Select Page

ভাবনা বনাম বাস্তব জগৎ

ভাবনা বনাম বাস্তব জগৎ

আলফা
ধরন : ড্রামা
পরিচালক : নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু
প্রযোজনা : এরিয়েল ক্রিয়েটিভ স্পেস লি, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি.
অভিনয় : আলমগীর কবির (আলফা মিয়া), দিলরুবা দোয়েল (গোলেনূর), মোস্তাফিজুর নূর ইমরান (কালি মা), এটিএম শামসুজ্জামান (মুদি দোকানদার), হীরা চৌধুরী, ইশরাত নিশাত, ভাষ্কর রাশা প্রমুখ।
শুভ মুক্তি : ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

নামকরণ : ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আলফা মিয়ার নামানুসারে ‘আলফা’ রাখা হয়েছে। সমাজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলফা মিয়ার চিন্তাধারা, দর্শন এছবির মূল বিষয়। তাই নামকরণটি যথার্থ মনে হয়েছে।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : আলফা মিয়া একজন চিত্রশিল্পী। একসময় চমৎকার সব রিক্সা পেইন্টিং এবং বিলবোর্ড অঙ্কনের মাধ্যমে তিনি সমাজে বেশ কদর পেয়েছেন। তখনকার সময়ে বাংলা সিনেমার হার্টথ্রব নায়ক-নায়িকারা পেইন্টিং-এর মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু বর্তমানে রিক্সা পেইন্টিং-এর সেই জৌলুস আর নেই। মানুষের চিন্তাভাবনা এবং চাহিদা বদলেছে। সময়ের পরিবর্তনে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় এই ঢাকা শহরে চিত্রশিল্পী হিসেবে তার কদরও কমেছে। তাই এই দুনিয়াতে তিনি বড় একা, চারপাশে যান্ত্রিক কোলাহলের মধ্যেও তিনি একা।

তবে তিনি যে বস্তির নিকট থাকেন সেখানে তার মেলা কদর। পরিচিত-অপরিচিত সবাই সেখানে তাকে যথেষ্ট সম্মান করে, খোঁজখবর নেয়। তবুও আলফা মিয়ার মনে খুব অশান্তি। সে বর্তমান সমাজ নিয়ে ভাবে, জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে একজন মানুষের প্রকৃত হক আদায় নিয়ে ভাবে। এভাবেই আলফা মিয়া ভাবনা এবং সমাজ বাস্তবতার দোলাচলে এগিয়ে যায় ছবির গল্প।

ছবির কাহিনীর মাধ্যমে চিত্রশিল্পীদের বর্তমান করুণ অবস্থাকেই তুলে ধরা হয়েছে। সময়ের তালে তারা নিজেদের এগিয়ে নিতে না পারায় সমাজ থেকে তারা একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভুমি ছেড়ে তার ঐ ডোবার ওপর মাঁচা তৈরী করে থাকা অনেকটা সেই অবস্থাকে ইঙ্গিত করে।

ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লিখেছেন পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু নিজেই। সব মিলিয়ে তিনি চিত্রনাট্য বেশ ভালোই সাজিয়েছেন, তবে পর্দায় উপস্থাপনটা হয়েছে কিছুটা ধীরগ‌তির। ছবিতে সংলাপ বেশ কম, তবে এর এক-এক‌টির গভীরতা অনেক বেশি।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০।

পরিচালনা ও অভিনয় : পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর তৃতীয় ছবি এটি। ৫৯ বছর বয়সী দক্ষ এই পরিচালক এর আগে ‘একাত্তরের যীশু’ (১৯৯৩) এবং ‘গেরিলা’ (২০১১) এর মতো নান্দনিক দুইটি ছবি উপহার দিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হলো এই দুইটি ছবি। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই পরিচালক তার তৃতীয় কাজের ক্ষেত্রে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেটেছেন; পরিচিত জনরা থেকে বেড়িয়ে ভিন্ন কিছু দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বরাবরের মতো এবারও তিনি তার সেরাটাই ঢেলে দিয়েছেন।

তিনি ‘মঞ্চের কান্ডারি’ নামে বেশ পরিচিত। মঞ্চ নাটক করে এমন বহু গুণী অভিনেতাকে তিনি তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘আলফা’র মাধ্যমে এবারও তিনি মঞ্চে কাজ করা একঝাঁক অভিনেতাকে তিনি বড়পর্দায় সুযোগ দিলেন। গুণী অভিনেতা এ.টি.এম শামসুজ্জামান বাদে বাকি যারাই এ ছবিতে আছেন সবগুলো মুখই অপরিচিত। অনেকের নামই জানি না। তাই ভালোলাগা সত্ত্বেও অনেক অভিনয়শিল্পীর ব্যাপারে আলোচনা করা সম্ভব হবে না।

তবে তিনজন শিল্পীর কাজ আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, অনেক খোঁজখবর নিয়ে তাদের নামও জানতে পেরেছি। প্রথমজন হলেন এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপদানকারী আলমগীর কবির। উনার লুক, চোখের চাহনি, অবয়ব, চলাফেরা.. সবকিছুতেই একজন পরিপূর্ণ চিত্রশিল্পীর ছায়া ফুটে উঠে। মৃত লাশের সাথে কথা বলার সিক্যুয়েন্সটি ছিল তার অভিনয় দেখানোর অন্যতম শক্তিশালী জায়গা। আর এতে তিনি সফল।

