Select Page

নিরন্তর : যে বাস্তব শেষ হয় না

নিরন্তর : যে বাস্তব শেষ হয় না

জীবনে পতিতা-র সাথে কখনো কথা বলেছেন?

তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। ঢাকা থেকে ক্লাস করি। ক্যাম্পাসের বাসে ছিল আসা-যাওয়া। একদিন আমার ফ্রেন্ডসহ জরুরি কাজ শেষ করে ঢাবি টিএসসি থেকে ফিরছি। ফেরার পথে যে দেরি হয়ে গেছে অনেক তা জানতাম না। আমার হাতঘড়িটা সমস্যা করছিল। ফ্রেন্ডকে বললাম ‘কটা বাজেরে।’ ও বলল ‘রাত প্রায় এগারোটা।’ ভয় পেয়ে গেলাম খানিকটা। ও ছিল খুব সাহসী। ঘরে-বাইরে তেমন কাউকে পরোয়া করত না। স্বাধীন ছিল খুব। তো আমরা গাড়িঘোড়াও পাচ্ছিলাম না। ওর মিরপুর যাওয়া দরকার আমার শ্যামলী। হেঁটেই রওনা দিলাম। আসাদ গেটের যে রাস্তাটা সংসদ ভবন হয়ে খামারবাড়ি গেল সেখানে মোড়ে আসতেই কয়েকটা মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ফ্রেন্ড বলল
– ‘পতিতার সাথে কখনো কথা বলছিস?’
– তোর কি মাথা খারাপ? ওদের ভয় পাই
– মানে? ওরা কি মানুষ না?
– মানুষ না সেটা কখন বললাম?
– আয় কথা বলি, ওদের লাইফটা বোঝার চেষ্টা করি।

আমার মাথায় তখন শুধুই বাসার চিন্তা। এতরাত পর্যন্ত বাসার বাইরে তখন থাকাটা চিন্তার বাইরে। ফ্রেন্ড আর মানল না। ওর জোরাজুরিতে যেতে হলো। গেলাম একটা শর্তে। কথা যা হবে ফ্রেন্ড বলবে আমি না। তাই হলো। ও যায়, আমি ওর পিছু পিছু যাই। তারপর একজনকে ডেকে বলল ‘আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করেন। মহিলা বলল
– ‘বলেন কি জানতে চান।’
– না মানে, আপনার জীবনের ঘটনা জানতে চাই। কিভাবে এ পেশায় এলেন।

তারপর যা বলল মহিলা আমরা দুজনই কিছুটা আশ্চর্য হলাম। আমি তখনও ভয় পাচ্ছি। মহিলা বলল
– দেখেন, এসব বলতে গেলে টাইম নষ্ট হবে সেজন্য এর বিল দিতে হবে।
– কত?
– পঞ্চাশ টাকা দেন

নগদ আদায়ের পরে শুরু করল ঘটনা বর্ণনা। কী যে মর্মান্তিক! মহিলার জীবন গোছালো ছিল কিন্তু স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করাতে আর সে খারাপ পথে পা বাড়ায় কারণ মা-বাবাও নেয়নি লোকজনের কানাঘুষার চাপে। মহিলা গার্মেন্টসে কাজ করত কিন্তু দুই ছেলেমেয়ের খরচ যোগাতে পারত না। পরে ছেলেমেয়েদের এতিমখানায় দেয় আর নিজে এ পেশায় আসে।

শোনার পরে বাসা এসে গেল আমার। আমি চলে এলাম, ও গেল মিরপুর। ও যাবার আগে একটা কথা বলল  ‘শোন, এরা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে অবহেলিত জাতি। এদের কখনো ছোট করে দেখিস না। ভিক্ষুককে ভিক্ষা না দিলেও এরা টাকা চাইলে দিস।’ ওর কথাটা আজও ভু্লিনি।

