Select Page

পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেলার ‘কারাগার ১’ কথন

পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেলার ‘কারাগার ১’ কথন

কারাগার’ সিরিজটি দেখবার পরে আমার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি ছিল; পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেলার!

আমাদের ছেলেবেলায় রেডিওতে ফিল্মের প্রমোশনমূলক অনুষ্ঠান হত। একজন সঞ্চালক সিনেমার কাহিনি বর্ণনা করতেন, ফাঁকে ফাঁকে সিনেমার সংলাপ শোনানো হত, অথবা হিট গানের কয়েক লাইন। সেসব অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে শ্রোতারা সিদ্ধান্ত নিত হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখবে কিনা। রেডিও প্রমোশনের যুগ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি ট্রেলারের যুগে। ট্রেলার যদি আকর্ষণীয় হয় সিনেমার সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুলাংশে।

ছেলেবেলায় টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটকও প্রচারিত হত প্রচুর। একটা বড় গল্পকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করে ৬ মাস বা ১ বছর ধরে দর্শককে এনগেজ রাখতো। হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি, আজ রবিবার কিংবা কোথাও কেউ নেই জাতীয় নাটকগুলোকে আরেকটু কম্প্যাক্ট করে কোনো ওটিটি প্লাটফর্মে প্রচার করলে সেগুলোকে কেন ওয়েব সিরিজ বলা হবে না?

ট্রেলারের আলাপে ওয়েবসিরিজের অনুপ্রবেশের হেতু চিন্তা করাকালীন মনে পড়লো ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ ফিল্ম সিরিজ। ছয়টা পৃথক সিনেমার সেট।

যদি এমন হতো প্রথম দুটা সিনেমা আসলে ট্রেলার, মূল সিনেমা শুরু হবে তৃতীয়টা থেকে, কিন্তু দর্শক বুঝতেই পারেনি— একে পরিচালকের ব্রিলিয়ান্স বলা হতো, নাকি ডিরেক্টরিয়াল ইথিক্স গ্রাউন্ডে পরিচালক বিব্র‍তবোধ করবেন?

ডিলেমাটি নিঃসন্দেহে ইউনিক, কারণ ইতোপূর্বে ভিজুয়াল কনটেন্টের ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।

‘কারাগার’ সিরিজটি দেখবার পরে আমার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি ছিল; পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেলার!

পরিচালক কনফিডেন্টলি জানতেন দ্বিতীয় পর্ব আসবে, যে কারণে একদম শুরু থেকেই কারাগার (পার্ট ১) হিসেবেই ব্রান্ডিং হচ্ছে। এর ফলে পরিচালক সচেতন মাইন্ডসেট রেখেই তৈরি করেছেন পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেলার। তাকে অভিবাদন জানাবো, নাকি ট্রেলারের রিভিউ লিখবো— দোটানা থেকে অব্যাহতি পাই বন্ধুস্থানীয় নাবিল হোসেনের মাধ্যমে কলকাতার জনৈক অভিজিত রায় চৌধুরীর এক স্ট্যাটাস নজরে আসায়।

কলকাতায় নির্মিত অন্তঃসারশূন্য ওয়েবসিরিজগুলোর বিপরীতে বাংলাদেশের সিরিজগুলো কত এগিয়ে মন্তব্যের পাশাপাশি তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ওখানকার নির্মাতাদের উচিত বাংলাদেশিদের কাছে ইন্টার্নশিপ করা। রেফারেন্স হিসেবে কাইজার, মহানগর, তাকদীর থাকলেও প্রথম নামটি কারাগার! স্ট্যাটাসের এনগেজমেন্ট ভলিউম (কমেন্ট, শেয়ার) সাক্ষ্য দিচ্ছে বক্তব্যের ওজনদারিতা বিষয়ে।

অর্থাৎ পরিচালক ট্রেলারকে পূর্ণমানের সিরিজ হিসেবে মার্কেটে চালাতে সমর্থ হয়েছেন। আমার ইনকিউজিটিভ প্রবণতার ফোকাল পয়েন্ট তখন ঘুরে গেল। ট্রেলার কেন মনে হলো, এবং বৃহদাংশই কেন কনভিন্সড— ব্যবচ্ছেদ না করা অবধি মিলছিল না স্বস্তি।

