Select Page

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প যা হারিয়েছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প যা হারিয়েছে

(আসিফ নুরানীর ‘হোয়াট পাকিস্তানস ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি লস্ট ইন ১৯৭১’ শিরোনামে লেখাটি ২০১৬ সালে প্রকাশ হয় পাকিস্তানের ডন পত্রিকার ম্যাগাজিনে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশ ও তার প্রভাব সম্পর্কিত নানা বিষয় ওঠে এসেছে এতে। যার পরিমার্জিত অনুবাদ এটি।)

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় যুদ্ধের ঠিক শেষলগ্নে অপহৃত হলো জহির রায়হানের বড় ভাই, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লাহ কায়সার। ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা তাকে সহ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেল, তবে তাদেরকে কোথায় নেয়া হল, তা জানা গেল না। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তান আর্মি। দেশ স্বাধীনের পর, নিজের ভাইকে উদ্ধারে ক্লান্তিহীন চেষ্টা চালিয়ে গেলেন জহির।

জানুয়ারীর শেষ দিকে, বিপদ আঁচ করতে পেরেও, জহির তার ভাইকে খুঁজতে গিয়েছিলেন মিরপুর। সে সময় ঢাকার অদূরে মিরপুর ছিল বিহারী অধ্যুষিত, ওরা যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সক্রিয় সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে নিখোঁজ হল জহির নিজেও।

শুধু লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে নয়, জহির রায়হানকে বিবেচনা করা হতো অখন্ড পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন। ১৯৫৯ সালে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’তে প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে জহির রায়হান হাতে কলমে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার হাত দিয়েই নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪) এবং প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ (১৯৬৫)। পরিচালনা করেছেন ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১) আর ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২) এর মতো শৈল্পিক সব চলচ্চিত্র। চমৎকার নির্মান শৈলীর জন্যে তার ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩) চলচ্চিত্রকে তুলনা করা হয় ভারতীয় বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রগুলোর সাথে। আইয়ুব খানের শাসনামল নিয়ে ব্যঙ্গধর্মী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) নির্মাণ করে কুড়িয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের প্রশংসা।

পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, জহির রায়হানের মত প্রতিভাবান নির্মাতাদের হারানো ছিল তার মধ্যে একটি। দক্ষ আর সৃজনশীল এসব কলা-কুশলী ছাড়াও পাকিস্তানের সিনেমা বঞ্চিত হয়েছিল বিশাল বাজার আর চলচ্চিত্র তৈরীর এক ঊর্বর ক্ষেত্র থেকে। ১৯৭১ এ পাকিস্তান জুড়ে ছিল ৪০০ সিনেমা হল, যার এক-চতুর্থাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভূমিতে। ১৯৭০ সালে শুধু পূর্ব পাকিস্তান থেকেই নির্মিত হয় ১১৪টি চলচ্চিত্র, এর মধ্যে তিনটি ছিল উর্দু।

্রৃ

পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে এই বিপর্যয় নিয়ে চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে যৎসামান্য আলোচনা হলেও এ নিয়ে বিস্তারিত লেখালেখি কখনোই হয়নি। তাছাড়া জেনারেল জিয়াউল হকের এক দশকের সামরিক শাসনামালের নেতিবাচক প্রভাব পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

তবে এত বছর পরেও উর্দু চলচ্চিত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাব আজও যে কারোর মনোযোগ আকর্ষণ করবে।

সময়টা ১৯৬২। সম্ভবত প্রবীণ নির্মাতা এস এম ইউসুফের চলচ্চিত্র ‘আওলাদ’ এ নতুন মুখ ওয়াহিদ মুরাদের পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় ছাড়া উল্লেখ করার মত কিছু ছিল না। একই বছরের আগস্টের ৩ তারিখে তেমন রাখঢাক ছাড়াই মুক্তি পেয়েছিল ‘চান্দা’, যেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়া প্রথম উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র।