পতিতার জীবন বাস্তবতা বোঝার জন্য সেই থেকে অনেক সিনেমা দেখেছি। এলিজাবেথ টেইলরের ‘বাটারফিল্ড এইট’ দেখে থ হয়েছিলাম যেখানে বিবাহিত এক পুরুষের প্রেমে পড়ে করুণ বাস্তবতায় পড়ে পতিতাটি।পতিতার চরিত্রে ছিলেন টেইলর। অস্কার পেয়েছিল সিনেমাটি।কলকাতার বাংলা সিনেমা ‘রাতপরীর রূপকথা’ দেখে চোখ ভিজে গিয়েছিল। সাহসী অভিনয় করেছিল ইন্দানী হালদার…….. বিদেশি সিনেমা দেখে অনুভূতি যত পজেটিভ হোক না কেন আমার দেশের ‘নিরন্তর‘ সিনেমাটি দেখে বিস্মিত হয়েছি সব থেকে বেশি। মাস্টারপিস সিনেমা। হুমায়ূন আহমেদের ‘জনম জনম’ উপন্যাস থেকে নির্মাতা আবু সাইয়ীদ বানিয়েছেন। যাকে বলা হয় বাংলাদেশের ঋতুপর্ণ ঘোষ। আবু সাইয়ীদ তাঁর সিনেমার প্রধান ক্যারেক্টার প্লে-র জন্য শাবনূরকে বাছাই করেন। শাবনূর তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ অভিনয় দেখায়। কোনো তাড়াহুড়ো নেই একদম ঠাণ্ডা, বিষণ্ন, কুয়াশার মতো নীরব একটা মেয়ে যে তার পরিবার বাঁচাতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়।

সিনেমার অ্যাপ্লিকেশন, মেকিং, মেসেজ প্রদান এসব জরুরি বিষয়গুলো আবু সাইয়ীদ ইমোশনের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি গেঁথে দেন। সিনেমার শুরু থেকে শেষ ইমোশনকে কন্ট্রোল করেছেন আশ্চর্যভাবে। অনেককিছু বলার সুযোগ আছে কিন্তু এটাই সিনেমাটিকে মাস্টারপিস করেছে। তবে বলে রাখা দরকার ইমোশন ছিল যৌক্তিক ইমোশন। কিছু পয়েন্টে বলা যায় :

* শাবনূর পার্টির জন্য অপেক্ষা করে পেটের তাগিদে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় পার্টির খোঁজ দেয়। পার্টিতে যে কালচার থাকে তাকে প্রফেশনালি হ্যান্ডেল করতে হয়। শাবনূর সেটাই করে। শহীদুল আলম সাচ্চুর ঘরে শাবনূর সে প্রফেশনাল কাজটাই করে। মনোরণ্জনের জন্য নাচগান স্বাভাবিকভাবেই থাকে। মদের গ্লাসটা যেভাবে ধরে শাবনূর ওটা কোনো প্রফেশনাল আর্টিস্ট ছাড়া অসম্ভব। এক্সপ্রেশন অসাধারণ। সাচ্চুকে মদ খাওয়ানোর তালে তালে জয়ন্তর বেঁধে দেয়া সময়কেও ভাবতে হয় তার কারণ বাড়ি ফিরতে হবে। সময় অনুযায়ী শয্যাশঙ্গী হওয়া এবং টাকা উসুল প্রফেশনালিজমকে দেখায়।পতিতার কালচারে এটা খুব স্বাভাবিক।

* শাবনূরের ভাই লিটু আনামের অ্যাফেয়ার থেকে বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে যে মেয়েটি তাকে বরণ করে নেয় শাবনূর নিজেই। তারপর সমাজের নিয়ম মানতেই বিয়ে দেয়। সে মেয়ের সাথে পরিবারের সম্পর্কের অালাদা একটা দিক তুলে ধরা হয়। মেয়েটি খুব অাত্মসম্মানবোধসম্পন্ন।তাই লিটুর রেস্টুরেন্টের ব্যবসার টাকা যখন শাবনূর দেয় সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। বাঙালি মেয়েরা স্বামীকে স্বনির্ভর দেখতে চায়। শ্বাশুড়ীর সাথে তর্ক হয়। রান্নাঘরে গেলে ডলি জহুর বলে -‘তোমাকে রান্না করতে কে বলেছে?’
– বলতে হবে কেন, মা? নিজেই এসেছি।
– আমি কি তোমাকে বলেছি এসব করতে?
– এখন থেকে আমাদের তো একসাথেই থাকতে হবে, মা
– তুমি তো ভারি বদ মেয়ে
– আমি বদ না, আপনার ছেলেটা বদ
তর্ক আছে যার মধ্যে আছে যৌক্তিক ইমোশন।

* আমিরুল হক চৌধুরী অন্ধ জীবনে বাড়ির বারান্দায় বসে পায়ের শব্দ গোণে আর নিঃসঙ্গতার পূজারী হয়ে থাকে। তার অভিমান চাপা।তিনি সংসারের মানুষগুলোর ক্লাসিফিকেশন করেন। বলেন -‘ এ সংসারের মানুষ অগ্নিমানব, জলমানব।’ তার মনের মতো সবকিছু ঘটে না অথচ তিনি কর্তা বাড়ির।

* শাবনূরের সেতু পার হয়ে রাতের শহর দেখা বা বাসের জানালার মধ্যে হেলান দিয়ে শৈশবের ভয়াল দিন মনে পড়ে। সখীদের সাথে খেলতে গিয়ে ম. ম. মোর্শেদ যখন তার নরকের কীটের মতো চেহারাটা দেখায় আর লুঙ্গি তুলে পুরুষের ঘৃণ্যতা তুলে ধরে সেটা অন্য পুরুষের জন্য লজ্জা বয়ে আনে।শাবনূর এছাড়াও দেখে তার জীবনে আসা সব পুরুষের কামজ বীভৎস চেহারা। তার চোখ দুটো তখন অশ্রুময়।

* পার্টির সাথে চুক্তিতে জয়ন্ত ও শাবনূর যায় ক্লায়েন্টের বাসায়। শাবনূর তখন শয্যাশঙ্গী। সময় শেষ হলেও সেদিকে খেয়াল থাকে না ঐ ক্লায়েন্টের।তারপর জয়ন্ত সময় শেষ হয়েছে দেখে যাবার জন্য অস্থির কারণ দূরের পথ। ক্লায়েন্ট রেগেমেগে বন্দুকের মুখে জয়ন্তকে শাসায় – ‘এই শালা, গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। এদিকেও খাবি, ওদিকেও খাবি?’ পরে ট্যাক্সিতে জয়ন্ত বলে ‘এর নাম জীবন না। ভাবছি এসব ছেড়ে পান সিগারেটের দোকান দেব। তাও সম্মান পাব।’ বাস্তবতাটা মৌলিক এখানে।

* কাঞ্চনের স্ত্রী মারা যাবার আগে নিজের মেয়ের সাথে যে কথাগুলো বলে সেসব সহ্য করা কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়। শাবনূরকে পারিশ্রমিক দিয়ে যাবার ঘটনাটাও অদ্ভুত রকমের। মানুষের সাইকোলজি বিচিত্র কাঞ্চনের স্ত্রীর ক্যারেক্টারটি সেটাই বলে।

* ক্লাইমেক্সে এসে শাবনূরের মুখ থেকে আসে রিয়েলিটি ও নিঃসঙ্গতার চূড়ান্ত দর্শন। মা ডলি জহুরের হাত শাবনরের পিঠে পড়লে যে কথাগুলো আসে
– গায়ে হাত দিও না তো মা
– এত আদর করে হাত রাখি তুই এমন করিস কেন মা?
– গায়ে হাত দিলেই কেমন যেন পুরুষের হাত বলে মনে হয়

এখানেই বলা আছে সভ্যতার অন্যতম আদিম কামনা। যাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রাগৈতিহাসিক’ বলেন সেই আদিম কাম যার পুরুষ বৈশিষ্ট্য একাই একরকম। একজন প্রেমিক, স্বামী, খদ্দের এসবের তফাতটা বোঝা যায়। জানালায় অপলক অশ্রুসিক্ত শাবনূরের এক্সপ্রেশন তখন অতুলনীয়। মাস্টার আর্টিস্ট বলেই সম্ভব।

আবু সাইয়ীদ যে ‘নিরন্তর’-কে ইংরেজিতে ‘ forever flows’ বা ‘চিরায়ত স্রোত’ বলেন সে বাস্তবতা আজও শেষ হয়নি, হবেও না। কারণ শরীর বিসর্জন দিয়ে পরিবার টেকানো বা দায়িত্ব পালনের গল্প পৃথিবীতে বাড়ছে। এখন এটা প্রতিদিনের গল্প।

আর আবু সাইয়ীদ ও শাবনূর হয়ে গেছেন সেই প্রতিদিনের সেলুলয়েড সংগ্রামী।


মন্তব্য করুন