Select Page

প্রেম প্রতারণা প্রতিশোধের ‘ঘৃণা’

প্রেম প্রতারণা প্রতিশোধের ‘ঘৃণা’

প্রেম, প্রতারণা ও প্রতিশোধের গল্প নিয়ে রোমান্টিক- থ্রিলার বা একশ – থ্রিলার ধারার সিনেমা বাংলাদেশে পুর্বেও হতো এখনও হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান তথাকথিত ডিজিটাল সিনেমা ডিজিটাল পরিচালকরা যেন থ্রিলার টাইপ গল্প নির্মাণে যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাপলুডু’ও তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে বড় পর্দায় যারা টেলিভিশন নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাণ থেকে এসে সিনেমা নির্মাণ করছেন তারা সম্ভবত বড় পর্দায় কিভাবে গল্প ফুটিয়ে ধরতে হয় আর কিভাবে দর্শকদের আড়াই ঘন্টা বসিয়ে রাখতে হয় তা জানেন না। বড় পর্দার দর্শক প্রতিক্রিয়া আর টেলিভিশনে দেখা দর্শক প্রতিক্রিয়া এক নয়। বড় পর্দার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, গল্প বলার ছন্দ আছে সেগুলো আপনাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে।

এর আগেও অভিনেতা ও প্রযোজক মাহফুজ আহমেদ খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে তাঁর প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘’জিরো ডিগ্রি’’ মুক্তি দিয়েছিলেন। ‘’জিরো ডিগ্রি’’ ছবির থিমটি /গল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘’প্রেম, প্রতারণা ও প্রতারিত হওয়া দুই নারী পুরুষের প্রতিশোধের গল্পের ছবি জিরো ডিগ্রি ‘’। উনার কথায় উনি আরও বুঝিয়েছিলেন এই ধরনের গল্পের ছবি আগে কখনও হয়নি । মাহফুজ সাহেবের সেদিনের কথা শুনে কে কি ভেবেছিল জানি না, তবে আমি সেদিন মুচকি হেসেছিলাম এই ভেবে যে বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা এক প্রজন্মের কাছে কতভাবে কতরুপে কতজন ধরা দিচ্ছেন তা দেখে । ছবি মুক্তি পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেকের রিভিউ পড়ে বুঝতে পারলাম মাহফুজ সাহেবের নতুন ধারার নতুন ছবিটির গল্প অনেক দর্শকের মাথার উপর দিয়ে গেছে অর্থাৎ অনেকে ছবির গল্পটি কি বলতে চেয়েছে সেটা বুঝতে পারেননি।

আপনাদের আজ থেকে ২৫ বছর আগে দেখা তথাকথিত একটি সস্তা বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্রের কথা বলবো যা দেখে আপনারাই অনুমান করে নিন যে ‘’জিরো ডিগ্রি’’ ছবির থিম ‘’ প্রেম, প্রতারণা ও প্রতিশোধ’’ এর গল্পের কোন ছবি আগে বাংলাদেশে হয়েছিল কিনা ।

মূল কথায় যাওয়ার আগে আরও একটি তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি। ছবিতে যে পোস্টারটি দেখতে পাচ্ছেন সেটা ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি ’ঘৃণা’র পোস্টার। আমি সিনেমার পোস্টার সম্পর্কে একটি পোস্টে যে কয়েকটি পোস্টারের প্রশংসা করেছিলাম তার একটি ছিল এই ঘৃণা ছবিটির বড় পোস্টার। যে পোস্টারে জুড়ে কাফনের কাপড় পরা৬ টি লাশ সারিবদ্ধভাবে ছিল এবং উপরে বাম পাশে ছিল রুবেলের করুন ও মলিন মুখটি, নীচে ফরিদি ও তার দলবলের ছুটে আসার ছবি যা দেখে সিনেমা হলে ছুটে গিয়েছিলাম আমরা।

মালেক আফসারি পরিচালিত ‘ঘৃণা’ ছবিটি ১৯৯৪ সালে মুক্তির প্রথম সপ্তাহে সিলেটের নন্দিতা সিনেমায় আমরা কয়েক বন্ধু উপভোগ করেছিলাম । ছবির গল্পটি খুব সংক্ষেপে আপনাদের বলছি –

নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে রুবেল । যার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত কেরানী ও মা গৃহিণী। পরিবারে আরও আছেন রুবেলের বিধবা বড় বোন রোজি আফসারি ও তাঁর একমাত্র কিশোর ছেলে এবং বিবাহযোগ্য ২ ছোট বোন । আর্থিক ভাবে সচ্ছল না হলেও পরিবারটির মাঝে সুখের কোন অভাব ছিল না। সবাই মিলেমিশে দারুন একটি সুখী পরিবার। এই সুখী পরিবারের ছেলেটি একদিন একজ তরুণীর (চম্পা) প্রেমে পড়ে যার বাবা শহরের ধনাঢ্য ও খুব প্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক নেতা বা গডফাদার হুমায়ূন ফরিদি। হুমায়ূন ফরিদির সব কাজের বিশ্বস্ত সঙ্গি বা ডানহাত হলেন এটিএম শামসুজ্জামান। হুমায়ূন ফরিদি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না তাঁর মেয়ে এমন ছোটলোকের সঙ্গে প্রেম করবে । তাই তিনি প্রথমে মেয়েকে শাসালেন কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না। এরপর মেয়ের কথামতো রুবেল’কে মেনে নিলেন। রুবেলের পরিবারের কাছে গিয়ে ফরিদি হাত জোড় করে নিজের মেয়ের সুখের জন্য রুবেল’কে ভিক্ষা চাইলেন। রুবেলের পরিবারও সম্মানিত লোকের সম্মান রক্ষা করলেন । এরই মাঝে ঘটে যায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা । ফরিদির অনুরোধে রুবেল আসলেন ফরিদির বাড়ীতে জিদি চম্পাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য কারণ রুবেল’কে মেনে নেয়ার দাবীতে নিজঘরে নিজেকে কয়েকদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছেন এবং কদিন ধরে এক ফোঁটা পানিও চম্পা পান করেনি।

মেয়ের জিদের কাছে হেরে গিয়ে ফরিদি রুবেল’কে নিয়ে এলেন। সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো। রুবেল যেই মুহূর্তে ফরিদির বাসায় চম্পাকে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছেন সেই মুহূর্তে অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে রুবেলের পরিবারের সব সদস্যকে থানায় ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। রুবেল বাড়ি ফিরে ঘটনা জানতে পেরে থানায় গেলেন এবং নিজেও গ্রেফতার হলেন । পরেরদিন চম্পার সাথে ফরিদি থানায় গিয়ে ফরিদির জিম্মায় বের হয়ে আসে রুবেল সহ পুরো পরিবার। কিন্তু ফিরলে কি হবে প্রতিবেশিদের কাছে ও সমাজের কাছে এতদিনের রুবেলের পরিবারের যে সম্মান ও শ্রদ্ধা ছিল সেটা ভেঙ্গে গেলো। অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে গ্রেফতার হওয়া পরিবারের সাথে সম্পর্ক ঠিক হবে না সেটা ফরিদি চম্পাকে বুঝাতে লাগলেন কিন্তু চম্পা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না, সব ষড়যন্ত্র /বানোয়াট বলে প্রত্যাখ্যান করলো । ফরিদি এবারও মেনে নিলো ।

যে দুজন অপরিচিত যুবকদেরসহ রুবেলের পরিবারকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের চেহারা রুবেল চিনে রেখেছিলেন এবং বড় বোন রোজী’র কাছ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তিনি দুই যুবককে খুঁজতে লাগলেন । সেদিন সন্ধ্যায় কি একটা কাজে রুবেল ঘরের বাহিরে গিয়েছিলেন কিন্তু ফিরে এসে বাড়ি ফিরেই রুবেল দেখেন তাঁর পরিবারের সবাই প্রতিবেশি ও সমাজের অপমান ,অপবাদ সইতে না পেরে সবাই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন । রুবেল মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রুবেলের পাশে এসে দাঁড়ায় রুবেলের চার ছাত্র যারা রুবেলের কাছে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ।খুঁজতে থাকা সেই অপরিচিত দুই যুবকদের পেয়ে গেলেন এবং জানতে পারলেন ঘটনার পেছনে কে দায়ী ।রুবেলের সাথে চম্পার যোগাযোগ বন্ধ। রুবেল ও তাঁর ছাত্ররা এর মধ্য পথের মাঝে দিনে দুপুরে ফরিদির লোকজন আক্রমণ করলো রুবেলকে মেরে ফেলতে এবং যে মুহূর্তে গাড়ী চাপা দিয়ে রুবেলকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটাতে যাবে সেই মুহূর্তে চম্পা এসে সামনে হাজির । চম্পাকে দেখে এটিএম শামসুজ্জামান গাড়ী ঘুরিয়ে চলে যান । রুবেল বেঁচে যায় । চম্পার অনুরোধে রুবেলের ছাত্ররা চম্পাকে রুবেলের আস্তানায় নিয়ে আসেন এবং রুবেল সব ঘটনা খুলে বলেন । সেই যে চম্পার বাসায় ফরিদির অনুরোধে রুবেল যাওয়ার পর দুই অপরিচিত যুবকসহ তাঁর পরিবারকে থানায় নিয়ে যাওয়া সব ছিল ফরিদির সাজানো যার উদ্দেশ্য ছিল কোনভাবে যদি চম্পাকে রুবেলের কাছ থেকে সরানো যায় । সব শুনার পর ও পূর্বের কিছু ঘটনা মনে করে বাবা ফরিদির উপর চম্পার ‘ঘৃণা’ শুরু হয় । চম্পা ও রুবেল বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছে । ফরিদির বিরুদ্ধে শুরু হয় রুবেল ও চম্পার প্রতিশোধ নেয়া যা নিয়ে ছবিটি এগিয়ে যায় এবং ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা যা ছিল মৃত্যুর আগে ফরিদির ৬ বার মৃত্যুবরণ করার মতো ঘটনা এবং ফরিদিকে জীবন্ত লাশ হিসেবে শেষবার মুখোমুখি করার পালা ।।

উপরের গল্পটি শুনে কি বুঝলেন? ‘জিরো ডিগ্রি’ ছবির থিমের সাথে মিলে যাওয়া ‘’প্রেম,প্রতারণা ও প্রতিশোধ’’ গল্প কিনা বলুন তো? মাহফুজ আহমেদ ও অনিমেইশ আইচের ‘’জিরো ডিগ্রি’’ থেকেআজ থেকে ২৫ বছর আগে নির্মিত ‘’ঘৃণা’’ ছবিকে আমি যোজন যোজন এগিয়ে রাখবো । তাঁর কারণ ‘’ঘৃণা’’ ছবির গল্প, গান, সংলাপ, চিত্রনাট্য কিছুই কোন দর্শকের মাথার উপর দিয়ে যায়নি । এমনকি ‘ঘৃণা’ ছবিটির পরতে পরতে থ্রিল থাকলেও দর্শকদের কাছে তা বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছায়নি । একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার যোগসূত্র সার্থক ভাবে পরিচালক মালেক আফসারি উপস্থাপন করেছিলেন । ছবিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিনেমাহলের দর্শকরা চরম উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস প্রহর কাটিয়েছিল। ছবিটা যখন শুরু হয় তার ৩৫/৪০ মিনিট পর্যন্ত সেদিন আমার বুঝতে পারছিলাম না ছবিটার গল্প কোন দিকে যাচ্ছে বা যাবে? কারণ সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। সেই ৪০ মিনিট পর থেকে ছবিটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দর্শকদের টানটান উত্তেজনায় রেখেছিল যা হলভর্তি কয়েকশো মানুষ চরম উপভোগ করেছিল । শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার কিংবা উচ্চবিত্ত কিংবা শ্রমিক মজুর দর্শক সবাই ছবিটি দেখে তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল । ছবির ৫ টি গানের মধ্যে ৩ গানই ছিল দারুন যার সবগুলো আলম খানের সুর করা গান । গল্প,চিত্রনাট্য,নির্মাণ, উপস্থাপন, অভিনয়, গান সবদিক দিয়ে একটি ১০০% বিনোদনধর্মী ছবি ‘’ঘৃণা’’ সেদিন আমাদের মন জয় করেছিল ।

সবশেষে এইটুকু বলবো আজ যারা বাংলা চলচ্চিত্র কাজ করতে এসে চাপাবাজি করেন বা দর্শকদের হলে টানতে বাহারি কথা বলেন তাঁরা আমাদের বর্তমান শিক্ষিত তরুন শ্রেণীর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে তা খুব ভালোভাবে করতে পারছেন ও করে যাচ্ছেন । এসব বাহারি ধুনফুন চাপাবাজি না করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’কে সত্যি ভালোবেসে বাণিজ্যিক ধারার ভালো ছবি নির্মাণ করুন দর্শক এমনিতেই হলে যাবে। আর তা নাহলে এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি পরিপূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত না হয়ে উপায় থাকবে না।


মন্তব্য করুন