৩ বা ৫ মিনিটব্যাপী ট্রেলারে সাধারণত কী কী থাকে? সবচাইতে এক্সক্লুসিভ ফুটেজগুলো যার মাধ্যমে আপনি ট্রিগারড হবেন, নানা কিছিমের ইঙ্গিত পাবেন, কিন্তু পারসেপশন তৈরি হবে না— এই অসম্পূর্ণতাই নির্মাতার ট্রিক্স, সে আপনাকে দেখিয়েই ছাড়বে পুরো ফিল্মটা।

কারাগার এসব শর্তের কয়টি পূরণ করে?

  • নাম এবং সেট আপ এই অনুমেয় এটা জেলখানার ভেতরের অন্য জগত নিয়ে ডিল করবে।
  •  অসংখ্য ঘটনার ইঙ্গিত দেয়া, যেগুলোর জন্য প্রয়োজন অনেকগুলো ব্যাকস্টোরি। একটা পয়েন্টে এসে সবগুলো স্টোরি একীভূত হবে।
  • কনফ্লিক্টটা কার সাথে কোন ইস্যুতে, তাও সুস্পষ্ট নয়। এটা একক ব্যক্তির সাথে সিস্টেমের, নাকি সিস্টেম বনাম রাষ্ট্রের; সেই সিস্টেমের কে ভিক্টিম, বেনিফিশিয়ারিই বা কে, তাও জানা যাচ্ছে না। এতগুলো আনছার্টেইনটি প্যারামিটার নিয়ে একটা কনটেন্ট দিব্যি এগিয়ে গেছে।

মানুষ তবে দীর্ঘতম ট্রেলারটা কেন দেখলো, বা আমি দ্বিতীয় খণ্ড কেন দেখতে চাই।

কেইস১: যদি কারাগার দেখে থাকে ৭ লক্ষ মানুষ সেখানে কি ৭০০ জন মানুষ পাওয়া সম্ভব যারা বিশ্বাস করেছিল চঞ্চল চৌধুরী মূক এবং বধির? কখন কোন প্রেক্ষাপটে চঞ্চল কথা বলবে সেটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কেইস২: ৭ লাখ আনুমানিক দর্শকের মধ্যে ৭ জন কি আছেন যারা বিশ্বাস করেছিলেন চঞ্চল ২৫০ বছর ধরে কারাবাস করছে, আন্দামানের জেলে ঘুমিয়ে ছিল, ঘুম ভেঙে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের কোনো এক জেলে; কিংবা চঞ্চল কোনো পীর-আউলিয়া? তাহলে চঞ্চল এই রুমে ঢুকলো কীভাবে, ৫০ বছর ধরে যেটা তালাবদ্ধ, যার চাবিটি পর্যন্ত অজানা। শুরুতে যেরকম চুল-দাঁড়ি ছিল ওগুলো নকল হলে কাটার প্রয়োজন পড়তো না। যেরকম অমানবিক নির্যাতন করেছে ওটা সহ্য করা, এবং কানের পাশে এত জোরে শব্দ করা সত্ত্বেও নন-রেসপন্সিভ থাকা— তাহলে তার ট্রেনিংটা কীরকম ছিল, এবং কতদিন ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছে?

কেইস৩: সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই আফজাল হোসেন কেন জল্লাদির গল্প শোনাচ্ছে। সে কেন চঞ্চলের সাথে আকার ইঙ্গিতে কথা বলে? জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের তেমন কোনো এক্টিভিটি কেন নেই, তার বিড়াল শুধু চঞ্চলের কাছে কেন যায়?— অর্থাৎ  আফজাল ও জয়ন্ত স্টোরিলাইনের অত্যন্ত ক্রুশাল দুই কুশীলব যাদের আড়াল করে রাখা হয়েছে। ডিবি অফিসার এফ এস নাঈমের বাসায় কেন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, জেলার ইন্তেখাব দিনারের পুত্র বেটিং-ফিক্সিংয়ে জড়িত। সহকারী জেলার কেন দিনারের সাথে এতটা ডিমান্ডিং টোনে কথা বলে, যেটা এসব বাহিনীতে একেবারেই অসম্ভব। তবে কি সে কোনো গোপন দুর্বলতা জানে? এক হাজতির জায়গায় দিনারের ছেলে জেল খাটছে বাইরের শত্রু থেকে বাঁচতে; সেই হাজতির স্ত্রী জেলারের প্রতি দম্ভ দেখানোর জোর কথায় পেল? এক বোরখা পরিহিত নারী বিভিন্ন সময় স্ক্রিনে আসে, কিন্তু কোনো ইন্টারেকশন নেই কারো সাথে। সিসিটিভির ফুটেজ কে লিক করলো?

ফারিণ ফ্রান্সে থাকতো, সে বাবাকে খুঁজছে যে লিবিয়ায় অভিবাসন নিয়েছিলেন শোনা যায়, এলাকার মানুষ জানে তিনি মৃত। চঞ্চল চৌধুরীর ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলে না, ‘ব্ল্যাকশিপ অব ১৯৭১’ নামের এক বইয়ের সে লেখক এবং বিদেশি নাম, সেই বই শতাব্দী ওয়াদুদের কাছে কীভাবে গেল? ফারিনের গল্পটা চঞ্চল বা শতাব্দী ওয়াদুদ জানে কীভাবে?— অর্থাৎ স্টোরিলাইনে নিশ্চিতভাবেই ইন্টারন্যাশনাল কোনো পলিটিক্স বা মাফিয়া গ্যাং ফ্যাক্ট জড়িত। একজন পুলিশ বাইক দুর্ঘটনায় পতিত হয় ভেড়াকে বাঁচাতে গিয়ে, ভেড়ার রেফারেন্স আছে আরো কয়েক জায়গায়, এবং ব্ল্যাকশিপ ফ্রেজটার বাংলা দল বা পরিবারের কুলাঙ্গার ব্যক্তি। তার মানে একটা দল বা গোষ্ঠীর গল্প শোনানো হচ্ছে, সেখানকার একজন বা কয়েকজন গোষ্ঠীর আদর্শের সাথে পজিটিভ অথবা নেগেটিভ অর্থে সংঘাতে জড়িয়ে দলচ্যুত হয়েছে। কে বা কারা?— গল্পটা তাই শেষপর্যন্ত ভেড়া খোঁজাখুঁজির, অর্থাৎ ঘুরেফিরে সাইকোলজিকাল থ্রিলার।

আমি আগ্রহী মূলত এতগুলো বিচ্ছিন্ন গল্প আর ক্যারেক্টারকে পরিচালক কীভাবে জোড়া লাগায় সেই মুন্সিয়ানা দেখতে। আপনি ডিনারে গেলেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে; শুরুতেই ইচ্ছামতো ডেজার্ট খেয়ে ফেললেন— পর্যাপ্ত সম্ভাবনা মূল ডিশ খেতে পারবেন না। ‘কারাগার-১’ এর ক্ষেত্রে পরিচালক অনুরূপ ক্রাইসিসে পড়ার হাই রিস্ক।

তবু মার্কেটে ট্রেলার জমজমাট কেন চললো?

সিনেমা রিলিজের আগে নায়ক বা নায়িকার লুক প্রকাশ করে হাইপ তোলা হয় অনেক সময়। চঞ্চল চৌধুরীর গেটআপ, এক্সপ্রেসন, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ফারিণের সাথে কথা বলা— বড় স্ক্রিনে প্রদর্শিত হলে দর্শকরা হাততালি দিত, কেউ কেউ শিস বাজাত।

