Select Page

পঞ্চাশে এসেও সালমান ২৫

পঞ্চাশে এসেও সালমান ২৫

সালমান শাহ বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৫০ বছর। এর অর্ধেক ২৫ বছর। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ২৫ বছর হওয়ার ১৩ দিন আগে তিনি মারা যান। সে অর্থে পুরো এক প্রজন্ম পুরোনা তিনি। এর মাঝে নানান ভাষার ছবি দেখার সুযোগ থেকে ডিভাইসের নানান পরিবর্তন ঘটেছে। সেটা বাংলা সিনেমার প্রচলিত দর্শক অর্থে। অথচ পুরোপুরি ভিন্ন প্রজন্মে এসেও রাজত্ব করছেন সালমান। প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো চ্যানেলে তার ছবি প্রচার হচ্ছে। সালমানের জনপ্রিয়তা যে শুধু একটা উন্মাদনা তা নয়, বরং নিজের সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল। অনেকে ভাবেন এ সময়েও তিনি তেমন, যেমনটা নিজের সময়ে তাকে কল্পনা করা যেত। কেমন?

এক.

ঢালিউড বরাবরই বলিউড সিনেমাকে মানদণ্ড ধরেছে। সালমান শাহে এসে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার নামটাই তো বলিউড থেকে ধার করা। অথচ উনার মূল নামে (ইমন) একজন অভিনেতা এখন আছেন! আবার ষাটের দশকে পপি হয়ে যান ববিতা। অথচ কয়েক দশক পর আরেকজন পপি নামেই এসে তিন-তিনখান জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

সালমানের প্রথম সিনেমা (কেয়ামত থেকে কেয়ামত) তার নামের মতোই বলিউড থেকে অনুমোদিত কপি-পেস্ট, যদিও তার পুরোদস্তুত সালমানের সিনেমা। মানে তিনি নিজেকে কপির বাইরে আলাদা করে দেখাতে পেরেছেন। এ কারণে দর্শক আমির খানকে স্মরণ বা তুলনায় না এনে এখনো সিনেমাটা দেখতে পারে। তার আরও কয়েকটা ছবিও (অন্তরে অন্তরে, দেনমোহর) বলিউডের কপি। সম্ভবত তার হাত ধরেই প্রথম কপিরাইট নিয়ে ছবির যাত্রা হয়। এটা হলো একটা দিক। আবার দেখেন সালমানের দুইটা ছবির রিমেক হয়েছে কলকাতায় (এই ঘর এই সংসার ও মায়ের অধিকার)। অভিনয় করেছেন ওই ইন্ডাস্ট্রির সে সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

… আর সম্ভবত কপি-পেস্টের দিক থেকে সালমানের পর ঢালিউড আসলে ততটা আগাতে পারেনি। প্রতি বছর নামে-বেনামে অনেক কপি-পেস্ট হলেও এগুলো স্রেফ আরেকটি ঢাকাই সিনেমায় রয়ে গেছে।

দুই.

প্রধানত কলেজ পড়ুয়া চরিত্রে সালমানকে দেখা গেছে। ওই সময়ের নানা প্রজন্ম তাকে পছন্দ করেছেন। তারা কোথাও না কোথাও কানেক্ট করেছে তা বোঝা ততটা কঠিন নয়। কারণের সালমানের চেহারা ও অভিব্যক্তির মধ্যে কাছে টানার এ ব্যাপারটা আছে।

তখনকার তরুণরা সেই অর্থে বাংলা সিনেমায় স্মার্ট নায়ক দেখে নাই। যার মতো তারা হতে চান বা এই স্বপ্নটা দেখা যায়। এর কয়েক বছর আগে অভিষেক হওয়া নাঈমকে নিয়ে নিশ্চয় উন্মাদনা ছিল। কিন্তু উনাকে দেখে মনে হওয়ার উপায় নাই যে, কেউ এ ধরনের হতে চায়। এক ধরনের মফস্বলীয় আবয়বে হাজির হন নাঈম। তা আর কাটাতে পারেননি। কিন্তু সালমান শহুরে বা গ্রাম্য যেকোনো ক্যারেক্টারে মানিয়ে যান ‌‘হিরো’ হিসেবে।

