Select Page

‘পরাণ’ জুড়িয়ে গেল…

‘পরাণ’ জুড়িয়ে গেল…

অভিনেতা ইয়াশ রোহানকে শুরু থেকেই বাহুল্য বর্জিত, অকৃত্রিম মানুষ মনে হয়েছে। গত বছরের জুনে তার সঙ্গে এক আড্ডায় ‘পরাণ’-এর প্রসঙ্গ এসেছিল। উচ্ছ্বসিত ইয়াশ বলেছিলেন, ‘আমার কথা বলছি না। তবে রায়হান রাফী পরিচালিত ‘পরাণ’ মুক্তির পর বিদ্যা সিনহা মিম আর শরীফুল রাজ অন্য উচ্চতায় চলে যাবে’।

এ বছর যখন ঈদের সিনেমায় ‘পরাণ’ মুক্তির আওয়াজ উঠেছিল, সঙ্গে সঙ্গে মিম যোগাযোগ করে আমার সঙ্গে, ‘ভাইয়া, তুমি তো সবসময় ভালো সিনেমার সাথে থাকো। ‘পরাণ’-এর সাথে থেকো’। মিমকে নিজের সিনেমার ব্যাপারে এতটা আত্মবিশ্বাসী এর আগে খুব কম দেখেছি। এমনও হয়েছিল, অতীতে মিমকে আমি বলেছি তার ‘অমুক’ সিনেমা হলে দেখতে যাবো। মিম নিষেধ করেছিল, ‘শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না ভাইয়া। সিনেমাটা যা হবার কথা ছিল, কিছুই হয়নি’। তবে ‘পরাণ’-এর ব্যাপারে মীমের দরদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেয়াল করেছি। ঈদের আগে থেকে এখন অব্দি ‘পরাণ’ নিয়ে গণমাধ্যম থেকে সিনেমা হলে মিম ও ‘পরাণ’ টিমের লাগাতার দৌঁড়ঝাপ প্রমাণ করে, তারা এই সিনেমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন। টিম নিজেদের কাজের ওপর বিশ্বাস রাখলে, দর্শক সমর্থন দেবেই।

এর আগে ‘আইসক্রীম’, ‘ন ডরাই’, ‘মাইনকার চিপায়’, ‘নেটয়ার্কের বাইরে’, ‘গুণিন’, ‘বিলাপ’ প্রত্যেকটি কাজেই শরীফুল রাজের সাবলীল অভিনয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বরাবরই আফসোস হতো, রাজ তার যোগ্যতা অনুযায়ী সাফল্য পাচ্ছে না। রাজের সাথে কথা হয়েছিল ঈদের দুদিন আগে। তার ভাষ্য, ‘কষ্ট তো করেই যাচ্ছি প্রতিটি কাজের জন্য। কেষ্ট একদিন মিলবেই। হয়তো ‘পরাণ’-ই কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছে’।

রাজ ভুল বলেননি। আজ ১৬ জুলাই সস্ত্রীক ‘পরাণ’ দেখতে গিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ সিনেমা হল আর দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে বুক ভরে গেছে। মধ্য বিরতিতে মেয়েদের রাজ’কে নিয়ে ‘উহ-আহ’ মন্তব্য শুনে নিশ্চিত হয়েছি, ‘পরাণ’-এর মাধ্যমে আগামী দিনের একজন সুপারস্টারের জন্ম হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই বরগুণা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন সেই আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। যার চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে মিম হয়েছেন ‘অনন্যা’, ‘রিফাত শরীফ’ হয়েছেন ইয়াশ রোহান আর শরীফুল রাজ ‘নয়ন বন্ড’ রূপী ‘রোমান’ চরিত্রে রীতিমত পর্দা কাঁপিয়েছেন। বরগুণার চাঞ্চলকর ঘটনা কতটুকু পর্দায় আসবে, কিভাবে পর্দায় আসবে-সে ব্যাপারে একটা আগ্রহ তো ছিলই। কতটুকু সত্য, কতটুকু কল্পনার আশ্রয় নেবেন চিত্রনাট্যকার-পরিচালক; সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গিয়েছিলাম স্টার সিনেপ্লেক্সে। সিনেমা দেখা শেষ করে যা পেয়েছি, তা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিল। শাহজাহান সৌরভ ও রায়হান রাফীর চিত্রনাট্য, গল্প বলার ভঙ্গি এক মুহূর্তও আমাকে সিনেমা হলে স্থির থাকতে দেয়নি। অনেকদিন পর এমন একটি সিনেমা পেলাম, যেখানে প্রেম আছে, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অ্যাকশন আছে, ক্লেদহীন কমেডি আছে, গান আছে, পারিবারিক সেন্টিমেন্ট আছে, চোখ ভিজিয়ে দেয়ার মত সিকোয়েন্স আছে, টুইস্ট আছে এবং অবশ্যই একটি বার্তা আছে। সব মিলিয়ে ‘পরাণ’ পয়সা উসুল সিনেমা এবং অবশ্যই এখন পর্যন্ত রায়হান রাফীর সেরা সিনেমা।

