Select Page

‘বন্ধু’ দেখতে গিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা

‘বন্ধু’ দেখতে গিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা

২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮, রোববার। আমার জীবনে ভয়ঙ্কর একটি অভিজ্ঞতার দিন। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সিনেমা দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আমি লুকিয়ে সিনেমা দেখতাম। আমার মা বাবা ছোটদের সিনেমা দেখা পছন্দ করতো না। বড় হলে সিনেমা দেখার স্বাধীনতা ছিল।

ছোটদের সিনেমা দেখার প্রতি বারণ ছিল। কারণ আমাদের বাসার উত্তর পাশে একশো গজ দূরে ছিল উজালা সিনেমা। কিছু কিছু ছায়াছবির বিলবোর্ড ছিল অশ্লীল। বিশেষ করে অঞ্জু ঘোষকে বিলবোর্ডে বাজেভাবে উপস্থাপন করা হতো।

এইসব বিলবোর্ড ছিল হাতে আঁকা। শিল্পীদের তুলি থেকে শাবানাও রক্ষা পায়নি। দুই রাজকুমার ছায়াছবির বিলবোর্ডে শাবানার অন্তর্বাস স্বচ্ছ পাঞ্জাবি (ফতুয়ার মতো) ভেদ করে দেখা যাচ্ছিল। এইসব বিলবোর্ড খুব বিব্রতকর ছিল।

আমার মা-বাবা কখনো সিনেমা দেখেনি, তাই তারা জানতো না এইসব শিল্পীর আর্ট বাস্তবে সিনেমার পর্দায় শাবানার অন্তর্বাস দেখা যায় না আর অঞ্জু ঘোষের স্তনের উপরিভাগও দেখা যায় না।

‘নরম গরম’ ছায়াছবির বিলবোর্ডে অঞ্জু ঘোষ যেভাবে এক পা উপরে তুলে বিশ্রীভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা শুধুই আর্ট। কিন্তু আমি বড় হবো কবে আর সিনেমা দেখবো কবে? বড় হতে হতে যদি মারা যাই তাহলে?

তাই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করি। আমি নানান কৌশল অবলম্বন করতাম। যেমন আমি স্কুল টিমের গোলকিপার ছিলাম। আমি বিকেলে খেলার জার্সি পরে বের হতাম। মা মনে করতো প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছি।

সিনেমা দেখা শেষে মাঠে গড়াগড়ি খেয়ে আসতাম, যাতে জার্সিতে ময়লা থাকে। সবসময় এক কৌশল করতাম না। একবার-এক কৌশল অবলম্বন করতাম।

সেদিন আমি স্কুলে যেয়ে শুনলাম, ক্লাস হবে না। আমি এই সুযোগ কাজে লাগালাম। আমি বাসায় ফেরত না এসে রঙ্গম সিনেমার দিকে যেতে থাকলাম। রঙ্গম সিনেমায় তখন রাজ্জাক-ববিতা,উজ্জ্বল-অলিভিয়া অভিনীত ‘বন্ধু’ চলছে।

সম্ভবত ১৯৮৪ সালে আমার ভাই একটি পুরাতন ন্যাশনাল ৫৪৩ টুপিস আনে। বিজ্ঞাপন তরঙ্গ, সমাহার, নন্দিতা, দুর্বার অনুষ্ঠানে বন্ধু ছবির সেই গান ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাবো’ শুনতাম।

১৯৮৬ থেকে যদিও আমি সিনেমা দেখা শুরু করি, কিন্তু ‘বন্ধু’ ছবিটি দেখা হয়নি। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে যখন আবার মুক্তি পায় চট্টগ্রামের রঙ্গমে তখন সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতে জেলা পশু হাসপাতাল। পশু হাসপাতালের পেছনে পাহাড়ের নিচে রঙ্গম সিনেমা।, উপরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তর।

আমি যখন কোতোয়ালি মোড় এসে নূর মোহাম্মদ সড়কের ফুটপাথ দিয়ে পশু হাসপাতাল যাচ্ছিলাম। তখন দেখি সড়কের আইল্যান্ডে মাইক বাঁধা সারি সারি। সবাই বলাবলি করছে শেখ হাসিনা ভাষণ দেবে।

আমি রঙ্গম সিনেমায় এসে ফ্রন্ট ক্লাসের টিকেট নিলাম। সাড়ে বারোটায় শো আরম্ভ হলো।

উজ্জ্বল ও অলিভিয়া জমিদার পুত্রকন্যা। ছোটবেলায় দাসীর ছেলে রাজ্জাকের সাথে উজ্জ্বলের বন্ধুত্ব হয়। উজ্জ্বলের মা ছিল না, রাজ্জাকের মাকে মা ডাকতো। কিন্তু উজ্জ্বলের বাবা ও জমিদারের নায়েব পছন্দ করতো না রাজ্জাকের সাথে মেলামেশা। শ্রেণী বৈষম্য আর অহংকার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের বন্ধুত্বের মাঝে।

ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। বড় হয়ে আবার তাদের দেখা হয়, বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়।

উজ্জ্বল নিরহংকারী হলেও বোন অলিভিয়া অহংকারী। অলিভিয়া রাজ্জাককে সহ্য করতে পারে না।

উজ্জ্বলের রাজ্জাকের বাড়িতে যাওয়া ও বন্ধুত্ব পছন্দ করতো না অত্যাচারী নায়েব। কারণ রাজ্জাক ছিল প্রতিবাদী। শুরু হয় কুটচাল-কুটকৌশল। উজ্জ্বল আর রাজ্জাকের মাঝে শুরু হয় শত্রুতা। যে শত্রুতা তলোয়ার যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। রাজ্জাকের মা দুই বন্ধুর শত্রুতার আগুন নেভাতে এসে দুই বন্ধুর তলোয়ারের আঘাতে মারা যায়।

ছবির কাহিনী পুরোটা মনে নেই, আজকাল স্মৃতি আর আমাকে আগের মতো সঙ্গ দিচ্ছে না!

সোয়া তিনটায় সিনেমা শেষ। হল থেকে বাহির হয়ে দেখি সিনেমা কর্তৃপক্ষ পশু হাসপাতাল দিয়ে বাহির হতে দিচ্ছে না। মেথরপট্টি দিয়ে বাহির হতে বলছে।

সবাই বলাবলি করছে শেখ হাসিনার মিটিংয়ে গণ্ডগোল হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের মিছিল থেকে শ্লোগানের আওয়াজ আসছে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

আমি মেথরপট্টির রাস্তা দিয়ে চিনতাম না তবু সবার সাথে যাচ্ছি অজানার উদ্দেশ্যে।

মেথরপট্টি পার হওয়ার পর দেখি বাণ্ডেল রোড। বাণ্ডেল রোডের অনেক নাম শুনেছি, কিন্তু চিনতাম না। বাণ্ডেল রোড দিয়ে সিনেমার দর্শকরা যেদিকে যাচ্ছে আমিও সেদিকে যাচ্ছি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর ভরসা করে।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে কোতোয়ালির মোড় আসি।

কোতোয়ালির মোড়ে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া চলছে। পুলিশ মাঝে মাঝে ফাঁকা আওয়াজ করছে। আবার কখনো মিছিলে লক্ষ্য করে গুলি করছে। পুলিশ পা লক্ষ্য করে গুলি করছে।

আমি রক্তপাত সইতে পারি না। আমার সামনে দিয়ে যখন পায়ে গুলি লাগা দুজন আহত মানুষ নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। একটু পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। যিনি আমার সেবা করছেন তিনি লাল টকটকে সিঁদূর পরা মায়াবতী এক নারী। আমি যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি তখন একজন আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসা কোতোয়ালির পিছে। আমি সুস্থ্ হয়ে বের হয়ে আসি। তারা আমাকে বের হতে দিচ্ছিল না। আমি স্কুল ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসি। কারণ আমার মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি জানেন আমি স্কুলে। বাসায় যেতে দেরি হলে তিনি চিন্তিত হবেন।

আমি আবার এলাম কোতোয়ালির মোড়ে। আমাকে যেতে হবে নিউ মার্কেটের দিকে। কারণ আমার বাসা স্টেশন রোডস্থ উজালা সিনেমার বিপরীতে বদরঝর্ণা পুকুর পাড়ে।

কিন্তু সেদিকে যাওয়া অসম্ভব। সেদিকে পুলিশ ও মিছিলকারীদের মাঝে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হচ্ছে। আমি ফিরিঙ্গি বাজার রোড দিয়ে যেতে থাকলাম। ফিরিঙ্গি বাজার দিয়ে চিনতাম না তবে আমি শুনেছিলাম, এই পথ দিয়ে রাজ বোডিংয়ে যাওয়া যায়। তবে একবার এক ক্লাসমেট সাথে ফিরিঙ্গি বাজার আসি। ওর বাসার পাশে মিনা পাল থাকতো। মিনা পাল নায়িকা হওয়ার পর ঢাকায় বসবাস শুরু করে। যার বাসায় এসেছিলাম তার মা-বাবা মিনা পালকে দেখেছে এবং কথা বলেছে। তবে আমার ক্লাসমেটের তখনো জন্মও হয়নি।

মিনা পালের দেশের বাড়ি বোয়ালখালি। ফিরিঙ্গি বাজার থাকতো। চিত্রনায়িকা কবরীর পূর্বনাম মিনা পাল।

আমি সদরঘাট রোড হয়ে রাজ বোডিংয়ে প্রায় আসতাম। রাজ বোডিং বিলাসবহুল আবাসিক হোটেল। এই হোটেলের সামনে দিয়ে কর্ণফুলী নদীর পাড় আসতাম। নদীর তীর আমার খুব প্রিয়, তাই প্রায় আসতাম।

