পাষাণ : একদা কোকিল কাক হতে চেয়েছিল!
“দেশা-দ্য লিডার” খ্যাত পরিচালক সৈকত নাসির; প্রথম চলচ্চিত্রেই যিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন তার চলচ্চিত্রের উপর একটা আস্থা ছিল আমার। কিন্তু পাষাণ দেখার পর সে আস্থা কিছুটা কমে এসেছে। কারন “দেশা-দ্য লিডার” এর মত চলচ্চিত্র নির্মাণ তৎকালীন সময়ে খুবই সাহসী একটা উদ্যোগ ছিল। আর এখন, যখন মানুষ আবার কিছুটা সিনেমা হল মুখো হচ্ছে ঠিক তখন পাষাণের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ এর যৌক্তিকতা খুজে পাচ্ছি না।
যাইহোক, পাষাণ দেখার পর একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। ইদানীং, বাংলা চলচ্চিত্রে একটা নতুন ধারা দেখছি সেটা হচ্ছে গল্পের কোন না কোন চরিত্র হয়ত নায়ক অথবা খলনায়ক নিজ হাতে নিজ বাবাকে খুন করছে। শিকারি তে শাকিব খান তার বাবাকে গুলি করলেও মারতে পারে না; বস -টু সিনেমায় নায়িকা নুসরাত ফারিয়া ও খলনায়ক ইন্দ্রনীল দু’জনই নিজের বাবাকে খুন করেন। ঢাকা আ্যটাক এ খলনায়ক নিজের বাবা, মা, চাচা সব নিজের হাতে খুন করে। আর সর্বশেষ পাষাণে দেখলাম নায়ক নিজের হাতে বাবাকে খুন করছে।
জানি না এটা “দাদাইজম” (Dadaism) এর মত সচেতন কোন মুভমেন্ট নাকি অবচেতন মনেই একটা বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এইতো বছর পাঁচেক আগেও বাংলা সিনেমার একটা কমন বিষয়বস্তু ছিল নায়িকা বা নায়কের বোন বাঁচাও বাঁচাও বলে দৌড়াবে আর কিছু ধর্ষক ক্ষুধার্ত কুকুরের মত তার পিছু পিছু ছূটবে। এ দৃশ্যগুলোই হয়ত ধীরে ধীরে দেশে একটা ধর্ষক শ্রেণী সৃষ্টি করেছে যারা এখন নির্বিচারে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। তাই ভয় পাচ্ছি সিনেমার এই দৃশ্যগুলো না আবার বাবা হত্যাকারী একটা জেনারেশন তৈরি করে ফেলে কারণ প্রমথ চৌধুরী বলেছেন “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়”। এ অংশটা আমার সমাজ সচেতনতামূলক ব্যক্তিগত মতামত এতে চলচ্চিত্রের বা চলচ্চিত্রকারের কিছু আসে যায় না।
তাই চিত্রনাট্য প্রসঙ্গ আসা যাক। পাষাণের চিত্রনাট্য প্রচন্ড মাত্রায় দুর্বল ছিল। কয়েকটা সিনেমার গল্প এক সাথে জোড়াতালি দিয়ে নতুন একটা গল্প উৎপাদনের ক্ষুদ্র প্রয়াস ছিল। চিত্রনাট্যে খুব নতুন বা চমকপ্রদ কিছু ছিল না। বিরতি পর্যন্ত তেমন কোন গতিই ছিল না, নিজেকে পাষাণ বানিয়ে হলের সিটে বসে ছিলাম।
বিরতির পর কিছুটা গতি আসলেও তা পরিমিত মাত্রায় ছিল না। চিত্রনাট্যের দুর্বল দিকগুলো ছিল – ওম এর অতিমানবীয় উপস্থাপন। কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া মিম ওমের প্রেমে পড়ে যাওয়া, যদিও প্রথমে মনে হবে মিম বাঁচার জন্য অভিনয় করছে কিন্তু শেষে বুঝা যায় যে সত্যিই ওমের প্রেমে পড়েছিল। আবার সে আশৈশব একজনের জন্য অপেক্ষা করছিল। একজন পুলিশ অফিসারকেও আবার সে বিয়ে করবে বলে ঘুরাচ্ছে। পুরাই আউলা এই অংশটা।
গল্পে তাড়াহুড়ো খুব বেশি ছিল। তাই কোন চরিত্রই ঠিকমত বিকশিত হতে পারেনি। ওম বিভিন্ন কাঁচা লংকা টাইপ মেয়েদের নিয়ে ঠিকই ফুর্তি করতে পারে কিন্তু মিম বা মিশার বোনের সামনে দাঁড়ালেই তার ব্যক্তিত্ব আকাশ ফুঁড়ে নাজিল হয়। ওমের বাবার কী সমস্যা ছিল তা যেকোন প্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষ মানুষই বুঝতে পারবে সেখানে ওম তার খালার থেকে এত বছর পর কি এমন লুকানো সত্য শুনে ফেলল যা শুনে সে বুঝতে পারল যে তার বাবা সম্পূর্ণ নির্দোষ? আর সাথে সাথে বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় তার চোখে পানি চলে আসল!
ডাবল ডেকার বাস নিয়া কেউ অপহরণ করতে আসে এমন অভিনব আইডিয়া আর কোথায় পাব জানি না। সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর একটা প্রবণতা (বিশেষ করে মিমের সাথে তার বসের কথোপকথন অংশটুকু) বিরতি’র পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত খুব ভালো ভাবেই বিরাজ করছিল সিনেমা জুড়ে।
এবার অভিনয় ও চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে আসা যাক। পাষাণ সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন – ওম, বিদ্যা সিনহা মিম, মিশা সওদাগর, বিপাশা কবির, সাদেক বাচ্চু, শাহেদ আলী, ইলোরা গহর, মিজু আহমেদ, চিকন আলী, শিমুল খান, শামিম, নাদের চৌধুরী, তানভীর তনু প্রমুখ। ওমের অভিনয় ভালো ছিল। লম্বা ছিপছিপে শরীরে এই চরিত্রটার সাথে খুব ভালো মানিয়েছে। তার কণ্ঠ চরিত্রের দাবি অনুযায়ী ভরাট না তাই কিছুটা আলগা আলগা লাগছিল। তবে তার ডায়লগ খুবই কম ছিল, যা প্রশংসনীয়। অ্যাকশন স্টাইলটা ভালো ছিল। মিমের অভিনয় প্রথম দিকটাতে খুবই কাঁচা ছিল তবে তাকে অপহরণের পর থেকে কাঁপিয়ে অভিনয় করেছেন। মিশা সওদাগর বরাবরই উচ্চমানের অভিনেতা এখানেও তাই ছিলেন। নাদের চৌধুরী কিছুতেই তার চরিত্রের ভিতর ঢুকতে পারছিলেন না। সাদেক বাচ্চু আর মিজু আহমেদের চরিত্রটা পর্যাপ্ত পরিমাণ সময়ই পায়নি। বিপাশা কবিরের চরিত্র বিন্যাস একদমই অযৌক্তিক তবে তিনি এ আযৌক্তিক চরিত্রটাকে কিছুটা হলেও যৌক্তিক করতে পেরেছেন তার অভিনয় দিয়ে। ইলোরা গহর বরাবরই শক্তিমান অভিনেত্রী এখানেও তিনি নামের প্রতি সুবিচার করেছেন।
তবে সিনেমার প্রশংসনীয় দিকগুলো ছিলো সিনেমাটোগ্রাফি, লাইটিং আর এডিটিং। এই অংশে খুবই সফল সিনেমাটি। তবে মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কোন গান ছিল না। আবহ সংগীতও মনকে খুব একটা টানেনি।
সবশেষে বলতে চাই, “পাষাণ” পরিচালনায় পরিচালক “সৈকত নাসির” হয়ত নিজের রুচির প্রতিই পাষাণ হয়েছিলেন। তাই নিজের রুচিকে একটু নিচে নামিয়ে এনে আমজনতার সিনেমা বানাতে চেয়েছেন। উনি কতটা সার্থক হয়েছেন সেটা দর্শকের বিচার্য, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় তিনি সফল ছিলেন না বরং “কোকিল কাকের কা কা কন্ঠ নকল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিজের কুহু সুরটাও হারিয়েছে” বলেই বলেই মনে হচ্ছে।