Select Page

‘মহানগর’ আসলে কাদের গল্প?

‘মহানগর’ আসলে কাদের গল্প?

‘মহানগর’ নামের ওয়েব সিরিজটি কেন দেখেছিলাম, কী ছিল প্রত্যাশা?

জানি না।

ছাত্রজীবনে হলে থাকাকালে প্রায় প্রতিরাতে ফিল্ম দেখা হত। এক নাগাড়ে ৬ বছরে ফিল্ম দেখার দরুণ সম্ভবত অরুচি তৈরি হয়েছিল, হল ছাড়ার পরে কিছুদিন অকাতরে তামিল-তেলুগু দেখলেও কর্মব্যস্ততার কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানেও নামে দীর্ঘস্থায়ী বিরতি।

তবে

ইউটিউবে বাংলা সিনেমা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দেখাটা বীভৎস বিনোদনের অংশ ছিল এবং থাকবে। ক্রিয়েটিভিটির অনুশীলনে বাংলা সিনেমা মহাজাগতিক এবং অতলান্তিক কল্পনার খনি।

ওটিটি প্লাটফর্মের বিকাশের দরুণ ওয়েবসিরিজ সর্বশেষ ট্রেন্ড।

মহানগর কি সেসব কারণে দেখেছিলাম?

না।

‘বায়োপিক এনালিস্ট’ পেশাটাকে ব্যাখ্যা করে কৌতূহলোদ্দীপক বই লিখছি একটা। সেদিন প্রায় ১৩ ঘণ্টা লিখবার পর মাথা ভনভন করছিল, ১০ মিনিট ফেসবুকে স্ক্রল করাকালীন ৬ জনকে পাই যারা বিভিন্ন আকারের স্ট্যাটাসে জানান দিচ্ছিল ‘মহানগর’ দেখা পড়েছে তাদের। একই নামে সত্যজিৎ রায়ের একটি সিনেমা দেখেছিলাম। ৬ জনের স্ট্যাটাস নাকি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সঙ্গে নামের সাদৃশ্য, কোনটি প্রধান প্রভাবক হয়ে উঠেছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণে, তাও জানি না।

সম্ভবত ১৩ ঘণ্টা লেখাজনিত বিভ্রম থেকে বৈচিত্র্য অন্বেষণই মূল নিয়ামক।

টিজারে মোশাররফ করিমময়তা থেকে দুটো ধারণা জন্মে- ১. এটা ক্রাইম থ্রিলার ২. এটা গুড কপ-ব্যাড কপধর্মী স্টোরিলাইন।

বাংলাদেশের নাটক বা সিনেমায় অনুকরণ এবং পুনরাবৃত্তি সাংবিধানিক অধিকার স্তরে পৌঁছেছে। একজন অভিনেতার কোনো চরিত্র দর্শকপ্রিয়তা পেলে টানা ১০-১৫টা প্রজেক্টে সে সেই ধারার চরিত্রেই অভিনয় করবে যতক্ষণ না বস্তাপচা তকমা যুক্ত হচ্ছে। সেই চরিত্রটাই হয়ে উঠে তার ব্র্যান্ড ইমেজ, এবং তাকে স্মরণ করলে সেই ফর্মুলা অ্যাক্টিংটাই ভেসে ওঠে। একসময় অভিনেতা নিজেও সেই ঘেরাটপে বন্দী হয়ে পড়ে। তার চলনবলন, গেটআপ, লুক অনেকটাই সেই ঘরানার ফরমুলা অ্যাক্টিংয়ের প্যাটেন্টকৃত হয়ে যায়।

চঞ্চল চৌধুরীর একসময়ের প্যাটেন্ট ছিল মুখ বাঁকিয়ে কিছুটা ক্যাবলাকান্ত ধাঁচের অভিনয়। কালক্রমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রজেক্টে নির্বাচিত হয়ে সেই ধাঁচ থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেকাংশে।

মোশাররফ করিমের কি সেই শিকে ছিড়লো? মোশাররফ করিমের চরিত্র মানেই ফাঁপরবাজ প্রকৃতির; ঘষেমেজে নিজেকে বারংবার ফাঁপরবাজিতেই ফিট করেন। এবং এটাই যে দর্শকদের মনোরঞ্জনে যথেষ্ট তার মার্কেটরচাহিদা দেখেই আঁচযোগ্য।

মহানগর দেখা অন্তে কি মনোভাব বদলালো?

না।

করোনার প্রভাব পড়েছে ইদানীংকালের গল্পের সেটিংসেও। সীমিত লোকেশনে সর্বোচ্চ শুটিং নীতিকে প্রশংসনীয় দৃষ্টিতে দেখা উচিত নাকি উচিত না নির্ভর করছে গল্পটা কী বলতে চাইছে, এবং গল্পের থ্রিলিং অংশ আদতে কোনটা সেই নিয়ামকের ওপর।

মূলত একটি রাতকে উপজীব্য করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার প্লাটফরম থানা। এর সঙ্গে একটি ক্লাব এবং রাস্তা— লোকেশন এটুকুই।