বিদ্যা সিনহা মিমকে এর আগে এতটা ভালো কোন সিনেমায় লেগেছে, মনে পড়ে না। প্রথমত: ‘অনন্যা’ চরিত্রে অভিনয় করার সাহসের জন্য বড় আকারের একটি হাততালি পাবার যোগ্য মিম। মূলধারার বাংলা সিনেমায় খুব কম-ই ডায়নামিক নারী চরিত্র পাওয়া যায়। ‘অনন্যা’ চরিত্রের এত শেডস্, এত লেয়ার; যে চরিত্রের প্রতিটি স্তরে অভিনয় করতে গিয়ে মিম নিজের মেধা প্রমাণ করেছেন। সামান্য পিছলে গেলেই চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতো। কিশোরীসুলভ চঞ্চলতা, আহ্লাদ মিম যেমন সাবলীলভাবে নিজের ভেতর ধারণ করেছেন, তেমনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর পলিগ্যামি আচরণ খুব সূক্ষ্মভাবে নিজের অভিব্যক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথাগত ‘খল’ চরিত্রে যেমন উচ্চকিত অভিনয়ের ব্যাপার চলে আসে, মিমকে সে পথে হাঁটতে হয়নি। অবশ্য মিমের চরিত্রকে কখনো দর্শকের মনে হবে পরিস্থিতির শিকার, কখনো ধূসর, আবার কখনো পুরোমাত্রায় ‘ডার্ক’। ‘অনন্যা’ চরিত্রের জন্য মিম সবচেয়ে কম মেকআপ করেছেন (কিছু দৃশ্যে বিনা মেক-আপেই ক্যামেরার সামনে এসেছেন) এবং বলতেই হয়, মিমকে এ সিনেমাতেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর লেগেছে।

ইয়াশ রোহানের ‘সিফাত’ চরিত্রকে আরেকটু ধ্যান দেয়া হলে দর্শক মন তৃপ্ত হতো। অনন্যার প্রেমে সিফাত কখন, কীভাবে পড়লো-এই বাঁকগুলো আরেকটু স্বচ্ছভাবে পর্দায় এলে, আরেকটু বেশি সন্তুষ্ট হতাম। তবে, ইয়াশ যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিলেন, ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। ‘সিফাত’ চরিত্রে ইয়াশ অভিনয় করেছেন বলেই হয়তো সিফাতের মা (মিলি বাশার) যখন শেষবার সিফাতকে দেখতে আসেন, আমার আশপাশের সবারই চোখ ভেজা দেখেছি। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, ইয়াশ পর্দার বাইরে প্রচারণাতে তো অবশ্যই, পর্দাতেও সহ-অভিনেতাকে স্পেস দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। যে দৃশ্যে ইয়াশের কাছে সংলাপ নেই, সে দৃশ্যেও ইয়াশ সহ-অভিনেতাকে যোগ্য সঙ্গত করে দৃশ্যটিকে সুন্দর করতে সাহায্য করেছেন। বড় অভিনেতারা কখনো হীনমন্যতায় ভোগেন না, চরিত্রের ব্যাপ্তি যতটুকুই হোক, নিজের জায়গাটুকু বের করে আনেন-ইয়াশকে দেখে তাই মনে হয়েছে।

