Select Page

রাজনৈতিক ক্ষমতার নেতিবাচক দলিল ‘পরাণ’

রাজনৈতিক ক্ষমতার নেতিবাচক দলিল ‘পরাণ’

বহু বছর পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহকে কানায় কানায় টানা তিন সপ্তাহ ধরে পরিপূর্ণ করে রেখেছে রায়হান রাফী পরিচালিত ‘পরাণ’, পাশাপাশি অবস্থানে আছে অনন্ত জলিল অভিনীত ‘দিন দ্য ডে’।

*স্পয়লার অ্যালার্ট: আলোচনার প্রয়োজনে ছবির কিছু গুরুত্বপূর্ণ টুইস্ট তুলে ধরা হয়েছে। পাঠক, যারা ‘পরাণ’ দেখেননি, এ ক্ষেত্রে সাবধানতা হিসেবে রিভিউটি এড়িয়ে যেতে পারেন।

‌‘পরাণ’ দর্শকের নজর কেড়ে নিয়েছে তার গল্পের কারণে; বছর দুই আগে বরগুনায় ঘটে যাওয়া ত্রিভূজ প্রেম কাহিনিকে ঘিরেই পরাণের গল্পের অবতারনা। তার ওপর আবার গল্পের মূল নায়িকা যেখানে নিজেই অপরাধী সেখানে এমন একটি স্ক্রিপ্ট যা কি-না প্রত্যেক দৃশ্যে একজন নারীর চরিত্রের দুর্বল অংশ ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে; এমন একটি সিনেমা দেখার জন্যে দর্শক মুখিয়ে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক।

বাস্তবে অপরাধী নারীটিকে আমরা মিডিয়াতে এসে নানা রকম অভিনয় করতে দেখেছি, কিন্তু দিন শেষে তিনি যে নিজের স্বামীর খুনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। তাই দর্শক পুরো সময় ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন, অনন্যা অর্থাৎ সেই অপরাধী নারীর শেষ পরিণতি কী হয় তাই দেখার জন্যে।

মূল ঘটনার সাথে পরাণের স্ক্রিপ্ট প্রথম দিকে মিলে গেলেও শেষে এসে যথেষ্ট বদলে যায়। আমার মতে, রায়হান রাফী শেষ দিকে এসে বেশ তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন। রোমানের ছোটবেলার বন্ধু নিজ হাতে তাকে বিরিয়ানি খাওয়ালো, তারপর একে একে গুলি করে মারলো কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রমোশনের জন্যে, এভাবে গল্পের ইতি টানাটা দর্শক হিসেবে আমার কাছে গোলমেলে ঠেকেছে, বাস্তবের নয়ন বন্ড যেভাবে পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছিল সেটাই বরং বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এরপরের দৃশ্যে দায়ের কোপে খুন করা সিফাতের লাশের পাশে নিজেরই খুনি রোমানের লাশ মর্গে দেখানো আরো বেশি অবিশ্বাস্য। কারণ ঘটনা দুটোর মাঝে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যেখানে শাহজাহান সৌরভ এবং রায়হান রাফীর লেখা চিত্রনাট্যে তিন সপ্তাহ উল্লেখ করা হয়েছে।

এই তিন সপ্তাহ তাহলে সিফাতের মতো নম্র ভদ্র শিক্ষক ছেলেটা মর্গে পড়ে ছিল কীভাবে! ওদিকে তার মৃত্যূর সঠিক বিচার চেয়ে আন্দোলন চলছিল ফেসবুকে রাস্তায়, সব জায়গায় কিন্তু তার দাফন অব্দি হয়নি।

‘পরাণ’ বাংলাদেশের দর্শক হিসেবে আমার পরাণ জুরিয়ে দিয়েছে তার অনবদ্য শৈল্পিক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মফস্বলে্র এলাকায়, ট্রেনের পাশে, কামরার ভেতরে, সবুজ গাছের ছায়ার মাঝে, খোলামাঠে, যখন যে দৃশ্য আসছিল প্রত্যেকটি চোখ জুরিয়ে দিচ্ছিল, মনে হয়েছে আমি রাজধানী শহরে নই, বসে আছি ঢাকা থেকে অনেক দূরে কোন ছোট্ট শহরে।

রোহান যেভাবে অনন্যাকে প্রপোজ করেছে,তার বারান্দায় বসে তাকে ভয় দেখিয়েছে, মাকে যেভাবে সিফাত বিয়ের জন্যে চাপ দিয়েছে, পরীক্ষায় বার বার ফেল করাতে অনন্যার চাকরিজীবী বাবা যেভাবে বাড়ি থেকে বের করে দেবার জন্যে হুমকি দিয়েছে, পেনশানের টাকা থেকে মেয়ের জন্যে আলাদা করে কিছু টাকা রেখে দেওয়া— এই সবগুলো দৃশ্য মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে একেবারেই মিশে আছে। এই সিনেমার সংলাপ ছিল দারুণ সাবলীল, আরোপিত মনে হয়নি কখনো।

অনন্যা বিয়ের পর যখন সিফাতকে বলে, ‘আগের জীবন ভালো ছিল, যখন তখন ফুচকা খেতে যেতে পারতাম, ঘুরতে যেতাম’। দর্শক বুঝে নেয় একজন নারীর বিয়ের আগের সময় আর পরের সময়ের পার্থক্য। রাশেদ মামুন অপুর তোতলা উচ্চারণ সারাক্ষণ দর্শককে হাসাতে সক্ষম হয়েছে।

‘পরাণ’ রিলিজ হবার আগেই ‘চলো নিরালায়’ গানটি অনলাইনে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। নাভেদ পারভেজের পরিচালনায় সিনেমার প্রত্যেকটি গান ভীষণ শ্রুতিমধুর এবং অবশ্যই পুরো পরিবার নিয়ে দেখার মতো। রোমান্টিক দৃশ্যগুলোতে কোন আদিখ্যেতা নেই কোথাও, সাধারণ পোশাকে নায়ক-নায়িকা গানে উপস্থিত হয়েছেন, এটা দেখতে ভালো লেগেছে।

রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে ডেইজী আপা অর্থাৎ রোজী সিদ্দিকী যেমন পোশাকে মাতিয়েছেন তেমন ছিল তার সংলাপ ও দূর্দান্ত অভিনয়, তার হাতের তজবি দর্শককে ভাবিয়ে তুলেছে। তীক্ষ্ণ চাহনি ও জোরালো কণ্ঠের অনবদ্য অভিনয় দিয়ে রোজি সিদ্দিকী আবার বাংলা সিনেমায় আবির্ভূত হলেন। নারী খলনায়িকা হিসেবে তিনি যদি এ ধারা অব্যাহত রাখেন তাহলে একজন লেডি মিশা সওদাগর পাবে বাংলা চলচ্চিত্র; এ আমার বিশ্বাস।

চরিত্রায়ণের কথা যখন উঠলোই তাখন সবার আগে বলতে হয় শরিফুল রাজের কথা। আমি রাজ অভিনীত সব সিনেমা দেখে নিয়েছি আগেই, কিন্তু রোমানের রাজকে একেবারে চেনা যাচ্ছে না। রাজকে মনে হচ্ছে শহরের গলির মাস্তান, কথায় কথায় যারা ইভটিজিং করে, রাজ-রোমান কোনোভাবেই আলাদা করা যাচ্ছিল না। সংলাপ বলতে বলতে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়ানো, হাঁটার ভঙ্গিমায় ভিন্নতা, স্টাইলিস্ট বাইক চালানো, কথায় কথায় জিহবা বের করা, অনন্যার জন্যে আকুতি— সব মিলিয়ে দর্শকের পুরো নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে শরিফুল রাজ। রাজের নাম ২০২২ সালের চলচ্চিত্র পুরস্কারে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

অনন্যার মায়ের চরিত্রে শিল্পী সরকার অপু যেভাবে চিত্রায়ন করেছেন, সেখানে সব সময় মনে হয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরের একজন চিরচেনা মা; স্বামীর যে কোন সমস্যায় তিনি এক গ্লাস পানি এনে দেন, আসলে তার এটা ছাড়া আর কিছু করার নেই। পুলিশের ওসি চরিত্রে নাসিরুদ্দিন জমিয়ে দিয়েছেন, তবে তার জিন্সের প্যান্ট পরে থানার ভেতরে আবির্ভূত হওয়ার কারণ বুঝতে পারিনি।

অনন্যা চরিত্রে বিদ্যা সিনহা মিম ও সিফাত চরিত্রে ইয়াশ রোহান বেশ মানিয়ে গেছে। অনন্যার বাবা হিসেবে শহীদুজ্জামান সেলিম, সিফাতের মা হিসেবে মিলি বাশার সবাই যার যার জায়গায় দক্ষ ছিলেন।

