Select Page

বাংলা সিনেমায় আফগান নায়ক ওয়াহিদ কাদের

বাংলা সিনেমায় আফগান নায়ক ওয়াহিদ কাদের

 ‘বন্দিনী’ সিনেমার সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না’ এ গানটি শোনেননি এমন বাংলাদেশি শ্রোতা কম পাওয়া যাবে। সেই গানের ভিডিও দেখলে এ সময়ের অনেকে চমকে গিয়ে ভাবতে পারেন, ববিতার সঙ্গে এ বিদেশি নায়কটা কে! সাম্প্রতিক সময়ে তাকে নিয়ে সংবাদপত্রে লিখেছেন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। তার লেখা অবলম্বনে আরও একটি লেখা (রেহনুমা পারভিনের) পাওয়া অনলাইনে। সেখান থেকেই অল্প রদবদল করে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।

১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া মুশতাক পরিচালিত ‘বন্দিনী’র হন নায়ক ওয়াহিদ কাদের। যিনি বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের নন। আফগানিস্তানের!

সুদর্শন, ছয় ফুট লম্বা ও ২২ বছর বয়সী ওয়াহিদ কাদের বাংলাদেশে এসেছিলেন আফগান রাষ্ট্রদূত বাবা ও মায়ের সাথে। কাবুলে ১৯৫৪ সালের দিকে তার জন্ম। রাষ্ট্রদূত বাবার কল্যাণে ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। পশতু, ইংরেজি, ফারসি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও হিন্দি ভাষার পাশাপাশি চমৎকার বাংলাও বলতেন তিনি।

বাংলাদেশে এসেই ওয়াহিদ মডেলিং শুরু করেন। ওই সময় পরবর্তী ছবির জন্য পরিচালক মুশতাক এমন একজনকে খুঁজছিলেন যাকে আমেরিকা ফেরত একজন ইমিগ্রান্টের ভূমিকায় মানানসই। ওয়াহিদকে দেখেই তিনি অডিশনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। অডিশনে ওয়াহিদের পারফরম্যান্সে মুস্তাক খুব খুশি হন। আর ১৯৭৬ সালে ‘বন্দিনী’ মুক্তি পেলে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। ‘ইশারায় শিস দিয়ে ডেকো না’র সঙ্গে ছবিতে ছিল বিখ্যাত ‘সাধের লাউ বানালো মোরে বৈরাগী’ গানটি।

তবে এ ছবির পর ওয়াহিদ আর অভিনয় করেননি। এর কারণও স্পষ্ট নয়। এরপর ১৯৮০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। সেখানে সিকিউরিটি বিজনেসে একটা চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিলেন। এর একমাসের মাথায় এবিসি নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় সিরিজ ‘জেনারেল হসপিটাল’-এ অভিয়ের সুযোগ পান। কিন্তু সদ্য বিবাহিত এবং সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদ চাকরি ছেড়ে শোবিজে জড়িয়ে পড়াটা হয়তো তার নিরাপদ মনে হয়নি।

ওয়াহিদ আমেরিকায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করে তার শ্রম আর মেধা খাটিয়ে ১৯৯১ সালে একটি সিকিউরিটি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৯৭ সালে নিজেই সিকিউরিটি বিজনেস শুরু করেন এবং ইউএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসের সিইও হিসেবে বড় বড় কোম্পানিতে সার্ভিস দেওয়া শুরু করেন।

২০০১ সালের শেষ দিকে তার ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামে, এক বছরের মধ্যে তিনি তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন। মানসিকভাবে ভীষণ চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ও অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে যান। আর এই অবস্থায় স্ত্রী ও তিন ছেলের সংসারের দেখভাল করতে গিয়ে তিনি হিমশিম খেতে থাকেন। এক সময় তার স্ত্রী রোনা আর বড় ছেলে ম্যাথিউ ক্লায়েন কাদের কাজ করতে শুরু করেন। ওয়াহিদ নিজেও আবার নতুন করে কোম্পানি শুরু করেন।

ওয়াহিদের সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য পরিবার তার এই দুঃসময়ে তাকে কোন ধরনের সহযোগিতা করেননি। তার মা ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে তাদের বিশাল সম্পত্তি তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে আসেন, তার ছোট ছেলেকে ব্যবসা করতে টাকাও দেন; কিন্তু বড় ছেলে ওয়াহিদকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করেন! এ ঘটনায় ওয়াহিদ ভীষণ মর্মাহত হন!

অর্থাভাবে ওয়াহিদকে তার পরিবার নিয়ে বিশাল সুইমিংপুলওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট দু’রুমের এপার্টমেন্টে এসে উঠতে হয়। তিনি ক্রমশঃ বিষাদে ডুবে যেতে থাকেন এবং একসময় এই দুঃসহ জীবনের কাছে হার মানেন। অসম্ভব অভিমান নিয়ে তিনি তার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে লিখে যান তার শেষ চিঠি-

“আমি কারো মাথাব্যাথার কারণ হতে চাইনা। আমার দেহটি তোমরা পুড়িয়ে দিও! আমি অলরেডি দরদাম দেখে রেখেছি। মাত্র ৮০০ ডলার লাগবে! আমাকে কবর দিতে যেওনা, অনেক খরচের ব্যাপার। আমি তোমাদের আর কোন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনা! আমার স্ত্রী আর তিন সন্তানকে আমি অনেক ভালোবাসি, কিন্তু আমার যাবার সময় হয়ে গেছে।”

২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫০ বছর বয়সে ওয়াহিদ আত্মহত্যা করেন।

এ দিকে বাবার মৃত্যুর পর ম্যাথিউ পরিবারের হাল ধরেন, তিল তিল করে নিজের কোম্পানি গড়ে তোলেন। মাত্র দশ বছরে তার পরিবার আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বর্তমানে ওয়াহিদের স্ত্রী-সন্তান সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিবার নিয়ে সুখেই আছেন তারা।

তিন ছেলের সঙ্গে ওয়াহিদ কাদের

ওয়াহিদ বড় ছেলের ১৬তম জন্মদিনে তিনি উপহার দিয়েছিলেন ছেলের স্বপ্নের গাড়িটি! বাবা দিবসে ইনস্টাগ্রামে ম্যাথিউ বাবাকে স্মরণ করেন এভাবে, “…যে সময় অন্য শিশুদের স্বপ্নের নায়ক ছিলো কোন খেলোয়াড়, সেলিব্রেটি বা কোন কার্টুন চরিত্র, সে সময় আমার সুপার হিরো ছিলেন আমার বাবা! তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যার দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম! যে তার জীবনে প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন বহুবার, আবার তাকে জয়ও করেছেন বহুবার। যিনি তার পরিবারকে ভীষণ ভালোবাসতেন! যিনি আমাকে বলেছিলেন যে কঠিন পরিশ্রন করলে আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে আমি জীবনে যেকোন কিছু হতে পারব! যে মানুষটি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মানুষ হতে হয়! যে মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে অসম্ভব বেদনায় ডুবে ছিলেন, যে মানুষটির দুঃখগুলো আমি ভাগাভাগি করে নিয়েছি। যার বেদনা আমি নিজের অন্তর দিয়ে অনুভব করেছি! এই মানুষটিকে বাবা ডাকতে পারার জন্য আমি গর্বিত!…”

ইনস্টাগ্রামে নিজ সন্তানের জন্মের মুহূর্তে বাবাকে স্মরণ করতে গিয়ে ম্যাথিউ বলেন, “তিনি আমাদের ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছেন, কিন্তু আমি তার নাম ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবো আজীবন। তার মৃত্যুদিন থেকে আমি কাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছি। আর এখন আমি আমার নিজের ছেলের বাবা হতে যাচ্ছি, যাতে আমরা তার রাজবংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।”

ওয়াহিদের মেঝো ছেলে ইয়ামা কাদের ক্যালিফোর্নিয়া বসবাস করছেন। ছোট ছেলে যোসেফ কাদের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হয়ে আফগানিস্তানে কাজ করেছেন। ২০১৭ সাল নাগাদ যখন ওয়াহিদ কাদেরকে নিয়ে লেখাজোখা হচ্ছিল বাংলাদেশে তখন তার স্ত্রী রোনা ছোট ছেলের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকতেন।


মন্তব্য করুন