তবে সবার মত আমিও বলবো, ‘পরাণ’ ছবির অন্যতম বড় চালিকা শক্তি শরীফুল রাজ। পানিতে এন্ট্রি সিন থেকে শুরু করে বাইক চালানো, গানের দৃশ্য, অ্যাকশন, সংলাপ প্রক্ষেপণের ভঙ্গি, ভয়েস মড্যুলেশন-প্রতিটি দৃশ্যেই রাজ যেন ‘আগুন’ ঝরিয়েছেন পর্দায়। আমাদের চলচ্চিত্রের পর্দায় এমন পৌরুষদীপ্ত নায়কেরই খুব বেশি দরকার; যিনি কখনো ‘রোমান’-এর মত আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের সিমপ্যাথি আদায় করে নিবেন, আবার কখনো ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’র মত ওয়েব ফিল্ম বা ‘আইসক্রীম’-এর মত সিনেমায় শহুরে চরিত্রে নিজেকে ‘আলট্রামডার্ন’ হিসেবে উপস্থাপন করবেন। কখনো আবার ‘গুণিন’-এর মত গ্রাম্য চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করবেন, তিনি গ্রামেরই সন্তান। রাজ এখন পর্যন্ত সব সিনেমাতেই তার আগের সিনেমার চরিত্র ভুলিয়ে দিয়ে ‘চরিত্র’ হয়ে যেতে পারছেন। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে যেতে পারলে রাজের জয়যাত্রা চলবেই।

‘পরাণ’ সিনেমায় আরেকটি ভালো লাগার দিক পার্শ্ব অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়। শহীদুজ্জামান সেলিম, শিল্পী সরকার অপু, রাশেদ মামুন অপু, মিলি বাশার ও নাম না জানা মীমের ছোট বোন চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন-সবাই ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য, গল্পের সাথে মিশে গেছেন। নাসিরউদ্দিন খান তো আরেক  ভালোবাসার নাম। আমাদের দেশে এমন অভিনেতা আছে, ভাবতেই গর্ব হয়। রোজী সিদ্দিকীও তার চরিত্রে সেরা। তবে একই ফ্রেমে, একই জোনে তার চরিত্রটি বারবার না দেখিয়ে চরিত্রটি নিয়ে আরেকটু বোধ হয় খেলা যেত। লুৎফর রহমান জর্জের চরিত্রটিও তার নিজের ডাবিংয়ের অভাবে কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। রং বিন্যাস কিছু ক্ষেত্রে বেশ এলোমেলো ছিল। গানের সাউন্ড খুব একটা হৃদয়গ্রাহী ছিল না। যদিও ‘চল নিরালায়’ এবং ‘পরাণ’ টাইটেল ট্র্যাক মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। বিশেষ করে এ ছবির আবহ সংগীত (জাহিদ নিরব) মন ছুঁয়ে যায়। মিছিল সাহা এ ক্ষেত্রে চোখে আরাম দেয়ার মত চিত্রগ্রহণ করেছেন। ময়মনসিংহের মনোরম লোকেশনগুলো নির্বাচন করার জন্য পরিচালক রাফী বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাবেন। সম্পাদনায় সিমিত রায় অন্তর বরাবরের মতই নির্ভরযোগ্য।

সব মিলিয়ে, ‘পরাণ’ শুধু এ বছরের নয়, সাম্প্রতিক কালের সেরা সিনেমার একটি। সিনেমা নির্মিত হয় বিনোদনের জন্য, কখনো দর্শকের বোধ/ বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য। দুটি ক্ষেত্রেই ‘পরাণ’ চূড়ান্ত সাফল্য। সময় বদলে গেছে। এখন আর তথাকথিত ফর্মূলা সিনেমা দর্শক পছন্দ করেন না। দর্শক চান গল্প প্রধান নিত্যনতুন আইডিয়া। ‘পরাণ’ সেই সত্যটিই আরেকবার বুঝিয়ে দিলো। অভিনন্দন, ‘পরাণ’-এর প্রযোজক লাইভ টেকনোলোজিস, পরিচালক রায়হান রাফী সহ টিমের সবাইকে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন