে নাই বলো
বেঈমান বলো বেঈমান’
কালজয়ী এ গানটি এ ছবিরই। রাজ্জাককে ঘিরে ছবির গল্প। পরিচালক রুহুল আমিন। ভুল বোঝার শিকার হওয়া মানুষের গল্প। স্থানান্তর হয় রাজ্জাকের এরপর তাঁকে খোঁজার পালা। কবরীর সাথে প্রেম হবার পর সুজাতাও রাজ্জাককে খুঁজে বের করে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাজ্জাক তখন কঠিন অসুখে আক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়। ছবির ফিনিশিং মর্মস্পর্শী ছিল।

৫. গুণ্ডা (১৯৭৬)
আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ছবি। একজন গুণ্ডার জীবনের স্রোত কিভাবে বদলে যায় সেটাই ছবির গল্প। প্রধান চরিত্রে রাজ্জাক এবং বিপরীতে কবরী। রাজ্জাককে পরিবর্তন করাতে ভূমিকা রাখে কবরী। কিন্তু তারা দুজনই খলিলের একটা ফাঁদে জড়িয়ে যায় এবং সেটাকে জয় করতে লড়াইয়ে নেমে পড়ে। সাদামাটা গল্পের ছবি হলেও রাজ্জাককে ঘিরেই ছবিটি আবর্তিত হয়েছে।

৬. পাগলা রাজা (১৯৭৮)
আজহারুল ইসলাম পরিচালিত রাজ্জাকের ব্যতিক্রমী ছবি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। দেশপ্রেমিক নেতা যেমন ছিল পাশাপাশি অসৎ নেতা ও দুরভিসন্ধিমূলক ব্যক্তিরও অভাব ছিল না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আদর্শ নেতা ও শাসনের একটা নমুনা স্যাটায়ারের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে। রাজ্জাক ছবির প্রধান চরিত্র। প্রজাদরদী রাজা তিনি, মানুষের সাথে মিশতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁকে ঘিরে তাঁরই মহলে ষড়যন্ত্র হয়। একসময় ষড়যন্ত্রকে দমন করে রাজা আবার তাঁর সাম্রাজ্য ফিরে পায়। প্রজাদের সাথে মেশার জন্য বিভিন্ন ছেলেমানুষি আচরণ করেন তিনি তাই তাকে ‘পাগলা রাজা’ বলা হয়। চরিত্রটি ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে খালি চোখে কিন্তু চেতনায় গভীর। রাজ্জাকের অনবদ্য অভিনয় ছবির প্রাণ। ছবিতে অলিভিয়া ও নূতনের অসাধারণ অভিনয়ও অসাধারণ ছিল।

৭. অশিক্ষিত (১৯৭৮)
‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ এ গানটি দিয়েই ছবিটি কালজয়ী হয়ে আছে। আজিজুর রহমান পরিচালিত ছবিটি ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ আন্দোলনের একটি পদক্ষেপ। বক্তব্যধর্মী ছবি। নায়করাজের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্যতম ছবি। ছবির গল্পে রাজ্জাক একজন গ্রাম্য পাহারাদার। টেলি সামাদের সাথে পরিচয় হবার পর রাজ্জাকের শহরে চাকরি করার ইচ্ছা হয়। পড়াশোনা করে নাম দস্তখত শেখার প্রয়োজন পড়ে। তখন গ্রামের ছেলে মাস্টার সুমনের কাছে পড়াশোনা করতে থাকেন তিনি। নাম দস্তখত করাও শিখে যান কিন্তু আড়তদার এটিএম শামসুজ্জামানের হাতে সুমন খুন হয় ঘটনাক্রমে। খুনের বিচারের জন্য সাক্ষীর দস্তখত নেবার প্রয়োজন পড়ে। সাক্ষীর খাতায় রাজ্জাক দস্তখত করেন আর কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ ছবির ‘আমি এক পাহারাদার’ এবং ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’ গান দুটিও সুপারহিট।

