Select Page

বানুর আসলে কী হয়েছিল?

বানুর আসলে কী হয়েছিল?

বানু (রিক্তা) ও আলতা (জাকিয়া বারী মম)

গত বছরের ২০ এপ্রিল হাতেগোনা কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল অরুণ চৌধুরী পরিচালিত প্রথম ছবি “আলতা বানু“। মুক্তির আগে সিনেমার যথাযথ প্রমোশন না হওয়ায় এবং গুটিকয়েক হলে মুক্তি দেওয়ায় খুব কম মানুষই এছবি বড়পর্দায় উপভোগ করতে পেরেছে। পরবর্তীতে অবশ্য সিনেমাটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অবমুক্ত করা হয়।

সিনেমাটি নিয়ে বেশিরভাগ দর্শকের কাছেই একটা কমন অভিযোগ পাওয়া যায়। ঠিক অভিযোগ না, অতৃপ্তি বলা যায়। সেটা হলো, এ ছবি শেষাংশে কী হলো তা পুরোপুরি বোঝা গেলো না। বানুর আসলে কী হয়েছিল…

এরকমটা হওয়ার কারণ হলো ছবির শেষাংশ দর্শকদের জন্য খোলা রাখা হয়েছে, কোনো পরিণতি দেখিয়ে গল্পের উপসংহার টানা হয়নি। এক্ষেত্রে দেখা যায় দর্শক চিন্তাভাবনা করে এর পেছনের কারণ খুজেঁ বের করে, দর্শকই হয়ে ওঠে এগল্পের ইতি টানার কারিগর। বাইরের দেশের ছবিগুলোতে এরকম ‘ওপেন এন্ডিং’ অহরহ দেখা গেলেও আমাদের দেশের দর্শকদের জন্য এরকম কনসেপ্ট এখনো নতুনই বলা যায়।

“আলতা বানু” ছবিটি আমি প্রায় দেড় বছর আগে দেখেছি। স্পয়লারের আশঙ্কায় তখন এ ছবির গল্প নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ দেইনি। এদিকে আগামীকাল অরুণ চৌধুরীর দ্বিতীয় ছবি “মায়াবতী” মুক্তি পাচ্ছে। তো এখনই ভালো সময় “আলতা বানু” গল্প নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা, এবং বানুর সাথে কি হয়েছিল সেটা খুজেঁ বের করা…

তো ছবির শেষদিকে দেখা যায়, আলতা অর্থাৎ মম এক পুকুরের ধারে বসে আছে। সে তার শরীরে বহন করা তাবিজ, ব্যাগে থাকা কিছু কাগজপত্রসহ অন্যান্য জিনিস সে পুকুরে ফেলে দিচ্ছে। পেছন থেকে আসা সাবেরী আলম, যিনি এতোদিন আলতাকে সহায়তা করেছে, সে এসে জিজ্ঞেস করলো, আলতা এখানে কী করছে। আলতা উত্তর দিলো, শরীরের ওজন কমাচ্ছে। অর্থাৎ, সে প্রায় একরকম আশা ছেড়েই দিয়েছিল, তার বোন বানুকে আর খুজেঁ পাওয়া যাবে না।

এরপর সাবেরী আলম তাকে বলে, থানায় একটি বেওয়ারিশ লাশ এসেছে। আলতা পুলিশকে আগে তার বোনের যেরকম শারীরিক বর্ণনা দিয়েছিল, এই লাশের সাথে সেগুলোর কিছু মিল পাওয়া যায়। আলতা ও সাবেরী আলম দুজনেই দৌড়ে থানায় গেলো, ওদিক থেকে আনিসুর রহমান মিলন ও তার চাচাতো ভাই খবর পেয়ে লাশ দেখার জন্য থানায় ছুটে গেলো। পুলিশ ইন্সপেক্টর লাশটিকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার ব্যবস্থা নিতে চাইলে মিলন তাদের কাছে অনুরোধ করে একবার লাশটির মুখ আলতাকে দেখানোর জন্য। পুলিশ তাদের কথা শুনে তাদেরকে লাশটি দেখতে দেয়। কিন্তু লাশটির সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। অনেকদিন কোনো জায়গায় পড়ে থাকায় শরীরের অনেক অংশ, বিশেষ করে মুখের অর্ধেক অংশ পঁচে গেছে। তাই লাশটি মিলন কিংবা আলতা কিংবা মিলনের ভাই, যে বানুকে ভালোবাসতো তারা কেউই শতভাগ শনাক্ত করতে পারলো না। দর্শকদেরও দেখানো হয়নি আসলেই ওটা বানুর লাশ ছিল কিনা। কিন্তু এরপরই দেখা গেলো মিলন লাশটির দাফন-কাফন আলতাকে সাথে নিয়ে নিজ দায়িত্বে করতে রাজি হন, পরবর্তীতে তারা লাশটি নিয়ে তাদের গ্রামের দিকে রওনা হন। এক্ষেত্রে দর্শক হিসেবে মনে দুটি প্রশ্ন জাগে…