ইতোপূর্বে প্রযোজক আনিস দোসানি পূর্ব পাকিস্তানের এহতেশাম আর মুস্তাফিজকে নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও, এই প্রথম তিনি ঢাকাতে এই দুই ভাইকে দিয়ে উর্দু ভাষার কোন সিনেমা নির্মাণ করলেন। যদিও এর আগে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ আর শওকত হাসমির ‘হামসাফার’ (১৯৬০) এর দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে, কিন্তু কার্যত সেগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র।

‘চান্দা’ মুক্তি পেলে, শুরুতে কোন পরিবেশক ছবিটির পরিবেশনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিল না। সে সময় এভারডি ফিল্মস (বর্তমান এভারডি কমিউনিকেশনস) এর স্বত্বাধিকারী জগদীশ আনান্দ ছবিটি পাঞ্জাব এবং এনডাব্লিউএফপি (বর্তমান কেপি)-তে পরিবেশন করতে রাজি হলেন, তবে প্রযোজক আনিস দোসানি ‘কমিশনের ভিত্তিতে’ করাচি, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানসহ অন্যান্য প্রদেশগুলোতে ছবিটি মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

মানুষের মুখে মুখে প্রচারের ফলপ্রসূতার উদাহরণ দিতে গেলে ‘চান্দা’র চেয়ে ভালো কোন উদাহরণ হতে পারে না। মুক্তি পাওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর জনপ্রিয়তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সে সময়কার ঢাকার বাংলা চলচ্চিত্রগুলোর মত, এটা ছিল নান্দ্যনিকতার দিক থেকে অত্যন্ত উচু মানের। চমৎকার প্রেক্ষাপট ছাড়াও দুর্দান্ত অভিনয় আর সাবলীল সংগীত সিনেমাটিকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। প্রথমদিকে দর্শকের খুব বেশি সাড়া না মিললেও পরে অবশ্য কোন কোন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি সিলভার জুবিলি (প্রেক্ষাগৃহে টানা পঁচিশ সপ্তাহ) সম্পন্ন করে। সিনেমার অপ্রধান নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন নবাগত ঝর্ণা, যিনি পরবর্তীকালে দর্শকদের কাছে পরিচিতি লাভ করে সুপারস্টার শবনম নামে। ‘চান্দা’ সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা সহ-অভিনেত্রী বিভাগে জিতে নেন সম্মানজনক নিগার এ্যাওয়ার্ড, আর সেরা কমেডি চরিত্রের খেতাব পেয়েছিল সুভাষ দত্ত।

এর মাত্র এক বছর পর ‘তালাশ’ ছবিটি নির্মাণ করে আরো বড় সফলতা পেল প্রযোজক আনিস দোসানি। শবনম-রহমান জুটির এই সিনেমায় সঙ্গীত আয়োজন করেছিলেন রবীন ঘোষ। সে সময়কার জনপ্রিয় সব ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোকে পেছনে ফেলে একটানা পঞ্চাশ সপ্তাহ চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহে। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ঢাকার মাটিতে এফডিসি স্থাপন চলচ্চিত্রে এক নব দিগন্তের সূচনা করল। আধুনিক নানা সুযোগ সুবিধার সাথে যুক্ত হল ফিল্ম প্রসেসিং ল্যাবরেটরি। এর ফলে ১৯৬৩ সালে যেখানে মাত্র পাঁচটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল, এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৬-তে। এর মধ্যে সাতটি ছিল উর্দু ভাষার। এর মাত্র এক বছর পর নির্মিত হল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র, ‘সঙ্গম’। একই সময়ে ঢাকা থেকে মুক্তি পেল জহির রায়হানের ওয়াইডস্ক্রিন চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ এবং দোসানি-এহতেশাম-মুস্তাফিজ এর ‘মালা’, যেটা ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন ওয়াইডস্ক্রিন চলচ্চিত্র।

জহির রায়হানের সিনেমায় সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন খান আতাউর রহমান। গুণী এই ব্যক্তি খান আতা নামেই ছিলেন সমধিক পরিচিত। শুধু সঙ্গীত নয়, প্রযোজনা থেকে শুরু করে তিনি ছিলেন একজন সফল পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সুরকার এবং একই সাথে একজন অভিনেতা। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে তার ছিল অসামান্য অবদান। তার নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৭) এবং ‘সোয়ে নাদীয়া জাগে পানি’ (১৯৬৮), এগুলো বাংলা-উর্দু উভয় ভাষাতেই মুক্তি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলা চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ঘটল নায়িকা কবরীর। যদিও তিনি উর্দু জানতেন না। খান আতা অবশ্য তার বন্ধুকন্যা- সে সময়ের জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী নাজমা নিয়াজীকে এনে কবরীর কন্ঠ ডাবিং এর ব্যবস্থা করেন।

১৯৬৯ এর দিকে পূর্ব পাকিস্তানে ‘শহীদ তিতুমীর’ নামে আরেকটি দোভাষী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। দোভাষী হলেও, সংলাপের দিক থেকে এটা অবশ্য পূর্বের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মত ছিল না। মূলত সংলাপে বাংলা-উর্দু মিশ্রিত থাকায় বাঙ্গালিদের একটি অংশ সিনেমার গল্প বুঝতে ব্যর্থ হয়, একই ঘটনা ঘটে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রেও। ফলে চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে আর সাড়া ফেলতে পারেনি। এভাবে চলচ্চিত্রটির ব্যবসায়িকভাবে চরম অসফল হওয়ার পেছনে সংলাপের এ জটিলতাকেই দায়ী করেন অনেকে।

লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল নব্য-বাস্তববাদী ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, যার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। চলচ্চিত্রটির গীতিকারও ছিলেন তিনি নিজেই। তারা ভারতীয় সিমফনি অর্কেস্ট্রার জনক হিসেবে পরিচিত কলকাতার তিমির বরণকে দিয়ে সঙ্গীত করাতে চেয়েছিলেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল পি সি বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ (১৯৩৫)। বরণ এর আগে দুটি করাচি ভিত্তিক চলচ্চিত্র – ‘আনোখি’ ও ‘ফাঙ্কর’ (দুটিই ১৯৫৬ সালের)-এর সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন – তন্মধ্যে জনপ্রিয় গান ছিল “গারি কো চালানা বাবু”। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পেল খান আতা আর জুরাইন রাখসী, অন্যদিকে প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কলকাতার মঞ্চ তারকা তৃপ্তি মিত্র। পরিচালক এ জে কারদার এবং প্রযোজক নুমান তাসির দুজনেই লাহোরের হলেও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রতিভাধর কিন্তু চলচ্চিত্রে নবাগত জহির রায়হানকে বেছে নিলেন।

পূর্বেই বলা হয়েছে, জহির রায়হান ছিলেন মেধাবি এবং তিনি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটি হল জহির রায়হানের বাংলা চলচ্চিত্রগুলো ছিল শিল্পগুণ বিচারে অত্যন্ত উচু মানের। পক্ষান্তরে তার উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রগুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধাচের। ধারণা করা হয় উর্দু ভাষার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলো তিনি বানিয়েছিলেন বস্তুত নান্দ্যনিক এসব বাংলা চলচ্চিত্রগুলোতে অর্থ সংস্থানের ভাবনা থেকে।

লেখক মুস্তাক গজদার তার বিখ্যাত বই ‘পাকিস্তানি সিনেমা ১৯৪৭-১৯৯৭’ তে উল্লেখ করেছেন, ‘চান্দা’ চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে জহির রায়হানের পরিচালিত ‘জ্বলতে সুরাজ কে নিচে’, সব মিলিয়ে ৪৭ টি উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত হয়। যার সবগুলো মুক্তি পেয়েছিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। চলচ্চিত্র নির্মান ব্যয় তুলনামুলক কম হওয়ায়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য ঢাকা ছিল সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। যেমন সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় অভিনেতা ওয়াহিদ মুরাদ বা মোহাম্মদ আলি যে পরিমান পারিশ্রমিক নিতেন, তার সামান্য একটি অংশই যথেষ্ট ছিল সিনেমায় খান আতাউর রহমানকে কাস্টিংয়ের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত এসব উর্দু চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘বন্ধন’, ‘মিলন’, ‘ইন্ধন’, ‘সঙ্গম’, ‘কাজল’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ এবং ‘চকোরী’।

সুরুর বারা বাঙ্কভী, যাকে ‘চান্দা’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীতায়োজনের অপরাধে চাকরিচ্যুত করা হয়, পরবর্তীকালে ঢাকায় নির্মিত অধিকাংশ চলচ্চিত্রের সঙ্গীতায়োজন করেছেন এবং পরিচালনা করেছেন দুটি চলচ্চিত্র। যার একটি ‘আখেরি স্টেশন’ (১৯৬৫), নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত উর্দু লেখক হাজরা মাসরুর এর লেখা গল্প অবলম্বনে, যা নন্দিত সিনেমা হিসেবে সে সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। চলচ্চিত্রে শবনম একজন মানসিক প্রতিবন্ধীর ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করেন। ‘আখেরি স্টেশন’ চলচ্চিত্রে তার অভিনয় এতটাই সাবলীল ছিল যে, পরবর্তী অনেক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয়ের সেই ধারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। অবশ্য এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, তার সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল, “আমি আমার পুরো কর্মজীবনে এমন কঠিন চরিত্রে অভিনয়ের দ্বিতীয় সুযোগ পাইনি”।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে রুপালি পর্দার তারকারা তৎকালীন পাকিস্তানের উর্দু-বাংলা উভয় চলচ্চিত্রেই অভিনয় করতেন। তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই উর্দু চলচ্চিত্রে কাজ করতেন, তবে ১৯৭০ সালে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘মিশর কুমারী’তে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন শামীম আরা, এবং এর আগে জুবেদা খানুম ‘আজান’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রের জন্য একটি বাংলা গান রেকর্ড করেন। বাংলাদেশি অভিনেত্রী নাসিমা খান অভিনয় করেছেন বাংলা আর উর্দু ভাষার জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে। এমনকি ১৯৬৯ সালে লাহোর থেকে মুক্তি পাওয়া ‘গীত কাহিঁ সঙ্গীত কাহিঁ’ চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন সে সময়কার জনপ্রিয় অভিনেতা মোহাম্মদ আলির সাথে।

আর একজনের কথা এখানে উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে না। তিনি হলেন গায়ক বশির আহমেদ (১৯৩৯-২০১৪), তার উর্দু উচ্চারণে ছিল দারুণ দক্ষতা। বাংলা-উর্দু উভয় ভাষাতেই গান গেয়েছেন, সুর করেছেন কিছু চলচ্চিত্রের জন্যও, মাঝে মাঝে বি এ দীপ ছদ্মনামে উর্দু গানও লিখতেন। তিনি ছিলেন কলকাতার বাসিন্দা, বিয়ে করেন এক বাঙালি নারীকে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।
পাকিস্তান যখন বিভক্ত হল, সে সময়কার যাদুকরী কন্ঠশিল্পী ফেরদৌসী বেগমও থেকে গেলেন ঢাকাতে। অন্যদিকে সুরকার মুসলেহউদ্দিন, যিনি তার সঙ্গীত প্রতিভার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি তার স্ত্রী নাহিদ নিয়াজী’কে নিয়ে লন্ডনে স্থায়ী হলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর যারা ঢাকা থেকে পাকিস্তানে ফিরে আসে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে আসন্ন ক্ষতি নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন না। এর মধ্যে অন্যতম নকী মুস্তাফা, যিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনার জন্য পেয়েছিলেন নিগার এ্যাওয়ার্ড।

