
নামেই নয় কাজেও ‘তাণ্ডব’
কয়েক বছর আগেও আমরা চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ হতাশা প্রকাশ করে এসেছি। এখন সে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করেছে। ভালো কিছু প্রোডাকশন কাজ শুরু করার পর বড় বাজেটের ছবি আসছে। ঈদের বাজারে এর প্রভাব বড়ভাবেই পড়েছে। সেই প্রভাবের সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে সিনেমাটিক ইউনিভার্সের পথে মুগ্ধকর এক ছবি হয়ে সামনে এসেছে ‘তাণ্ডব’। রায়হান রাফির ক্লাস যে সবসময়
বেটার কিছুকে মিন করে তারই উদাহরণ হলো ‘তাণ্ডব’।

‘তাণ্ডব’ ছবি শুধু নামেই নয় কাজেও ‘তাণ্ডব’ হয়ে উঠেছে। শাব্দিক অর্থে ‘তাণ্ডব’ হলো প্রলয়ঙ্করী কোনো কিছু যা সবকিছু নিমিষেই শেষ করে দেয়। ঘূর্ণিঝড় এলে যেমন চোখের পলকে প্রকৃতিতে তাণ্ডব চলে। অন্যদিকে ‘তাণ্ডব’ নামে ভারতীয় এক ধরনের নৃত্য আছে যা নৃত্যগীতের সাথে উদযাপন করা হয় এবং বার্তা দেয়া হয় কোনো ভয়ঙ্কর কিছুর। শাকিব খানের এন্ট্রির পর ছবিতে নৃত্যগীতের সাথে সাইকো পরিবেশ তৈরি করে যে ভয়ঙ্কর কোনোকিছুর আভাস দেয়া হয়েছে সেটা ছবির নামের পাশাপাশি ব্যাকরণগত অর্থও যেন বজায় রেখেছে।
ছবির গল্প সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। যদি শাকিব খানের অতীতের ছবিগুলোর দিকে তাকাই সামাজিক বক্তব্যের ‘আজকের সমাজ, আজকের প্রতিবাদ, সিটি টেরর, গণদুশমন, খুনি শিকদার’ এমন ছবিগুলোর নাম বলা যাবে। ‘তাণ্ডব’ ছবিতে সে ধরনের বক্তব্য এসেছে যা সমাজের কালো দিকটাকে তুলে ধরেছে। তফাত শুধু এটাই সেসব ছবির সাথে এ ছবিটির স্টোরি টেলিং-এ তফাত আছে।
রায়হান রাফির কমপ্যাক্ট ডিরেকশনের দক্ষতা এত সূক্ষ্ম যে তিনি প্রতিটি চরিত্রকে প্রয়োজনীয় স্পেস দিতে সক্ষম। শাকিব খান থেকে শুরু করে সাবিলা নূর, জয়া আহসান, এফ এস নাঈম, আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত এবং স্পেশাল ক্যামিও সবাইকে প্রয়োজনীয় স্পেস দেয়া হয়েছে। এতে করে ছবিটি ওভারঅল গ্রেট পারফরম্যান্সের ছবি হয়ে উঠেছে।
শাকিব খানের পারফরম্যান্স বললে তার নিজের জায়গায় ওয়ান ম্যান আর্মি। তবে অন্যান্য ছবি থেকে তার এ ছবির পার্থক্য হচ্ছে ভয়েস কন্ট্রোলের মাধ্যমে পুরো ছবিতে নিজের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করা। এ প্রসঙ্গে মান্নার সাড়া জাগানো অ্যাকশন ছবি ‘আমি জেল থেকে বলছি’-র কথা বলা যায়। এ ছবিতে মান্না পুরো ছবিতে অন্য লেভেলের বডি ল্যাংগুয়েজে অভিনয় করে গেছে ভয়েস কন্ট্রোলের দুর্দান্ত শক্তিতে। শাকিব খানকে ‘তাণ্ডব’-এ ঠিক এই অ্যাঙ্গেলে অভিনয় করতে দেখা গেল। শাকিব খানের বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় চরিত্রে নিজেকে প্রমাণের যে চ্যালেঞ্জ নেয়ার মানসিকতার কথা আমরা বলি সেটি ‘তাণ্ডব’-এ পাওয়া গেল যা তাকে অন্য ছবির থেকে আলাদা করেছে। ‘টাইগার নাম্বার ওয়ান’ ছবির ইন্টারোগেশন সেলের অভিনয়ে কিছুটা এমন অভিনয় ছিল কিন্তু ‘তাণ্ডব’ একদমই আলাদা। পাওয়ারফুল অ্যাকশন সিনে ‘তুফান’-এর হাসপাতালের লং অপারেশন সিকোয়েন্সের সাথে ‘তাণ্ডব’-এও লং অ্যাকশন সিনে দেখা গেছে শাকিবকে এবং ম্যাডনেস টাইপের ফাইটিং ছিল। বডি ল্যাংগুয়েজ মারাত্মক।
জয়া আহসানের এ ছবিতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছে একটা শ্রেণি কিন্তু জয়ার অভিনয়ের যে ক্ষমতা তাতে শাকিব খানের চরিত্রটিকে পূর্ণতা দিতে জয়াই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। তার লুক, অভিনয়, টুইস্টের বিষয়গুলো জাস্ট প্রশংসনীয়। সাবিলা নূরের প্রথম ছবি হিসেবে স্ক্রিনটাইম কম হলেও ন্যাচারাল ছিল পারফরম্যান্স। আফজাল হোসেন, গাজী রাকায়েত, শহীদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকীসহ বাকি সব চরিত্রই নিজেদের ভূমিকায় দারুণ।

সিনেমাটিক ইউনিভার্সের যে বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা চলছে সেখানে দুজন সমসাময়িক নায়কের ক্যামিও ছবিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। একজন শেষের ১ মিনিটের ক্যামিওতে ক্লাইমেক্সের আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার সহজাত অসাধারণ অভিনয়ে অন্যজন মোটামুটি মিনিট বিশেকের ক্যামিওতে ভিন্ন লুক ও অভিনয়ে নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে। তাদের ক্যামিওতেই ‘তাণ্ডব’-এর দ্বিতীয় কিস্তির শক্তিশালী প্লটের আভাস সুস্পষ্ট।
গানের মধ্যে ‘লিচুর বাগান’ ইতোমধ্যে আলোচিত। এ গানের স্পেশালিটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অনেকে আইটেম সং মনে করলেও আদতে এটি রোমান্টিক+ক্লাসিকের সমন্বয়ে নির্মিত নতুনত্বের স্বাদ দেয়া গান। রোমান্টিক ট্র্যাকটিও ভালো ছিল।
ছবির বিজিএম ছিল রায়হান রাফির ছবিগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ এখন পর্যন্ত। বিজিএমের মধ্যে দর্শক হিসেবে শরীরের লোম দাঁড়ানোর মতো অনুভূতি ছিল। শাকিব খানের অ্যাকশনের পাশাপাশি ক্যামিও চরিত্রেও বিজিএমের ব্যবহার উচ্চমার্গীয়।
আমরা সিনেমাটিক ইউনিভার্সের মাধ্যমে যে নতুন দিনের চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছি তার প্রথম ধাপ হলো ‘তাণ্ডব’। এই রেফারেন্সের জন্য হলেও এ ছবি মাস্টওয়াচ।
রেটিং – ৮.৫/১০