চঞ্চল একটা মিশন বা উদ্দেশ্য নিয়ে কারাগারে হাজির হয়েছে, সেটাই খোঁজার চেষ্টা করছে দর্শক, পুলিশ সবাই— কিন্তু ৭ এপিসোড ধরে খুঁজে পাওয়া গেল একটা বিড়ালের পশম! এটার জন্য ৭ পর্ব অনেক এক্সপেনসিভ প্রজেক্ট, সর্বোচ্চ ৫ এপিসোডেই এসব ইঙ্গিত দেয়া আর চঞ্চলের গিমিক দেয়াটা যথেষ্ট ছিল। অতিরিক্ত ২ এপিসোড টেনে নেয়ার কারণ সবটাই কমার্শিয়াল। শেয়াল যেমন একই কুমিরের ছানা দেখিয়ে বুঝ দিতো, আমরা কুমির হয়ে বিভিন্ন চরিত্রের চেহারা-পরিচয় আর চঞ্চল চৌধুরী অবসেসনেই কাটিয়ে দিলাম সাসপেন্স আর উৎকণ্ঠায়৷ সাসপেন্স আর এলো না, কে যেন ভিড়ের মধ্যে নির্গমন করলো বায়ু!

আগামীতে যদি কারাগারের ট্রেলার প্যাটার্নটাই ট্রেন্ড হয়ে উঠে দর্শক হিসেবে আমি কি উশখুশ করব?

প্রশ্নটা তাড়িত হওয়াকালীন ভাবনা এলো ক্রিকেট খেলায় যদি ব্যক্তিগত স্কোর হিসাব রাখা না হয়, অর্থাৎ ব্যাটসম্যান কত রান করলো ট্র্যাক থাকবে না, কেবলমাত্র দলীয় স্কোর দেখানো হবে বোর্ডে, তখন প্লেয়ারদের মাইন্ডসেট কীভাবে কাজ করবে? একজন পাঠক বা দর্শক আমার কনটেন্টের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে না, ছলা-কলা করে তাকে ছেলেভুলানোর কায়দায় আমার কনটেন্ট সাবস্ক্রাইব করলাম— এটা কনটেন্টের সামর্থ্য বা যোগ্যতা, নাকি ভোক্তার  টেম্পটেশন বা উইক পয়েন্টকে কাজে লাগানো?

স্টোরিটেলিং টেকনিকটা কি তবে শেষপর্যন্ত রান্নার মূল উপাদান, যেমন মাছ-মাংস বা সব্জির বদলে মশলা বা টেস্টিং সল্ট বেশি যেটা নিয়ন্ত্রণ করে জিহবার স্বাদ?

৫ এপিসোড ধরে ট্রেলার চালানোর দক্ষতা প্রদর্শন করায় পরিচালককে অভিবাদন। বাংলাদেশি কনটেন্টে এক্সপেরিমেন্ট লক্ষণীয়। ইতিবাচক৷

তবে অতিরিক্ত ২ এপিসোড চালিয়ে ১ ঘন্টা সময় কেড়ে নিলো আফিমের চাতুর্যে, এটা নিন্দনীয়। আমি ডেজার্ট প্রায় কিছুই খাইনি, কেবল চেখে দেখেছি, মূল ডিশটা আসুক। তারপর বলতে পারব আয়োজনটা কেমন হলো। আমার বলা না বলায় মার্কেট ট্রেন্ডে প্রভাব পড়বে সে আশা করি না। ভদকা নাকি কামরাঙা খাবে সেটা চিরকালই ভোক্তার চয়েজ। তবে একজন দর্শক যদি স্রেফ প্রথম সিজন দেখতে চায়, দ্বিতীয় সিজনটা সময় পেলে দেখবে অথবা দেখবে না— অর্থাৎ তার চয়েজ সবটাই, ‘কারাগার’ নিঃসন্দেহে তার চয়েজটা খোলা রাখেনি। যদি দ্বিতীয় সিজন না দেখে তবে প্রথম সিজনে মনে রাখার জন্য চঞ্চলের ওই লুক আর ফারিণের সাথেকার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যতীত কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। আমি ডিরেক্টর হলে দর্শকের এই চয়েজ খোয়ানোটা ডিরেক্টরস পয়েন্টে আনইথিকাল গণ্য করতাম।

তাই কুমড়ো ফুলের বড়া খাওয়ার অভিপ্রায়ে বসে রইলাম।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়

লেখক ও বায়োপিক এনালিস্ট

মন্তব্য করুন