প্রশ্ন -১: লাশটি কি আসলেই বানুর ছিল? না অজ্ঞাত কেউ?
প্রশ্ন -২: মিলন কেন এমনটা করলো? সে কি তাহলে লাশটি শনাক্ত করতে পেরেছিল?

দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর আগে দেই, মিলন প্রকৃতপক্ষে লাশটি শনাক্ত করতে পারেনি। তিনি আসলে আলতার পাগলের মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করার একটা সমাপ্তি টানতে চেয়েছেন। সিনেমাতে তিনি মমকে একটা সময় পর অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেন। তাই তিনি তার ভালোবাসার মানুষকে এভাবে মনের কষ্টে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করা, মানুষের কাছে অপমানিত হওয়া, লাঞ্ছনার স্বৗকার হওয়া আর একদমই সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই তিনি চেয়েছেন মম এই বেওয়ারিশ লাশকেই তার বোন ভেবে কবর দিক, এতে করে অন্তত তাকে মানসিকভাবে সুস্থতা দান করা যাবে। লাশ বহনের সময়, মিলনের সাথে মম এর কথোপকথনে এরকমটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

এবার আসা যাক প্রথম প্রশ্নে, লাশটি কি আসলেই বানুর ছিল? উত্তর হলো, হ্যাঁ। ওটা বানুর ই লাশ ছিল। ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, লাশটি পরনে কালো পায়জামা ছিল। মিলনের চাচাতো ভাই সাবেরী আলমকে যখন ভিলেজ পলিটিক্স করা আরমান ও বানুর মধ্যকার ঘটনাবলী বলে তখন ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, সবশেষ ঘটনায় বানুর পরনে ছিল সেই হালকা সবুজাভ চাদর যেখানে লাল সুতায় সেলাই করে ‘আলতা বানু’ লেখা, লাল-কমলাসহ অন্যান্য রং মিশ্রিত সালোয়ার এবং কালো পায়জামা। সিনেমার শেষের দিকে ক্যামেরা বারবার লাশের পায়ের দিকে ফোকাস করছিল। সেহিসেবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়, লাশটি আসলেই আলতার বোন বানুর ছিল।

এখন কথা হলো, বানুর সাথে আসলে কি হয়েছে যার জন্যে তার এই অবস্থা হলো?
আমি যা বুঝলাম সেটাই বলছি, সিনেমায় দেখা যায় নদীর ধারে আরমান ও বানুর মধ্যে গোসলের ভিডিও নিয়ে হাতাহাতির শুরু হয়। একসময় বানু আরমানকে মাটিতে ফেলে দেয় এবং মোবাইল পিষে ভেঙ্গে ফেলে। এরপর বানু আরমান কে গাছের মগডাল দিয়ে পেটাতে থাকে এবং বেধম মার খেয়ে আরমানের স্পট ডেড হয়। আরমানের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার পর বানু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে এবং নিজের হাতে মানুষ খুন হওয়ায় সে ছটফট করতে থাকে। সে আরমানের লাশটিকে নদীতে ফেলে দেয় এবং দৌড়ে বহুদুর চলে যায়। মিলনের চাচাতো ভাই ঘটনার এতোটুকু নিজ চোখে দেখে, তবে বানু কোথায় গেলো সেটা আর খুজেঁ বের করতে পারেনি অর্থাৎ বানুকে ফলো করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।

 

তো এরপর কী হলো? সিনেমাটা দেখে থাকলে ভালো করে এ সিনেমার শুরুটা মনে করুণ। আলতা তার ইউনিউনের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলছে, সিনেমার একদম শুরুর দিকেই এ রকম একটা সিক্যুয়েন্স আছে। মনে পড়ছে তো? সেখানে চেয়ারম্যান একজন মেয়ে কারবারির নাম বলেছিল, মেয়েদের ধরে ধরে তাদের বিভিন্নভাবে পাচার করে দেয় অথবা পতিতাপাড়ায় বিক্রি করে দেয়। নামটি ছিল “নেকাব্বর”!