পরাণের কাহিনী সবাই জানেন, সেটা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু পুরো পর্দা জুড়ে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের চ্যালা আর পুলিশদেরকে উপস্থাপন করা হয়েছে; তাতে মনে হয়েছে এ দেশে একজন সৎ অফিসার নেই বা একজন সৎ নেতা নেই। পরিস্থিতির চাপে পড়ে রোমান মাস্তান হয়ে গেছে, লিডারের হাতের ইশারায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে শাস্তি দিতে ব্যস্ত, এমন একটা চেইনের ভেতর কোন একজন নেতা বা প্রশাসনিক অফিসারকে একটু সহানুভূতিশীল দেখানোর প্রয়োজন ছিল বলে আমার মত। কারণ একটা সিনে্মা মানে একটা দলিল, বাংলা চলচ্চিত্রের দলিল,এই দলিলের কোন কোন অংশে যেন প্রশাসনের কিছু ইতিবাচক চেষ্টা থাকে এবং সেটা যেন দর্শকের নজরে বসে যায় সেই চেষ্টা রায়হান রাফী করতে পারতেন, তিনি তো মিন্নীর গল্প বা রোমানের গল্পের পেছনের পুরোটা জানতেন না। তাই তাদের চলার পথে সঠিক আলো দিতে পারতেন তেমন কেউ থাকাটা দরকার ছিল। একটি সিনেমায় শিক্ষক, নেতা, পুলিশ, বন্ধু সবাই খারাপ হয়ে থাকলো, এটা ভালো লাগেনি।

পরিশেষে, হল ভর্তি দর্শক যখন তৃপ্তির ঢেকুর নিচ্ছিলেন তখন একজন তরুণ বলে উঠলেন,‌ ‌‘দেখছিস, মেয়ে মানুষ; কী এরা! আর যাবি প্রেম করতে?’ সাথে সাথে অন্যান্য বন্ধুরাও তাল মেলালো আর মেলাবেই না কেন, এক মিন্নী ভালোবাসার নামে পুরো কলংক লেপে দিল। তাই অনন্যার প্রতি লোকের এতো ঘৃণা, এখানে সার্থক আমাদের লাক্স তারকা মিম।

আমার কেবল একটাই অভিমত, শুধুমাত্র নেগিটিভিটি তুলে ধরা যেন একটি চলচ্চিত্রের মূল্ লক্ষ্য না হয়। সিনেমা জীবনের কথা বলে— তাইতো ভালো ও মন্দের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ হয়ে সেলুলয়েডে ধরা দিক আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্যে বানানো বাংলা সিনেমা।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

পড়ার ফাঁকে যে টুকটাক লেখার অভ্যেস ছিল তা বন্ধুরা জানতো না।ক্লাশ নাইন থেকেই ছোট গল্প আর ছোট ছোট টূকরো কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম।প্রিয় কবি সৈয়দ শামসুল হক ও মহাদেব সাহা।কিন্তু ১৯৯৭ সালে প্রথম আর্টিকেল লিখলাম প্রথম আলোতে-“মেয়েদের নিজেস্ব কোন বাড়ি নেই”অনেক সাড়া পেলাম ।এরপর লিখলাম “সেনানিবাস এবং আমরা”।এখানটায় এসেই নাম বদলে হয়ে গেলাম-রোদেলা নীলা।রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজেকে একটু আড়ালে রাখাটা দরকার।তবে আমার সব শংকা দূর হয়ে গেল যখন দেশে এলো বাংলা ব্লগ.২০০৫ সাল থেকে কেবল রোদেলা হয়েই বিচরণ করছি সামহোয়ার ইন ব্লগ,প্রথম আলো ব্লগ,শব্দনীর ব্লগ,আমার ব্লগ ,ঘুড়ি ব্লগ এবং নক্ষত্র ব্লগে। আমার জন্ম ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৭ সালে।ঢাকার মিরপুরে,এখানেই আমার বেড়ে ওঠা,তবে পৈতৃক নিবাস কালিহাতী, টাঙ্গাঈলে।অংক নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি করলেও হিসেব নিকেশ কোন দিন বুঝিনি।তাই হয়তো ব্যক্তি জীবনকে ওভাবে সেই অর্থে সাজাতে পারিনি। আমার প্রকাশিত বই গুলো হচ্ছে-ফাগুনঝরা রোদ্দুর(২০১০),ভাষাচিত্র প্রকাশনী পঞ্চপত্রের উপপাদ্য(২০১২),এক রঙ্গা এক ঘুড়ি প্রকাশনী সংকলন-আলোর মিছিল ও নক্ষত্র(২০১৩ ও ২০১৪) একক গল্প গুচ্ছ-রোদ্দুরের গল্প ,দ্বৈত কবিতার বই (২০১৫),যমুনা প্রকাশনী। সামনে একটি কবিতার বই বের করার ইচ্ছে আছে যা হবে প্রবাসীদের জন্যে ইংরেজী ভাষায়।

মন্তব্য করুন