Select Page

প্রেয়সী সাধনা

প্রেয়সী সাধনা

পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি: তোমাকে চাই; পরিচালক: মতিন রহমা; শ্রেষ্ঠাংশে: সালমান শাহ, শাবনূর, শর্মিলী আহমেদ, সুজা খন্দকার, খলিল, আরিফুল হক, অমল বোস প্রমুখ; মুক্তি: ২১ জুন ১৯৯৬।

উল্লেখযোগ্য গান: ভালো আছি ভালো থেকো, তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই, তুমি আমায় করতে সুখী, বাজারে যাচাই করে, কংগ্রাচুলেশন।

প্রথম প্রেমকে ভোলে এ সাধ্য কার?

প্রেয়সীকে ভালোবেসে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় ঘুরে, চাকরি খুঁজে কোনোমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ পেয়ে গেলে নিজের সক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ মেলে। তারপর প্রেয়সীকে বড় মুখ করে বলা ঐ কথাটি – ‘জানো, আমি কাজ পেয়েছি।’ এ কথার সাথে আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদাবোধের সম্পর্ক আছে। পরিবার, মা-বাবা ইত্যাদি মূল্যবোধ তো আছেই। সেসব সমষ্টি করলে প্রেয়সী হয়ে ওঠে ভালোবাসার বৃহৎ সাধনা। সে সাধনার ছবি ‘তোমাকে চাই’। পরিচালক মতিন রহমান তাঁর মেধাকে সহজ-সরলভাবে ব্যবহার করে আবেগধর্মী একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন।’

‘তোমাকে চাই’ নামটি শুনলে প্রথমেই কানে আসবে বোধ হয় প্রেমিকার কথা বলছে। সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রেমিকাই চূড়ান্ত নয় এ ছবিতে। নায়ক সালমান শাহ তার নায়িকা শাবনূরকে পেতে সাধনা করেছে। শাবনূর তার প্রেয়সী। শাবনূরকে ভালোবেসে ঘরের মানুষের সাথে তার মানসিক যুদ্ধ করতে হয়। সে যুদ্ধে হতে হয় ঘরছাড়া এবং তা নিজেরই ইচ্ছায়। ঘর ছাড়ার পর অনেক চাকরি খোঁজার পরে কোনোমতে জীবিকা জোটানোর জন্য ড্রাইভারের চাকরি পায় সালমান। প্রথম উপার্জনের টাকায় শাবনূরকে উপহার দিতে মালা আনে, সাথে মিষ্টি। সেখানে বাধা আসে। বাধা আরো থাকে তবে জেতার অধিকারটি প্রেমিকের থাকে। তাই শেষ পর্যন্ত জিতেই যায় সালমান।শাবনূরকে পায়।

মতিন রহমানকে আবেগী নির্মাতা বললে ভুল হয় না মোটেই। তিনি সালমান-শাবনূরকে প্রেমের জালে বেঁধে শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা, আবেগকে দেখাননি। দেখিয়েছেন মা-বাবা, বাড়ির কাজের লোক তাদের নিয়েও। যে পরিবারটি ছেড়ে এসেছে সালমান সেখানে মা শর্মিলী আহমেদ, বাবা খলিল, কাজের লোক সুজা খন্দকার আছে।তারা সবাই তাকে ভালোবাসে। বাবার অভিমান বা রাগ আছে তার পেছনে বংশমর্যাদা বা আত্ম-অহংকার আছে।ভালোবাসাও আছে। মা ও সুজা খন্দকার সালমানের জন্য চোখের পানি ফেলে।ওদিকে প্রেয়সী শাবনূর ও তার বাবা দুজনের ভালোবাসাও আছে। আবেগের ধরণগুলো দেখা যাক—

* বাবা খলিল সালমানকে ফিরিয়ে আনতে যায় গ্যারেজে। কিন্তু সালমান ফেরে না। তার লক্ষ্যে সে হারতে চায় না। খলিল বাড়ি ফিরলে মা শর্মিলী দোষারোপ করে তার জন্যই ছেলে বাড়িছাড়া। সুজা খন্দকার বাড়ি ছাড়তে চায়, ‘আমারে বিদায় করেন। যে বাড়িতে ছোটসাহেবের জায়গা হয় না, সেইখানে আমি থাকব না।’ খলিল বলে, ‘চলে যা’। সঙ্গে থাকে কান্না। সেটা যে মনের কথা ছিল না ঢের বোঝা যায়।

* সালমান শাবনূরের জন্য মালা ও মিষ্টি নিয়ে গেলে রোমান্টিক কথা হয় দুজনের। শাবনূরের, ‘অমন করে বোলো না, আমাকে পাগল করে দিও না’— এ সংলাপ টিনএজ বয়সকে নাড়াতে পারে সহজেই। শাবনূরের বাবা আরিফুল হক মালা, মিষ্টি সব ফেলে দেয় আর বাস্তববাদী হতে বলে সালমানকে। তার কাজ তখনও শেষ হয়নি বলে সচেতন করে। খালি চোখে সেটা খারাপ দেখালেও বাস্তবসম্মত ছিল সেটা। সালমান চলে গেলে ছেঁড়া মালা কুড়াতে কুড়াতে শাবনূর তার আবেগ থেকে বলে, ‘আমি মনের সুতো দিয়ে এ মালা গাঁথব, বাবা।’ এটা পিওর।