৮. মৌচোর (১৯৮১)
রাজ্জাক পরিচালিত ছবি। সুন্দরবনে চিত্রায়িত বাওয়ালিদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ছবির গল্প। রাজ্জাক কাজের সন্ধানে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রথমে চর দখল করতে গিয়ে আহত হয়। তখন ছবিতে তার নায়িকা কাজরী সেবা করে সুস্থ করে তোলে। ঋণশোধ করার জন্য মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবনে যাবার প্রস্তাব আসে। রাজ্জাক যাবার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু কাজরী তাঁকে জঙ্গলে ছাড়তে চায় না। শেষ পর্যন্ত যেতে হয়। বাঘের হাতে পড়ে রাজ্জাক মারা গেছেন খবর আসলে কাজরী পাগলের মতো হয়ে যায় এবং সুবিধাবাদী গোলাম মোস্তফা কাজরীকে বিয়ে করার ষড়যন্ত্র করে। রাজ্জাক ফিরে আসবে কিনা এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গল্পের ছবি ছিল।

৯. চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নির্মিত ছবি। চন্দ্রনাথের চরিত্রে রাজ্জাক ছিলেন। এটি তাঁর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্যতম ছবি। চন্দ্রনাথের জীবনে আচমকা প্রেম আসে এক সাধারণ মেয়েকে ভালো লাগার মাধ্যমে। তার সাথে বিয়ে হবার পর খানদানি পরিবারের কিছু বাধা এবং স্ত্রীর মায়ের পরিচয় নিয়ে সৃষ্ট সমস্যায় ছবির গল্প। একসময় সব ঠিক হয়ে যায় সন্তান আসার পর। চন্দ্রনাথের স্ত্রীর চরিত্রে দোয়েল অসাধারণ অভিনয় করেছে। এ ছবির ‘এই হৃদয়ে এত যে কথার কাঁপন’ গানটি কালজয়ী।

১০. চোর (১৯৮৫)
গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত খুব সাদামাটা গল্পের ছবি। চুরি করা পেশায় রাজ্জাক একসময় ধরা পড়ে যায়। নায়িকা সুচন্দা তাঁকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনে। তাদের সন্তান জাফর ইকবালের জন্ম ও তার বড় হবার পর রাজ্জাক-সুচন্দার জীবনে নতুন ক্রাইসিস আসে। সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় এবং একসময় তা ঠিকও হয়ে যায়।

১১. আওয়ারা (১৯৮৫)
কামাল আহমেদ পরিচালিত ছবি। রাজ্জাক এ ছবিতে একজন ভাসমান অপরাধী। চুক্তিতে বিভিন্ন কাজ করে। ছোটবেলায় মাকে চোখের সামনে খুন হতে দেখে খুনী খলিলকে ধরার মিশনে অপরাধী হয়ে ওঠে। একসময় শাবানা ও তার পরিবারের সাথে দেখা হয়ে যায়। শাবানা রাজ্জাককে ভালোবেসে ফেলে। সুচরিতাও রাজ্জাককে ভালোবাসত ছোটবেলা থেকে। ত্রিভুজ প্রেমের গল্পটি ছিল মূল গল্পের সাথে যুক্ত অন্য গল্প। ছবির শেষে রাজ্জাক তাঁর মায়ের খুনী খলিলকে খুঁজে পায় তাঁরই উর্ধ্বতন বস হিসেবে। ডিস্কোতে রাজ্জাকের লিপে ‘এই শহরে আমি যে এক আওয়ারা’ গানটি তাঁর নামভূমিকাকে তুলে ধরে। এছাড়া শাবানার লিপে ‘সুর ঝরা এই আলোর মেলায়’ গানটি ছবির কালজয়ী গান।

১২. রাজা মিস্ত্রী (১৯৮৯)
শফিকুর রহমান পরিচালিত ছবি। একজন মিস্ত্রীর জীবনের গল্পের ছবি। খুব সাদামাটা গল্পের হলেও অনেকের জীবনকে ছুঁয়ে যায় এ ছবিটি। রাজ্জাক প্রধান চরিত্র। মহল্লার সবার খোঁজখবর রাখেন রাজ্জাক। সবাই তাঁকে ভালোবাসে। বাপ্পারাজ থাকে ভাগ্নের চরিত্রে। বাপ্পারাজের বাবা হারিয়ে যাবার অনেকদিন পর ফিরে আসে লাশ হয়ে। রাজ্জাকের জীবনেও কিছু কষ্টের ঘটনা ঘটে। তাঁর জীবনে প্রেম নিয়ে একটা মর্মস্পর্শী পরিস্থিতি তৈরি হয়।

