Select Page

বেঙ্গলি বিউটি: বাকশালের জামানায় প্রেম ও ট্র্যাজেডি

বেঙ্গলি বিউটি: বাকশালের জামানায় প্রেম ও ট্র্যাজেডি

রাহশান নূর অভিনীত ‘সীমানাহীন’ নামের সিনামা ২০১৩ সালে আমি আর দারাশিকো ভাই দেখছিলাম স্টার সিনেপ্লেক্সে। আমরা ছাড়া দর্শক ছিল একটা কাপল।

ছবির কাহিনি হিন্দু-মুসলিম প্রেম নিয়ে, জোর করে দর্শক সন্তুষ্ট করার মতো ব্যাপার ছিল। হিন্দু নায়িকা নামাজ পড়ছে, মুসলিম নায়ক পূজা করছে এমন ব্যাপারও ছিল। এটাও ছিল সূরা ফাতেহা আর গায়ত্রী মন্ত্র একই। আর একটা ইতিহাসের ব্যাপার ছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় হিন্দু-মুসলিম প্রেম। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভাগ। যার পরিণতি ওই ছবির নায়িকা।

যাই হোক, সেই ছবির ৮ বছর পর ‘বেঙ্গলি বিউটি’ দেখলাম। এবার রাহশান নূর পরিচালকও বটে। এ ছবির সময়কাল ও গল্প বলার ভঙ্গিটা আকর্ষণীয়। ছবির শুরু জাতিসংঘে শেখ মুজিবের ভাষণ দিয়ে। তার পরপরই রেডিও’র খবরে শোনা যায়, বাকশাল জারি হওয়ায় (মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে স্বাধীন হওয়া) বাংলাদেশে চারটা পত্রিকা ছাড়া বাকিগুলা বন্ধ। তেমন চালু একটা পত্রিকার সম্পাদকের ছেলে নায়ক। আমেরিকা থেকে আসছে। ক্ষমতাবান নানার জোরে রেডিও বাংলাদেশের ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ প্রোগ্রামে ডিজে হিসেবে জয়েন করে।

বিদেশ থেকে আসা, ফলত তার ডিজেগিরি সেই চাপ থাকবে। অনুষ্ঠানে মজার মজার কাণ্ড করে শ্রোতাদের সঙ্গে, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়াত্ত সম্প্রচার মাধ্যমের ‘গাম্ভীর্য ও দায়িত্বপূর্ণ’ আচরণের সঙ্গে মানানসই নয়। এ সব ঘটনার ব্যাকড্রপে শুধু বাকশালই নয়, একটা অসহিঞ্চু সময়ের কথা বারবার বলা হয় দু-একটা ক্যারেক্টারের মুখে। তাই রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে কাজ করা নায়কের আরও ‘দায়িত্বশীল’ হতে হবে, ঠাট্টা করা যাবে না। ঠাট্টা তো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিশেষ করে, জাতির পিতাকে নিয়ে ঠাট্টা প্রডিউসার বরদাশত করতে পারে না! চাকরিও চলে যায়, আবার ফিরেও আসে…

সিনামাটা মুক্তি পাইছে ২০১৮ সালে। সময় বিবেচনায় একটু চমকে যাওয়ার মতই। কতটা কাটছাট বা কী হইছে জানি না বটে, এ ব্যাপারগুলার জন্যও বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। কারণ, এখন যদি কোনো দল বা ব্যক্তি বিশেষের জন্য প্রেম দেখাইতে যান আর্ট ফর্মে, তারে কিছু ছকে বাধা হইতেই হয়।

তবে ওভারঅল সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট আকারে ততটা ভালো নাও লাগতে পারে।

বাংলা সিনামা হিসেবে গল্প বলায় কিছু মজা আছে। টেকনলজির মধ্যে কী যেন দেখাতে চায়। একটা অংশরে তারা বলছে ‘টেকনো কালারে’ নির্মিত। ওইটা ওই সময়ে সিগনেচার কারিগরি বলে হয়তো।

একটা জিনিস হলো সত্তর দশকের মাঝামাঝিরে তুলে ধরা। এর জন্য আয়োজনও সংক্ষিপ্ত। ঠিক এ কারণে হয়তো বা দৃশ্যগুলো দমবন্ধকর। মানে ছবির দৃশ্যে স্বস্তি বা খোলামেলা কোনো ব্যাপার নাই। ঢাকার হিসেবে অল্প বাজেটে এর চেয়ে বেশি আরকি আশা করা যায়। রাহশান নূরের ‘আচ্ছালামু আলাইকুম বাংলাদেশ’ সত্তর দশকের আবহে কেমন লাগবে স্পষ্ট না, তবে পঞ্চাশ বছর পর যে ভাল্লাগছে তাও না!

এ ছবির গানগুলোতে ওই সময়ের আবহ রাখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ‘ময়না’ গানটা জোশ। বাট, বলিউড স্টাইলে নায়কের সঙ্গে নায়িকা বা নায়িকার বান্ধবী না গাইলে ভালো লাগতো। আর ‘সীমানাহীন’ ছবির মতো সাউন্ড খুব টানে। টয়া, নাজিবা, সারাহ অভিনয় সুন্দর।

এই ছবির শেষ ১৫ আগস্টের ঘটনা দিয়ে। যার প্রভাব নায়ক-নায়িকার জীবনেও পড়ে। এ অংশটা কেমন যেন! একটা সমান্তরাল ট্র্যাজেডি।  রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির বরফচূড়ার একটা অংশ তুলে ধরছে। এটাও ঠিক যে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আপনার প্রেমকেও ব্যর্থ করে দিতে পারে।  তবে রোমান্টিক পার্টের শেষটুকু ভালোই লাগছে। হুট করে যদিও ‘টাইটানিকের’ স্বপ্ন দৃশ্য ঢুকে পড়ছে! আরও কী কী পড়ছে কে জানে! কিন্তু এন্ডিংটা নাকিনাকি না হয়ে বাস্তাবিক হইছে। আর পুরো ছবিতে যে ব্যাপার ওই সময়টা আসলে সোসাইটির অন্য অংশে কী কী ঘটাইছে স্পষ্ট করে নাই। সেনা বাহিনীর ছোট কিছু দৃশ্য আছে। চাপা চাপা উত্তেজনার মধ্যেই শেষ।

বাট এ ছবি কিছু কারণে দেখতে খারাপ লাগে নাই। হিস্ট্রির একটা সময়কে তুলে ধরার ‘সাহস’ দেখাইছে। আর বাংলার ভদ্রলোকের সিনামা মানে নড়াচড়া না করা মধ্যবিত্ত ও কাল্পনিক গরিব। তার জায়গায় ‘বেঙ্গলি বিউটি’র সমাজটা স্পষ্ট! তাদের জীবনযাত্রাটা স্পষ্ট। আর গল্পের ভঙ্গিমার মধ্যে ঢাকার সিনামায় নতুন কিছু দেখানোর চেষ্টা আছে।

  • লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করার পর জানতে পারি– ‘গুড মর্নিং ভিয়েতনাম’ নামের হলিউড সিনেমাকে অবলম্বন করে বানানো ‘বেঙ্গলি বিউটি’। যা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা  হয় নাই কোথাও।


মন্তব্য করুন