* সালমান মা-বাবার দোয়া নেবার জন্য মিষ্টিসহ সুজা খন্দকারকে কৌশলে পাঠায়। সুজা সালমানের কথামতো বলে তার ভাই ভালো চাকরি পেয়েছে তাই দোয়া চায়। খলিল মিষ্টি খেয়ে বলে- ‘বাহ খুব ভালো মিষ্টি তো। দোয়া করি তোর ভাইয়ের উন্নতি হোক।’ সালমান কাঁদে এবং চোখ মোছে। এটাও পিওর ইমোশন।

* মা শর্মিলী আহমেদ ছেলের কষ্ট দেখার জন্য যায়। ছেলেকে রান্না করতে দেখে। সালমান তখন পেঁয়াজ কুটছিল আর চোখ মুছতে থাকে। মা এ দৃশ্য দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদে জানালার ধারে। কান্নার আওয়াজ সন্তানের কানে পৌঁছবে না তা তো হয় না। ছেলে ঠিকই আবিষ্কার করে মাকে। মা ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে ছেলে যায় না।তাকে তার লক্ষ্যে বিজয়ী হতেই হবে।

আবেগ অনেক। আবেগগুলো প্রেম, প্রেয়সী, পরিবার সবখানে একাকার।

ছোটবেলায় আপনার, আমার স্কিন টাচ মোবাইল বা মেমোরি কার্ডের মতো প্রযুক্তির সাথে যখন দেখা হয়নি তখন ‘তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই’ বা ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’ শুনলেই মস্তিষ্কের কোষ বলে দিত এ তো ‘তোমাকে চাই’ ছবির গান আর ভাসত সালমান-শাবনূরের মুখ। ‘বাজারে যাচাই করে’ কোনো সাধারণ গান নয়। আপনি ভাবতে থাকলে আধ্যাত্মিক অর্থও পেতে পারেন এর মাঝে। ‘ভালোবেসেছ বলে ভালোবাসিলাম’ এ লাইনটি চিরন্তন সত্য। যে সত্যিকার অর্থে আমাকে ভালোবাসে তাকেই আমি ভালোবাসব।

‘তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে’ এ গানের অর্থও গভীর। ‘তুমি যে আমার সেই সুখের জোয়ার/সবুজ হয়ে গো মাটিতে ঢেউ এলে’ লাইন দুটো অসাধারণ। আরো অনন্য লাগে গানের মুখের অংশে থাকা এ লাইনটি দুটি, ‘তোমায় পেয়ে পৃথিবীতে কি আমি পেয়েছি আলো/জ্বেলেছি প্রদীপ সেই আলো জ্বেলে’। প্রেয়সী সাধনার মূলসুর এখানেই। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা থেকে গানে ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ’ গানটির বিশ্লেষণ গভীরভাবে রোমান্টিক আবার বাউল ঘরানার। ‘ঢেকে রাখে যেমন কুসুম/পাপড়ির আবডালে ফসলের ধুম’ লাইনগুলো জীবন সম্পর্কে নিখুঁত দর্শনকে দেখায়। এ গানে সালমান-শাবনূর রসায়ন জাদুকরী। সালমানের সাথে শাবনূরের পাশাপাশি আন্ডাররেটেড শশীর রসায়নও ক্ষণিক সময়ে অসাধারণ হয়ে ওঠে-’কংগ্রাচুলেশন’ গানে। মোটের উপর গানের উপর বেসিস করে ‘তোমাকে চাই’ মিউজিক্যাল ছবিও বটে।

ছবিতে রোমাঞ্চ, ড্রামা, অ্যাকশন সব আছে। ফুল প্যাকেজ বাণিজ্যিক ছবির সব শর্ত মেনে মতিন রহমান তাঁর প্রতিভাকে প্রয়োগ করে জনপ্রিয় ছবিতে পরিণত করেছেন ‘তোমাকে চাই’কে। কথাটা শুনতেও ভালো লাগে, ‘তোমাকে চাই’। চাওয়াটাতে বাস্তবতার স্পর্শ আছে সিনেমায় সেটাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বাস্তবতাকে তুলে ধরতে জাদু ছিল সালমান শাহর অভিনয়; ছিল শাবনূর, খলিল, সুজা খন্দকার, শর্মিলী আহমেদ, অমল বোস সব প্রফেশনাল আর্টিস্টের অসাধারণ অভিনয়। টোটালিটি ছিল সবার পারফরম্যান্সে।

পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিক-প্রেমিকারা সুখী হোক।সব প্রেমিক সফল হোক তাদের প্রেয়সী সাধনা-তে।


মন্তব্য করুন