আমি হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে তেমুহনী মোড়ে এলাম।আমার বামের রাস্তা রাজ বোডিংয়ের দিকে গিয়েছে।

একটু সামনে চৌমুহনী মানে চার চারস্তার মোড়। নিউমার্কেট, সদরঘাট, ফিশারিঘাট, দারোগার হাট এই চার স্থানে যাওয়ার চার রাস্তা।

আমি কারো কাছে জানতে চাইলাম না। মা আমাকে বলতো পথেঘাটে কারো কাছে ঠিকানা না জানতে। যাকে জিজ্ঞাসা করবো সে যদি ছেলে ধরা হয়। তাহলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।

স্কুল ছুটির পর আমি জহুর হকার্স মার্কেট করাচি হোটেলের সামনে শপিং ব্যাগ বিক্রি করতাম। মা আমাকে বাঁধা দিতো। মা মনে করতো আমাকে ছেলে ধরা নিয়ে যাবে। আমি যে বড় হচ্ছি তা মা বুঝতে চাইতো না।

আমি অনেক কষ্ট করে বোঝাতাম। কারণ আমার বাবা অসুস্থ। যে পেনশন পায় তা দিয়ে সংসার চলা খুব কঠিন। তাই আমি নিজের ইচ্ছায় রোজগার করি, যাতে সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারি।

স্কুল থেকে আসার পর আমি যখন জহুর হকার্স মার্কেট যেতাম তখন মা দোয়াদরুদ পড়ে মাথায় আদর করে দিত যাতে আমি কোনোপ্রকার বিপদে না পড়ি।

আমার গন্তব্যে যেতে হবে সদরঘাট রোড হয়ে অমর চাঁদ রোড। তারপর রেলওয়ে পুলিশের ব্যারাকের ভিতর দিয়ে ডকইয়ার্ড (বর্তমানে চট্টগ্রাম নতুন স্টেশন)। ডকইয়ার্ডের পাশেই আমার বাসা।

আমি যখন রাজ বোডিংয়ের সামনে এলাম তখন শুনি নিউ মার্কেটের মোড়ে গণ্ডগোল। তাই সদরঘাট রোড জনশূন্য। আমি তখন সদরঘাট ক্রস করে দারোগার হাট রোডে উঠলাম।

ইসলামি কলেজ এর সামনে এসে পড়লাম আবার বিপদে। কলেজের সামনে মিছিল। মিছিলের পিছনে পুলিশের পিকআপ ভ্যান।

আমি মিছিলের সামনে পড়ে ভয়ে কাঁপতে থাকলাম। আমি রাস্তার পাশে দেওয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মিছিল চলে যাওয়ার পর আমি দারোগার হাট রোড দিয়ে এলাম কামাল গেইট গলিতে। কামাল গেইট গলি দিয়ে এলাম কলেজিয়েট স্কুলের পিছনে। কলেজিয়েট স্কুল ও পিটিআই স্কুলের বাউন্ডারি দেওয়ালের মধ্যখানে সরু গলি। এই গলি দিয়ে আসলাম আইচফ্যাক্টরী রোড।

আইচফ্যাক্টরী নীরব জনশূন্য। রোডের শুরুতে সিটি কলেজ। সিটি কলেজের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তাই আইচফ্যাক্টরী রোড জনশূন্য। রোড পার হয়ে স্টেশন কলোনীতে ঢুকার সময় সিটি কলেজের সামনে গুলির আওয়াজ হয়।

আমি আওয়াজ শুনে কলোনির ভেতরে দিলাম দৌড়। আমার দৌড় দেখে কুকুর করলো ধাওয়া। আমি কুকুর খুব ভয় পাই। এখনো ভয় পাই। আমার এক ভাতিজা মারা গেছে কুকুরের কামড়ে। সেই থেকে আমি কুকুর ভয় পাই। কুকুরের ধাওয়া দেখে আমি ভয়ে আরো জোরে দৌড় দিলাম।

দৌড়ে এক বাসায় ঢুকে গেলাম। যার বাসায় ঢুকলাম, তিনি আমার বাবার জুনিয়র কলিগ ছিল। উনার বড়মেয়ে আমাকে বটলতী স্টেশনের ওভারব্রিজ পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

ওভারব্রিজ পার হয়ে বাসায় এলাম। মা বাসায় ছিলো না। তাই দেরি হওয়ার কৈফিয়ত দিতে হলো না। সেদিন আর জহুর হকার্স মার্কেটে গেলাম না। পরের দিন সন্ধ্যায় বাসার সামনে একজন একটি দৈনিক পত্রিকা পত্রিকা পড়ছিল। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্টার উপরে বড় করে লেখা শিরোনাম, ‘চট্টগ্রাম লালদিঘীর ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশের বর্বরতায় গণহত্যা’।

যে স্থানে চব্বিশজন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সেই স্থানে ‘স্মৃতি ২৪’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরী করা হয়।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন