পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বার্তা ‘নরম গরম’
সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এফ কবিরের ‘নরম গরম’ মাশালাদার ফোক সিনেমা কিন্তু এর ভেতরেও তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে একটা বার্তা আছে যা অনেকেই ধরতে পারেনি। অথচ সিনেমার নামটিই দিয়ে পরিচালক নারীর কোমলতা ও কঠোরতার কথাটিই বুঝাতে চেয়েছেন।
৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নরম গরম’ তখনকার অন্য ৮-১০টা সিনেমার মতো ব্যবসাসফল। এই সিনেমার কুমার বিশ্বজিৎ ও অঞ্জু ঘোষের কন্ঠে ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’ এবং রুনা লায়লার ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না’ গান দুটো ছিলো দারুণ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না’ তো ঢাকার সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় গানগুলোর অন্যতম হয়ে আছে। আহমেদ জামান চৌধুরীর লেখা, সুবল দাসের সুর ও সংগীত পরিচালনায় গানটি এতো আধুনিক যে আগে থেকে কেউ না জানলে বুঝতেই পারবে না গানটি কোনো সিনেমার গান। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট এতো বিশাল যে এমন অ্যারেঞ্জমেন্টের গান গত ২০ বছরেও হয়নি বা এমন গান করার মতো সুরকার পাইনি। অনেক অ্যাকুয়েস্টিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয়েছিলো যার সবগুলো নাম আমার জানা নেই। এখনও গানটির অসাধারণ মেলোডিয়াস সুর ও কম্পোজিশন শুনে বিস্মিত হই। রুনা লায়লাও গেয়েছিলেন কণ্ঠ উজাড় করে। এখনও মনে পড়ে সিনেমা হলে গানটি পর্দায় আসা মাত্রই দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি আর ঠোঁট মেলানোর ঘটনাটা।
যাই হোক, শুরুতে যে প্রসঙ্গে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি। ‘নরম গরম’ ছবিতে নারীর বিভিন্ন দিক-বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো গল্পের বিভিন্ন বাঁকে। নারী মমতাময়ী, প্রেমময়ী যেমন ঠিক তেমনি প্রয়োজনের সময় নারী কঠিন-কঠোর-শক্তিশালী হতেও পারে। একটি নারী পারে একটি পুরুষকে সুপথে ফেরাতে, এমনকি সুশাসন নিশ্চিত করতে। পুরো ছবিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের চোখে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আর সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে দিয়ে বা ভুল প্রমাণ করে নারীর অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোকেই সামনে আনা হয়েছে। নারী শুধু গৃহে থাকা পুরুষের দাসী নয়, বাঈজী খানার বাঈজী নয় কিংবা ভোগের পণ্য নয়। নারী পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ পরিবর্তনের সহযোদ্ধাও হতে পারে।
ছবির একটা দৃশ্য জমিদার পুত্র ওয়াসিম নারীর বেশে দরবারে নেচে নেচে গান গাইছে আর তা সিংহাসনে বসে অঞ্জু উপভোগ করছে এমন দেখা যায়— যা ছিলো রূপক অর্থে পুরুষদের চিন্তা চেতনায় চপটাঘাত। গানটি ছিলো কাল্পনিক একটা দৃশ্য যা অঞ্জুর নির্দেশে কারাগারে বন্দি জমিদারপুত্র ওয়াসিম কল্পনায় দেখে আঁতকে উঠে। এই আঁতকে উঠার মধ্য দিয়ে পরিচালক বুঝাতে চেয়েছিলেন যে পুরুষরা নারীদের সাথে যে আচরণ করে তা যদি নারীরা পুরুষদের সাথে করে তাহলে পুরুষের কেমন লাগবে— যা ছিলো পুরুষ ও নারীর একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের প্রতীকি চিত্রায়ন।
বখে যাওয়া জমিদার পুত্র ওয়াসিমের কারণে জমিদারি হাতছাড়া হওয়া থেকে তা রক্ষা করে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে পরিচালক বুঝাতে চেয়েছিলেন যে নারীরা যোগ্য মর্যাদা পেলে শুধু একটা সংসার নয় একটা রাজ্য-দেশ শাসনও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে। আজ ফেসবুক, ব্লগ, মিডিয়ায় সুশিল নারীবাদীরা যা বলতে চান, বুঝাতে চান তা একটি সাধারণ গল্পের ভেতর দিয়ে পরিচালক বলে গেছেন। রোমান্টিক, ফোক গল্পের ভেতরে পুরো সিনেমাটাই যেন একটা ‘নারীবাদী’ সিনেমার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে যা বোঝার ক্ষমতা সুশীল সিনেমাবোদ্ধাদের নেই। তাদের কাছে অন্য ৮-১০টা বস্তাপঁচা সিনেমার একটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না