এই নেকাব্বর ও তার সাঙ্গপাঙ্গই এই গল্পের ভিলেন! বানু যখন দৌড়ে গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দুরে রসুলপুরের কাছাকাছি চলে আসে, তখন হয়তো কোনোভাবে সে এই নেকাব্বরের খপ্পরে পড়ে। নেকাব্বর ও তার লোকেরা তাকে বাজেভাবে ধর্ষণ করে। বানু ডানপিটে মেয়ে হওয়ায় সে সহজেই ছাড় দেওয়ার পাত্র নয়। তাই ধর্ষিত হওয়ার আগে নেকাব্বরের লোকেদের সাথে তার ধস্তাধস্তি হয়েছে। এসময় বানুকে শান্ত করার জন্য তারা বানুকে শারীরিকভাবে আঘাত করে এবং ঐ আঘাতে বানুর মৃত্যু হয়।

এখন যদি কল্পনা করা এই ঘটনাই যুক্তিযুক্ত হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো, বানুর গায়ে থাকা চাদর টি কীভাবে পতিতাপল্লীতে গেলো?
এক্ষেত্রে উত্তর হতে পারে দুটি। হয়তো নেকাব্বরের লোকেরা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি বানু মৃত, তারা ধরে নিয়েছে বানুর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই পরবর্তীতে তারা বানুকে পতিতাপল্লীতে দিয়ে আসলে সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারে বানু মৃত। এরপর তারা সেই চাদর টি রেখে বানুর লাশকে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে। পরবর্তীতে হকাররা পুরাতন কাপড়-চোপড় নিতে পাড়ায় আসলে অন্যান্য কাপড়ের সাথে এই চাদর টিকেও বিক্রি করে দেওয়া হয়। দিলারা জামান তো আর এমনি এমনি মম এর সাথে এই ব্যাপার এড়িয়ে এনজিও র কথা বলেনি..

দ্বিতীয়ত হতে পারে নেকাব্বরের লোকেরা আস্তাবলে থাকা অবস্থাতেই বুঝেছে বানু মৃত, তাই তারা চাদর রেখে লাশটিকে দুরে কোথাও ফেলে দেয়। পরবর্তীতে নেকাব্বরের লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য আস্তাবলে কোনো পতিতা আসে। তার চাদরটি পছন্দ হয় এবং তিনি সেটি নিয়ে যায়। এরপর হকাররা পতিতাপল্লীতে আসলে অন্যান্য কাপড় চোপড়ের সাথে এটাও বিক্রি করে দেওয়া হয়।

সবশেষ যে বিষয়টি সবথেকে বেশি কনফিউজ করে, আলতা আবারো কেন ৭ দিন পর বানুকে খুজঁতে বের হলো? এ প্রশ্নের উত্তর সোজা। দেখুন, বোনকে খুজঁতে গিয়ে আলতাকে এপর্যন্ত যে কয়জন লোক যার যার সাথে দেখা করতে বলেছে, মম তাদের সবার সাথেই দেখা করেছে। কেবল একজনের সাথে সে দেখা করতে পারেনি। সে আর কেউ না, এসিনেমার নেকাব্বর। আলতা আসলে নিশ্চিত হতে চায় আসল ঘটনাটি কি। আগে সে একা একাই তার বোনকে খুঁজেছে, এখন তার সাথে মিলন ও তার চাচাতো ভাই আছে। তাই সে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য মনে সাহস পেয়েছে। এছাড়া মিলনকে একবার নেকাব্বরের লোকজন বেধম মার মেরেছে। তাই মিলনের মধ্যেও একটি চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাই তারা সেই রসুলপুরেই গিয়েছে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য।

উল্লেখিত ধারণা গুলিই যে সত্য হবে তার শতভাগ গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। তবে সবমিলিয়ে চিন্তাভাবনা করলে এরকম ঘটনাই সম্ভাব্য দাঁড়ায়। পরিশেষে বৃন্দাবন দাস ও অরুণ চৌধুরীকে মন থেকে ভালোবাসা জানাই এরকম বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্য সাজানোর জন্য।


মন্তব্য করুন