এর আগের সুপারস্টার ইলিয়াস কাঞ্চন প্রতিভাবান বা প্রচুর হিট সিনেমা উপহার দিলেও কোনোভাবে স্বপ্নের নায়ক নন। সাত্তার বা ওয়াসিম তো পোশাকি ছবির কল্পরাজ্যে। সোহেল চৌধুরী আরবান লুকে দারুণ, কিন্তু কোনো বিশেষত্ব নিয়ে হাজির হন নাই। জসিম বা আলমগীরকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে দেখলে মানুষ হাসাহাসি করতো এবং তাদের ছবি ঠিকই দেখতো। কারণে, উনাকে নিজেদের ক্লাসেরই মনে করত সাধারণ দর্শক। তাদের দেখে কোনো ধরনের উত্তরণের স্বপ্ন তৈরি হতো। তাই জসিম বা আলমগীরের লটারি চিরকালই হাসির বস্তুই হয়ে গেছে। অথচ লটারি দিয়ে ভাগ্য বদল আসলেই সম্ভব। কিন্তু সালমানের চেহারাটা ছিল এমন লটারি, যা দিয়ে অনেক কিছু জয় করা যায়। যা আর সিনেমাটিকভাবে অবাস্তব লাগে না।

ঢাকাই সিনেমায় ‌‘চিরসবুজ নায়ক’ উপাধি পাওয়া জাফর ইকবাল জীবদ্দশায় তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। বলা হয়ে থাকে, মৃত্যুর পর তিনি আইকন হয়ে গেছেন। যার সঙ্গে তার ট্র্যাজিক জীবনও যুক্ত। সালমানের সঙ্গে এখানে কিছু মিল আছে। কিন্তু সালমান মৃত্যুর আগে থেকে অভিনয়ে জনপ্রিয় ও আইকন দুটোই। তার মৃত্যু বা অপূর্ণ ক্যারিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর তো অবশ্যই।

নব্বই দশকের স্যাটেলাইট টিভি সহজলভ্য হওয়ার সেই সময়টাতে তরুণরা আসলে সালমানের মতো কাউকে দেখে নাই, যাকে বোম্বের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যখন সালমান, শাহরুখ, আমির বা সঞ্জয় রাজত্ব শুরু করেছে। হ্যাঁ, টিভিতে অনেক সুন্দর সুন্দর অভিনেতা ছিলেন, কিন্তু তারা পরে দু-একটা ছবি করলেও কোনো পর্দাভ্যালু তৈয়ার করতে পারেননি।

সালমানের সহজ চেহারা ও অভিনয় সে সময়ের অন্য যেকোনো নায়কের চেয়ে বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে কানেক্ট করেছিল। তারা হয়তো তরুণ রাজ্জাককে দেখে এমন স্বপ্ন দেখতেন, যা স্বাধীনতা পরবর্তী রাজ্জাককে তো আর পাওয়া যায়নি। যেভাবে উত্তম কুমার এখনো জীবন্ত, যেভাবে রাজ্জাক হয়ে উঠতে পারেননি। সালমান এমন এক তরুণ যাকে একজন বর্ষীয়ান মানুষ নিজের সন্তান হিসেবে কল্পনা করতে পারেন। বিশেষ করে সালমানের কিছু ছবি যেখানে সন্তান ও পিতা-মাতার সম্পর্ক নির্ভর (কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর, স্নেহ, সত্যের মৃত্যু নেই), এমন একটি ছেলেকে সন্তান বলে কল্পনা করা যায়। যার বেদনা, যন্ত্রণার সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করা যায়।

তিন.

সালমানের জনপ্রিয়তা অন্য একটা দিক থেকেও দেখা যায়। টেলিভিশনে তার উপস্থিতি। সাধারণত জনপ্রিয় নায়কদের নাটক করার চল তেমন ছিল না, বা নাটকের যে একটু অভিজাত ঘরানা তার সঙ্গে চিরায়ত বাংলা সিনেমার একটা দ্বন্দ্ব ছিল। ওই সময় তো, নাটকের লোক মানে থিয়েটার থেকে আসা।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— নাটক ও সিনেমার অভিনয়ের মেজাজ ও গ্ল্যামারের তারতম্য। যেটা নাটক থেকে সিনেমায় যাওয়া অভিনেতা বা উল্টো দিকে সিনেমা থেকে নাটকে যাওয়া অভিনেতার ক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়া একটু কঠিন ছিল। সালমান বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন। সিনেমার উচ্চকিত দিকটা বর্জন করেছিলেন নাটকে এসে। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের এমন ব্যস্ত সময়ে মামুনুর রশীদের ‘ইতিকথা’ ধারাবাহিকে সময় দেওয়া জানিয়ে দেয়, টিভি দর্শকদের প্রতি বা টিভির যে আভিজাত্য তার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ উনার ছিল।

টিভি দর্শকদের মাথায় রেখে স্মরণ করা। সালমানের সিনেমায় অভিষেক হয়তো অন্যভাবে হতে পারতো। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস থেকে সিনেমা শুরু করেছিলেন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম নির্মাতা আলমগীর কবির। সেখানে সালমানের মাও অভিনয় করেছিলেন। এ কথা এ জন্য উল্লেখ করা টিভি সে সময় যে ধরনের রুচির প্রতিনিধিত্ব করত, তার সঙ্গে কতটা মানানসই ছিলেন সালমান। আলমগীর কবিরের বেশির ভাগ ছবির নায়ক ছিলেন বুলবুল আহমেদ, যিনি টিভিতেও জনপ্রিয় ছিলেন।

টিভি ও সিনেমার মাঝামাঝি একটা জায়গায় সালমানের বসবাস ছিল। এখান থেকে তার অভিনয় সম্পর্কে একটা অনুমান করা যায়। বিশেষ করে মিডল ক্লাসের কালচার একটা মানদণ্ড হয়ে ওঠায় সালমানের দুই নৌকায় অবস্থান, তার অবস্থা টালমাতাল না করে, একটা ‘রুচিশীলতা’র ভিত্তি দেয়।

সেই নৌকা তিনি এখনো বয়ে চলেছেন।

চার.

সালমানের মৃত্যু একাধিক ট্রানজিশন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে। ঢালিউড পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুনদের নিয়ে যাত্রা করছে। যখন আরও একঝাঁক নতুন আসছে নেতৃত্ব দিতে, যদিও তারা কেউ সালমানের মতো হবেন না। আবার মান্নার মতো তারকা মারদাঙ্গা ইমেজ নিয়ে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু পতন ঠেকানো যাবে না। সেখানে ঢাকাই সিনেমার অশ্লীলতার একটা সিম্বলিক জায়গায় সালমানকে আবিষ্কার করা যায়। ঢাকাই সিনেমায় ‘কাটপিস’ আরও আগের ঘটনা হলেও এর নগ্নতাকে কলকাতার অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর আবির্ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। সালমানের মৃত্যু শোক বা এ খবরের সঙ্গে ঢাকার দর্শকেরা পড়লো ‘স্বামী কেন আসামী’ দিয়ে ঢাকায় ঋতুপর্ণার এন্ট্রি। মান্নার মৃত্যু, শাকিব খানের একচ্ছত্র রাজত্ব …. এরপর ঢালিউডের অনেক পানি গড়াবে। কিন্তু সালমান পঞ্চাশে এসেও ২৫ বছরে পড়ে থাকবেন। কেউ তাতে আপত্তি করবে না!

(অসমাপ্ত)


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন