Select Page

বিউটি সার্কাস: সুন্দর শুরু, বাজে সমাপ্তি

বিউটি সার্কাস: সুন্দর শুরু, বাজে সমাপ্তি

বিউটি (জয়া আহসান) নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘বিউটি সার্কাস‘ দলের মালিক ও দক্ষ খেলোয়াড়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিউটি সার্কাসের খুব নামডাক। মানুষজন তার খেলা দেখার জন্যে তাবু-প্যান্ডেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একদা বিউটি তার দল নিয়ে বানিয়াসান্তা নামক একটি গ্রামে সার্কাস খেলা দেখাতে যায় এবং তার ওপর সেখানকার তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নজর পড়ে— রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী নবাব (তৌকীর আহমেদ), বানিয়াসান্তার শেষ জমিদার মির্জা মোহাম্মদ বখতিয়ার (ফেরদৌস) ও চোরাকারবারি রঙলাল (এবিএম সুমন)। তিনজনই বিউটির প্রেমে পড়ে যায় এবং তাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিউটি এদের কারো প্রেমেই পড়ে না। কারণ বানিয়াসান্তায় আসার পেছনে রয়েছে এক অন্য উদ্দেশ্য। যাকে বিউটি বলছে রক্তের ইতিহাসের সাক্ষ্য।

স্পয়লার: এ চলচ্চিত্রের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। ‘বিউটি সার্কাস’ না দেখে থাকলে রিভিউটি পরিহার করতে পারেন। সিনেমাটি দেখে আপনিও আমাদের মতামত জানাতে পারেন। লিখতে পারেন রিভিউ।

বিউটি সার্কাস; পরিচালনা: মাহমুদ দিদার; অভিনয়: জয়া আহসান (বিউটি), এবিএম সুমন (রঙলাল), ফেরদৌস (মির্জা মোহাম্মদ বখতিয়ার), তৌকীর আহমেদ (নবাব), গাজী রাকায়েত (নাদের মোল্লা), শতাব্দী ওয়াদুদ (কুদরত) ও হুমায়ুন সাধু (স্যাম); প্রযোজনা: সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড; মুক্তি: ২৩ সেপ্টেম্বর

ভালো দিকগুলো

এক. জয়া আহসানের পারফরম্যান্স: এক কথায় অনবদ্য, খুবই ভালো। সিনেমায় জয়া আহসানকে স্টান্ট ব্যবহার না করেই শূন্যে থাকা অবস্থায় দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে দেখা গেছে। তিনি কোনো পেশাদার সার্কাস দলের সদস্য নন, আবার বাস্তবজীবনে তার বয়সও নেহায়েত কম হয়নি। তবুও তিনি এই বয়সে এসে অভিনয়ের প্রতি এরকম ডেডিকেশন দেখাচ্ছেন, এরকম ঝুকিপূর্ণ শট কোনো স্টান্ট ছাড়াই নিচ্ছেন, এজন্যে তার একটা কড়া হাততালি প্রাপ্য।

এ ছাড়া এবিএম সুমন খুব ভালো অভিনয় করেছেন। তাকে তো কালেভদ্রে সিনেমাতে দেখতে পাওয়া যায়। এবার তিনি একটু ভিন্ন রকমের চরিত্র পেয়েছেন, এ ধরনের চরিত্রে তাকে আগে কখনো দেখিনি। বেশ ভালো করেছেন।

বাকিদের মধ্যে তৌকীর আহমেদের কমেডি মেশানো অভিনয় ভালো ছিল। ফেরদৌসকে আসলে নেতিবাচক চরিত্রে তেমন মানায় না, তাই তার অভিনয়ও আমার তেমন ভালোলাগেনি। গাজী রাকায়েত, শতাব্দী ওয়াদুদ গতানুগতিক অভিনয় দেখিয়েছেন। হুমায়ুন সাধুকে বহুবছর পর আবার কোনো কাজে দেখলাম। প্রায় তিন বছর আগে তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ভালো হতো তিনি যদি এই সিনেমাটা দেখে যেতে পারতেন।

দুই. সার্কাসের অংশটুকু: ছবিতে বাজেটের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। একটা সময়ে গিয়ে তো কাজই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে যতটুকু সার্কাস দেখতে পাওয়া গেছে মন্দ লাগেনি। বেশ ভালোই লেগেছে।

তিন. সিনেমার প্রথমার্ধ: মূলত প্রথমার্ধেই সার্কাসের অংশটুকু দেখতে পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি মূল চরিত্রগুলো ভালোভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এই অংশে কমেডি ছিল, ড্রামা ছিল, রোম্যান্স ছিল। সার্কাসের ভেলকি তো ছিলই! সবমিলিয়ে উপভোগ্য।