দ্বিতীয় যে অভিনেত্রীর অভিনয় চোখে লেগে আছে তিনি হলেন গোলেনূর চরিত্রের দিলরুবা দোয়েল। তার চরিত্রটি অন্য ৮/১০ টা চরিত্রের তুলনায় একদমই ভিন্ন, তবে এই ভিন্নতাকে তিনি পর্দায় ক্লিশেভাবে ছড়াতে দেননি। স্বাভাবিক অভিনয় প্রতিভা দেখিয়েছেন।

তৃতীয় অভিনেতা হলেন কালি মা মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। তিনি  তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্র রূপদান করেছেন। আর আমার একবারের জন্যও দেখে মনে হয়নি তিনি একজন পুরুষ, তার অভিনয়ে এতোটাই স্বাভাবিকের ছোঁয়া ছিল।

অভিনেতা এ.টি.এম শামসুজ্জামান কে পাড়ার মুদি দোকানদারের রোলে খুব স্বল্পসময় দেখা গেছে। তবে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ পর্দাজুড়ে ভালোলাগার জাল বুনে গেছেন, তিনি পর্দায় থাকা মানেই তো দর্শকের মুখে চওড়া হাসির উপস্থিতি!

আরো অনেকেই আছেন যাদের অভিনয় ভালোলেগেছে। ছবিতে সোলায়মানের মা এর চরিত্র যিনি রূপদান করেছেন তিনি যেন বাংলার আপাময় মায়ের উদাহরণ হিসেবে পর্দা রাঙালেন। এছাড়া ড্রাগস চোরাচালানকারী হিসেবে যিনি ছিলেন, তার অভিনয়ও ভালো লেগেছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০।

কারিগরি : একমাত্র দূর্বল দিক হলো এর সিনেমাটোগ্রাফি। ঠিক দুর্বল বলা যায় না, অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি সাদামাটা। এছাড়া যদি ছবির ভালো দিক বলি তার মধ্যে একটি হলো অভিনয় শিল্পীদের মেকআপ এবং কস্টিউম সিলেকশন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোশাক-আশাকই যেন অনেককিছু বলে দিচ্ছে, ব্যাপারখানা এমন। এছাড়া লোকেশন অন্যতম ভালো একটি দিক। গর্জিয়াস কিছু করা হয়নি, তবে যেখানে যেটা প্রয়োজন ঠিক সেটাই পাওয়া গিয়েছে।

ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মোটামুটি ভালো হয়েছে। এডিটিং ও কালার গ্রেডিং মোটামুটি ভালো ছিল।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০।

বিনোদন ও সামাজিক বার্তা : নাট্যধর্মী ছবিগুলো সাধারণত বিনোদনের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে থাকে। এ ছবিও তাই। স্ক্রিনপ্লে ধীরগতির হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই একজন দর্শক হিসেবে গল্পের মধ্যে ঢুকে যেতে বেশ সময় লাগে।

ছবিটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। জুলুম, অত্যাচার, মারামারি, হানাহানি বাদ দিয়ে শান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা হোক,  ছবির অন্যতম প্রধান বার্তা। পাশাপাশি ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা হোক। আমাদের চারপাশের ছোট হোক কিংবা বড়, যেকোনো প্রতিভাকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেওয়া হোক।

তবে এই সামাজিক বার্তাগুলোর মধ্যেও কিছু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিষয় বেশ দৃষ্টিকটু লেগেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে অতিরিক্ত হিন্দুভক্তির প্রদর্শন। আলফা মিয়া সনাতন ধর্মের অনুসারী তাই হয়তো এ ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়েছে। তবে যদি শুধু মুসলমান-হিন্দুর প্রভাবের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা না দেখিয়ে সমগ্র মানবজাতির ওপর ফোকাস করে দেখানো হতো, তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হতো।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।

ব্যক্তিগত : দুঃখজনক ব্যাপার, যে পরিচালক এর আগে আমাদের দু-দুটি নান্দনিক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি উপহার দিয়েছেন, তার তৃতীয় ছবি এমন চুপিসারে মুক্তি পেলো। ভালো প্রচারণা না হওয়ায় অনেকেই হয়তো মুক্তির খবর জানে না। যার প্রভাব পড়েছে ছবিটি মুক্তির পর, প্রথম দিনে খুব কম দর্শক সমাগম পেয়েছি।

সব মিলিয়ে ছবিটি আমার কাছে মোটামুটি ভালো লেগেছে। অনেকটাই নীরিক্ষাধর্মী কাজ ছিল, তাই কিছুটা ভুলভ্রান্তি চোখে লেগেছে। এগুলো এড়িয়ে চললে এটি এক‌টি ভালো ড্রামা ছবি।

রেটিং : ৮/১০

ছবিটি কেন দেখবেন : একঝাঁক নতুন অভিনেতার ন্যাচারাল পারফরমেন্স উপভোগ করতে চাইলে ছবিটি একবার দেখতে পারেন। ‘একাত্তরের যীশু’ কিংবা ‘গেরিলা’র মতো মুগ্ধতা হয়তো ছড়াবে না, যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমাদের আবেগ মিশে আছে। কিন্তু এ ছবিও আপনাকে হতাশ করবে না।


মন্তব্য করুন