১৩. প্রফেসর (১৯৯২)
রাজ্জাক পরিচালিত ছবি। একজন প্রফেসরের জীবনের প্রেম ও পরিবারের গল্প নিয়ে নির্মিত ছবি। প্রফেসর রাজ্জাক, বিপরীতে ববিতা। রাজ্জাক-ববিতার ছেলে বাপ্পারাজ। ববিতার সাথে দূরত্ব তৈরি হলে বাপ্পার সাথে পরিচয় ঘটে না রাজ্জাকের এবং শেষে যথারীতি মিল হয়। এ ছবিতে ক্লাসরুমে মজার একটি ঘটনা আছে। ক্লাস নিতে গেলে রাজ্জাক যখন ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে যায় ডিম ছুঁড়ে মারে বাপ্পারাজ ও তার সহপাঠীরা। রাজ্জাক তাঁদেরকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর গায়ে ডিম লাগাতে পারবে না। তখন তারা ডিম ছুঁড়তে থাকে আর রাজ্জাক খপাখপ সব ডিম ধরে। তারপর নিজে সেসব ডিম ফিরিয়ে দেয়। বাপ্পারাজ, নাসির খানসহ অন্যান্য সহপাঠীদের গায়ে ডিম ভেঙে নাস্তানাবুদ অবস্থা করেন রাজ্জাক। সিকোয়েন্সটি মজার ছিল।

১৪. জন্মদাতা (১৯৯২)
গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান পরিচালিত ছবি। রাজ্জাক প্রধান চরিত্রে থাকে। ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর ছেলে। কাঞ্চনকে নিয়ে কিছু ঘটনা ঘটে ছবিতে এবং রাজ্জাকের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। জন্মদাতা পিতার কাছে কাঞ্চনকে ফিরে আসতে হয়। রাজ্জাক ছবির প্রাণ এবং বিপরীতে ফাল্গুনী আহমেদের অভিনয় খুব ভালো ছিল। কাঞ্চনের বিপরীতে ছিল চম্পা।

১৫. মিস্টার মওলা (১৯৯৩)
আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ছবি। একক নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের শেষ ছবি ছিল এটি। দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি একক নায়কের ভূমিকায় ছবি করেছিলেন যা আর কেউ পারেননি ঢালিউডে। এ ছবিটি সেই ধারায় তাঁর শেষ ছবি এবং এরপরে আর তাঁকে একক নায়কে দেখা যায়নি। ছবির গল্পটা প্রথমে ছিল ইন্টারেস্টিং তবে শেষের দিকে কিছুটা চেণ্ঞ্জ হয়। মওলা চরিত্রে রাজ্জাক খুব বোকা চরিত্রের থাকে। মা রওশন জামিল তাঁকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকে। হাঁস-মুরগির ডিম বেচতে তাদের পারমিশন লাগবে বলে লোকে তাঁর মনে ভয় ধরিয়ে দেয় এরপর হাঁস-মুরগির আক্রমণের শিকার হন রাজ্জাক। এভাবে মজার কিছু ঘটনা ঘটে। ঘটনাক্রমে মায়ের মৃত্যুর পর রাজ্জাক আত্মহত্যা করতে গেলে খলিলের গ্যাং-এ ঢুকে পড়েন রাজ্জাক। খলিল তাঁকে কাজে লাগাতে চায়। চুক্তিতে আসেন রাজ্জাক এবং অরুণা বিশ্বাসকে বোন বানানোর পর নতুন গল্প তৈরি হয়। সাদাসিধে রাজ্জাক একসময় সাহসী হয়ে ওঠেন। রাজ্জাকের বিপরীতে ছিল নূতন। নূতনের চরিত্রটি ছিল রাজ্জাকের সেক্রেটারির। ছবিটি খুবই উপভোগ্য।

রাজ্জাককেন্দ্রিক ছবির মধ্যে কালজয়ী ছবি যেমন আছে পাশাপাশি সাদামাটা গল্পের ছবিও আছে। কিন্তু নায়করাজ তাঁর ডেডিকেশনে শতভাগ সৎ। তাঁর চরিত্রের গুণে ছবি প্রাণ পেত। নায়করাজের এ ছবিগুলো তাঁকে স্মরণীয় এবং চর্চার মধ্যে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।


মন্তব্য করুন