খারাপ দিকগুলো

এক. গল্প ও চিত্রনাট্য: প্রথমার্ধে বেশ ভালোই আগাচ্ছিল। এরপর সিনেমায় একটা ব্যাকস্টোরি দেখতে পাওয়া যায়, যেটা পুরো প্রচেষ্টাকেই দুর্বল করে দিয়েছে। একে তো ব্যাকস্টোরিটা অত্যন্ত গতানুগতিক, তারপর সেখানে অনেকটা জোর করেই মুক্তিযুদ্ধের এঙ্গেল ঢোকানো হয়েছে। গল্পের সাথে ব্যাপারগুলো ভালো সামঞ্জস্যতা পায়নি, যার কারণে একটা ভালো শুরুর পরও সিনেমাটা খুবই টিপিক্যাল রাস্তার দিকে ফিরে যায়।

দুই. দ্বিতীয়ার্ধ ও গল্পের শেষাংশ:  ব্যাকস্টোরি দুর্বল হওয়াতে সিনেমাটা উপকূলে বাধাপ্রাপ্ত ঘুর্ণিঝড়ের মতো করে সামনে আগাচ্ছিল। এরপর শেষে গিয়ে এতো বেশি গোজামিল দেখা গেলো, যেগুলো একটা সময়ে গিয়ে আর নেয়া যাচ্ছিল না। সিনেমাটা শেষপর্যন্ত আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আজন্ম ব্যবহৃত গল্প ‘পিতৃহত্যার প্রতিশোধ’-এ রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর এমনভাবে সেইসব প্রতিশোধের কর্মকাণ্ড দেখানো শুরু হয়, যার পেছনে শক্ত কোনো লজিক খুঁজে পাওয়া যায় না।

বীরপুরুষ ভাব নিয়ে চলা তৌকীর আহমেদ হঠাৎ করে কীসের ভয়ে ইঁদুর হয়ে গেলেন, বুঝিনি। কামের বসে আসক্ত ফেরদৌসও বা কেন হঠাৎ করে এমন আত্মঘাতী হলেন, বুঝিনি। গাজী রাকায়েতকে ইল্যুমিনাতি সংকেতের মাধ্যমে ‘শয়তানের পূজারী’ দেখানো হলো, কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ কোনো জাদুমন্ত্র দেখা গেলো না। ওনার শেষটা আরো বেশি হাস্যকর, আমি সিনেমাহলে বসে হাসি আটকাতে পারিনি।

একটা সময়ের পর মনে হয়েছে, বানিয়াসান্তায় কোনো প্রশাসন নেই, থানা-পুলিশও নেই। যার যা মন চায়, তা-ই করে।

তিন. পরিচালনা: এর আগে মাহমুদ দিদারের একটা সিরিজ দেখেছিলাম বিঞ্জে, ‘পঁচিশ’। সুনেরাহ বিনতে কামাল ও শ্যামল মাওলা অভিনীত সিরিজের শুরুটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু এরপরই একটি গতানুগতিক রাস্তার দিকে যেতে থাকে, আর যতটা বাজে হওয়া সম্ভব, ততটা বাজে হওয়ার চেষ্টা করে।

বিউটি সার্কাসের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই কাণ্ড ঘটেছে। শুরুটা বেশ সম্ভাবনাময়। এরপর ব্যাকস্টোরি, রিভেঞ্জস্টোরি ঢুকিয়ে সিনেমাটিকে যতটা সম্ভব বাজে করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এটা ঠিক, গল্পের চাহিদা অনুযায়ী এই সিনেমা বাজেট পায়নি। এখন একজন সাধারণ দর্শক তো আর এগুলো ভেবে সিনেমাহলে যাবে না! যে এই সিনেমাটা তিন-চার বছর যাবৎ বাজেটের অভাবে আটকে ছিল। হুমায়ুন সাধু যে আমাদের মাঝে নেই, সিনেমা দেখা অবস্থায় অনেকের হয়তো এটাও মাথায় আসবে না। দর্শক একদম ফ্রি মাইন্ডেই সিনেমা দেখে, দেখতে চায়। তো গল্পের উচ্চাশা অংশটুকু কমিয়ে বাজেটে যতটুকু সম্ভব হয়, সে অনুসারে পরিকল্পনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। এইখানে আরো অনেক বেশি প্যাচওয়ার্কের প্রয়োজন ছিল।

মন্তব্য: ‘বিউটি সার্কাস’ একবার দেখার মতো সিনেমা। বাজেট সমস্যা ছাড়াও এ সিনেমায় গল্প-চিত্রনাট্যে বড় রকমের গাফিলতি আছে। সব মিলিয়ে আমার প্রত্যাশা পুরণ হয়নি।

রেটিং: ৫/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

মন্তব্য করুন