Select Page

বরাবর স্যার : যে গল্পটা সিনেমা হতে পারত

বরাবর স্যার : যে গল্পটা সিনেমা হতে পারত

সাহিত্য থেকে সিনেমা অনেক হয়েছে পাশাপাশি নাটকও কম হয়নি। অনেক মর্মস্পর্শী গল্প থেকেই নাটক নির্মিত হয়েছে। কিছু কিছু গল্প এমন অাবেদন রাখে যে সেগুলো থেকে সিনেমা নির্মিত হতে পারত কিন্তু হয়নি। নাটকের থেকে সিনেমা দর্শকের কাছে দ্রুত পৌঁছায় এবং স্মৃতিতে লং টার্ম প্রভাব রাখে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘মাননীয় পরীক্ষক মহাশয় সমীপেষু’ গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করেছেন নির্মাতা অাশুতোষ সুজন। গল্পটি পড়ে সচেতন পাঠকের মনে হবে এ গল্পটি একটা সিনেমার জন্য পারফেক্ট।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর গল্প থেকে নির্মাতা অাশুতোষ সুজন নাটকের নাম দিয়েছেন ‘বরাবর স্যার।’ এ নামটিও সিলেক্টিভ এবং অাবেদনমুখী হয়েছে। গল্পটি এক ছাত্রের করুণ জীবনবাস্তবতা নিয়ে রচিত যেখানে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তিন বড় পরিসরে উঠে এসেছে।

নাটক – বরাবর স্যার গল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালক – অাশুতোষ সুজন অভিনয় – পান্থ অাবীর, সাবেরী অালম, জয়া রায়, তারেক মাহমুদ প্রমুখ।

একজন ছাত্র তার জীবনের করুণ গল্প পরীক্ষার খাতায় লিখে যায় প্রশ্নপত্রের কোনো উত্তর না দিয়েই। পুরো উত্তরপত্রে শুধু একটা চিঠি স্যারের বরাবরে। যে স্যার তার খাতাটি কাটবেন তাকে উদ্দেশ করে। ছাত্রটি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে অাসা। তার জীবনচক্র এমনভাবে ঘুরেছে প্রতি পদে পদে বেদনা অাছে। গ্রাম থেকে শহর যখন অাসে সে জানত না ‘ইটের পরে ইট মধ্যে মানুষ কীট।’ অাশ্রয় হয়েছিল প্রথমত যার কাছে পড়তে বসলে সে লোকটি তাকে বিরক্ত করত। সে গল্প ধরত যেখানে অাছে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করার ঘৃণ্য ঘটনাবলি। তারপর যার কাছে এলো সে ছিল অারো ধুরন্ধর। পরীক্ষার ফিলঅাপের টাকা যোগাড় করতে সমস্যা হওয়ায় মালিকের কাছে বলেছিল সমস্যাটা। মালিক বুক চাপড়ে সাহস দিয়ে বলেছিল টাকা সে দেবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। টাকা দিয়েছিল তার বদৌলতে সে ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার খাতা পূরণ করতে বলেছিল। ছাত্রটি রাত জেগে এসব করেছে পরীক্ষার পড়া রেখে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান সব চোখের কোণে এসে অসহ্য যন্ত্রণা দিত তাকে। শুতে গেলে তেলাপোকা এসে গায়ে পড়ত অার ঘুম যেত ভেঙে। এর মধ্যে প্রেম এসেছিল তার জীবনে। মেয়েটি বলেছিল শুধুই বন্ধু হতে হবে তার এর বেশি কিছু না। পরে প্রেম হয়ে যায়। ব্রেকঅাপ হয়ে যায় ছেলেটি সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস নয় এ অভিযোগে। ছেলেটির দাদা মুক্তিযুদ্ধে দেশের পতাকা হাতে করে কচুরিপানার ডোবায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। দাদার মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে সে তেমন কিছু করতে পারেনি সে সুযোগ সমাজ তাকে দেয়নি। এই সমস্ত ঘটনা সে পরীক্ষার খাতায় লেখে। পরীক্ষার পর যখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে তখন রেললাইনে নিজেকে সমপর্ণ করে দেবে অর্থাৎ অাত্মহত্যা করবে সে।

গল্প থেকে নাটকটি যখন নির্মিত হয়েছে একবার ঈদ অনুষ্ঠানমালায় নাটকটি চ্যানেলে দেখতে দেখতে মনে হয়েছে এটা খুব টাচি একটা সিনেমা হতে পারত। হয়তো অনেকে বলবে নাটক হতে সমস্যি কি! না কোনো সমস্যা নয় অামি বলতে চাচ্ছি সিনেমা হলে গল্প ও সিনেমা দুটোই বড় পরিসরে দর্শকের কাছে চলে যেত। তার চেয়ে বড় কথা গল্পটি সিনেমা নির্মাণ ডিজার্ভ করে।

নাটকে ছাত্রটি যখন লিখে যাচ্ছে ডিউটিতে থাকা শিক্ষক/শিক্ষিকারা দেখে যাচ্ছে। পরীক্ষার হলে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো অাছে নাটকে। কেউ মাথা ঘোরালে তাকে সতর্ক করা হচ্ছে, শিক্ষক/শিক্ষিকারা পরস্পরের সাথে কথা বলছে। ছাত্রটি লিখে যাচ্ছে যখন তার পাশে ব্রেকঅাপ হওয়া ঐ মেয়েটিও ছিল। তারা সহপাঠী। নিজের গল্পকে পরীক্ষকের কাছে তুলে ধরার জন্য একাধিকবার সে লিখেছে-‘বিশ্বাস করবেন স্যার’। এ লাইনটি টাচি একটা অাবহ ছিল নাটকে। বিশেষ করে তার জীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে লাইনটা জরুরি ছিল।

তিনটি ধাপে সে উত্তরপত্রে নিজেকে তুলে ধরেছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। যে পরিবারে সে বড় হয়েছে সেখানে অনেক অাশা ছিল ছেলেকে নিয়ে কিন্তু সাধ্য ছিল না তাই শহরে পাঠিয়ে দেয়। যাদের কাছে সে ছিল তারা তাকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। যখন পড়ালেখার খরচ মেটাতে অভাব বাধা হয়ে দাঁড়ায় সে প্রিন্সিপালের কাছে গিয়েছিল বিনা বেতনে পড়ার জন্য কারণ সে সুযোগটা ছিল কিন্তু তাকে দেয়া হয়নি সে সুযোগ। প্রিন্সিপাল বলেছিল সবাইকে তারা সুযোগ দেয় না বোঝা যায় সুযোগের জন্যও অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। সেগুলো ছিল সমাজের বাস্তব চেহারা অার সুযোগসন্ধানীদের চেহারা দেখিয়ে দেয়া। অার খাতার মধ্যে রাষ্ট্রের কাছে যে সুষ্ঠুভাবে বাঁচার, লেখাপড়া করার অধিকার সে বারবার চেয়েছে সেটা ছিল জবাবদিহিতা।

সবচেয়ে অাকর্ষণ করবে ঐ লাইনটি যখন ছেলেটি লিখছে-‘স্যার, অামার অাত্মহত্যাকে কাপুরুষতা বলবেন। না স্যার, না এটা কোনো কাপুরুষতা নয় এ অামার প্রতিবাদ।’ তখন সত্য হয়ে ওঠে সব অাত্মহত্যা কাপুরুষতা থেকে হয় না সেখানে সামাজিক প্রতিবাদও থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্র তা ঠাওর করতে পারে কমই। এরপর ঘণ্টা পড়ে সবার খাতা নেবার পর ছেলেটি শেষ লাইন লিখতে দেরি করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ডিউটিরত শিক্ষিকা। তারপর খাতা দেয় অার ছেলেটি চলে যায় রেললাইনে নিজের শরীরকে বিসর্জন দিতে।

ডিউটিরত অধ্যাপিকা ছিল সাবেরী অালম, ছেলেটি পান্থ অাবীর অার মেয়েটি জয়া রায়। সবার অভিনয় অসাধারণ। নাটকে নেপথ্য কণ্ঠে ছিল অাবৃত্তিকার শিমুল মুস্তাফা।

‘বরাবর স্যার’ গল্প ও নাটক একটা পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার বদলে পরীক্ষককে চিঠির মাধ্যমে জীবনবাস্তবতার কিছু প্রশ্ন রাখার যে অসাধারণ চিন্তা দেখায় সেটা অানকমন। প্রতিবাদ তো অবশ্যই কিংবা সমাজব্যবস্থাকে চপেটাঘাত। গল্প ও নাটকের এ শক্তিই সিনেমার মতো শক্তিশালী মাধ্যমের অাবেদনটা অানে। গল্পটা সিনেমা হতেই পারত।

বরাবর স্যার : প্রথম অংশ

বরাবর স্যার: দ্বিতীয় অংশ

বরাবর স্যার: তৃতীয় অংশ


মন্তব্য করুন