প্রযোজক আনিস দোসানি, যাকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ, তিনিও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আলাদা হওয়াকে মেনে নিতে পারেননি। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি তার চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত রেখেছিলেন। পরিচালক পারভেজ মালিককে সাথে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘আনমল’ (১৯৭৩), ‘পেহচান’ (১৯৭৫), ‘তালাশ’ (১৯৭৬) এবং ‘গুমনাম’ (১৯৮৩) এর মত বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র।

পরিচালক নজরুল ইসলাম (১৯৩৯-১৯৯৪), এই নির্মাতা এসেছিলেন কলকাতা থেকে এবং ভাঙা ভাঙা উর্দু বলতে পারতেন, স্বাধীনতার পর তিনিও ঢাকার চেয়ে লাহোরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন উত্তর প্রদেশের মানুষ, কথা বলতেন উর্দুতে। নিরাপত্তার কারণে স্বাধীনতার পর তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে লাহোর চলে যান। নজরুল ইসলাম, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি পরিচিত ছিলেন দাদা নামে, তার হাত ধরে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু সফল চলচ্চিত্র ‘এহসাস’ (১৯৭২), ‘বন্দিস’ (১৯৮০) এবং ‘নহিঁ আভি নহিঁ’ (১৯৮০)। তার সবচেয়ে ব্যবসা সফল কাজ ছিল ১৯৭৭ এ নির্মিত ‘আয়না’ চলচ্চিত্র, যেটি দীর্ঘ আট বছর বিরতি ছাড়াই হলগুলোতে প্রদর্শিত হয়েছিল। সেরা পরিচালক হিসেবে তিনবার অর্জন করেছেন নিগার এ্যাওয়ার্ড।

সে সময়ের দুটি মজার তথ্য এখানে উল্লেখ করা দরকার। অভিনয় শিল্পী নাদিম, যিনি ছিলেন মূলত করাচির, অভিনেতা আর গায়ক হিসেবে তার অভিষেক হয়েছিল ঢাকায় চলচ্চিত্রে। অন্যদিকে, বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও শিল্পী রুনা লায়লা, প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক এর সুযোগ পান পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ‘হাম দোনো’ (১৯৬০)-তে। তখন তিনি স্কুলে পড়েন। অবশ্য ১৯৭৪ এর দিকে তার সরকারি কর্মকর্তা বাবা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সে সময়ে চলচ্চিত্রে সেরা নারী নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দুটি নিগার এ্যাওয়ার্ড জিতে রুনা লায়লা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম সারির একজন শিল্পী। যার একটি জিতেছিলেন ১৯৬৮’তে মুক্তি পাওয়া ‘কমান্ডার’ আর অন্যটি ছিল ‘আঞ্জুমান’ চলচ্চিত্রের জন্য। পরবর্তীকালে ভারত এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্যে তিনি গান গেয়েছেন। দেশের কনসার্টগুলোতে তার গাওয়া বিখ্যাত গান হল “শাহবাজ কালান্দার”, যার জন্য প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি।

গায়িকা হিসেবে শাহনাজ বেগমের নাম কখনোই মলিন হবার নয়। ‘৭০ এর দশকের শুরুতে সিনেমায় গাওয়া তার গানগুলো আজও যে কাউকে মুদ্ধ করবে। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকায় ফিরে যান। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে ষড়ষন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল। অবশ্য শেষদিকে সঙ্গীত থেকে দূরে সরে যান তিনি, গুটিয়ে ফেলেন নিজেকে।

একথা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে, বাংলাদেশ আলাদা হবার পর পাকিস্তানের চলচ্চিত্রও তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। হয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্য আর সৃজনশীলতা এর বহু বছর পরেও পাকিস্তানের চলচ্চিত্রকে প্রভাবিত করেছে। তবে সুদীর্ঘ ৪৫ বছরের বিচ্ছেদের পর আমাদের স্বীকার করতে হবে, সাংস্কৃতিকভাবে আমরা আজ দীনহীন। শুধু রাজ্য নয়, ৭১ আমাদের থেকে অনেক কিছুই নিয়ে গেছে।


মন্তব্য করুন