থানাকেই ৯০ শতাংশ লোকেশন বানানোতে গল্পে যে গতিময়তা দাবি করে তা পূরণ করতে পারেনি। বরং একই ধরনের দৃশ্যের পৌনপুনিকতায় গল্পের টেনশন পয়েন্ট এবং কনফ্লিক্টটা একেবারে ফ্ল্যাট। মোশাররফ করিম নিঃসন্দেহে এই সিরিজের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতা। আমি নিশ্চিত নই, পারিশ্রমিক উসুল করতেই কিনা প্রায় প্রতি ফ্রেমে মোশাররফ করিমকে গুজে দেয়ার যে প্রয়াস তার প্রতাপে শ্যামল মাওলা এবং জাকিয়া বারী মমর চরিত্র দুটি তৈরিই হতে পারলো না। অথচ এই স্টোরিলাইনে শ্যামল মাওলার হওয়ার কথা সবচাইতে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল এন্ট্রি। সিগারেট খাওয়া, পার্টিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে শাসানো, আর থানায় ছটফট করার বাইরে তার ভূমিকা কী? এমনকি একজন উচ্চমার্গীয় লম্পট হিসেবে যেসব ব্যবহারজনিত বৈকল্য থাকার কথা, তার সামান্যতম শর্তও কি পূরণ হলো? সারপ্রাইজিং উপকরণ হিসেবে যে নারীকে হাজির করা হলো পিঠের ট্যাটুতে ফোকাস করামাত্রই অনুমান করা যাচ্ছিল গল্পের কোনো একটি টুইস্টিং অংশে এই নারী অথবা ট্যাটু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু সেই নির্মাণটাও এমন অপরিমিত উপায়ে হলো, যা এই প্যাটার্নের সিরিজের গতির সঙ্গে বেমানান।

মোশাররফ করিম বনাম শ্যামল মাওলার দ্বৈরথে ট্রিকি ফোর্স হতে পারতেন মম। কিন্তু গল্পে তার জন্য ফুটেজ রিলিফের চালের মতো। কলকাতার প্যারালাল সিনেমার ঢঙে সিগারেট টানা, আর আরোপিত যান্ত্রিক টোনে কথা বলার বাইরে, তার স্কোপ আসলে কতটুকু? এমনকি চরিত্রটি যদি পুরোপুরি বাদ দেয়া হত তাতে কি গল্পের গতি-প্রকৃতিতে সামান্যতম পরিবর্তন হতো?

না।

এবং মজার বিষয় হলো, যে মোশাররফ করিমের কাঁধে চেপে গল্প এগিয়ে গেছে, তার নিজের অ্যাক্টিভিটি কতখানি? বাংলা সিনেমায় নায়ক বা ভিলেনের একটি বাঁধাধরা বাক্য থাকে, ক্ষণে ক্ষণে সেটি সে ডেলিভার করে, এমনকি ভিলেন মৃত্যুকালেও সেই সংলাপই আউড়ায়— ‘জানে পানি নাই’!

হলভর্তি দর্শকের সিটি পাওয়া বা ক্যারেক্টারকে ট্রেডমার্ক বানানোর এই প্রাচীন কৌশল এখনো কি কার্যকর? বাঙালি দর্শকের ভিজুয়াল রুচি বিষয়ে সিরিয়াস পর্যবেক্ষণ না থাকায় মন্তব্য করছি না, তবে পুলিশের শরীরে ফাঁপরবাজ ইমেজের মোশাররফ যখন তার সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া করলেই বলে— ‘দুটো কথা মনে রাখবা’, তাকে বাংলা সিনেমার মান্নারূপে ভাবতে ইচ্ছা করে। টোকাইয়ের হাতে অস্ত্র কেন বা কাছাকাছি নামের সিনেমায় মান্না প্রায় প্রতি ফ্রেমেই বলে— এর দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ এই, আর দ্বিতীয় কারণটা আমি ভুলে গেছি!

২০২১-এও স্টোরিটেলিংয়ের এই কৌশল ব্যবহার স্মার্টনেস নাকি রুচির স্থবিরতা, বলা মুশকিল। এটা কি কমেডির অংশ? কমিক উপকরণ হিসেবে এক ছিচকে চোরকে তো ফুটেজ দেয়া হয়েছিলই। সে লোকরঞ্জনে যা যা করা দরকার করে গেছে, তার সৌজন্যে কয়েক সেকেন্ডের গালিভান্ডার ক্লিপ পাওয়া গেছে।

এটা কি কম হয়ে গেল?

এই গল্পের একটি সাবপ্লট নিয়ে আলাদাভাবে বলা উচিত। কর্পোরেট রিলেশনশিপ নিয়ে মুখরোচক বহু কথা শোনা যায়, শোওয়ার বাইরে নাকি সেখানে কিছু নেই। দুজন অফিস কলিগের মধ্যে প্রেম প্রেম ভাব, এখনো রোমান্টিক কোনো স্মৃতি তৈরি হয়নি, প্রথম সুযোগেই তারা খালি বাসায় রুম ডেটিংয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তরুণ কিনছে জন্মনিরোধক, এবং তরুণীটি তাতে পুলকিত— বলছি না এ ধরনের ঘটনা অবাস্তব। ক্যারেক্টার এনালাইসিস সার্ভিস দেয়ার কারণে এর চাইতেও রোমহর্ষক কাহিনি, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের গল্প প্রায়শই শুনে থাকি। প্রশ্ন হলো, এরাই কি মেজরিটি? অর্থাৎ ৫০০টা কর্পোরেট প্রেমের সম্পর্ক নিলে সেখানে কি ৩০০ এর অধিক এমন হবে, নাকি এরকম কেইস ১০০ এর নিচে থাকবে? গল্পে তাই মাইনরিটি বা বিচ্ছিন্ন স্যাম্পলকে কেইস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করাটা স্ক্রিপ্টরাইটারের জন্য নৈতিক হলো কিনা সেই আলাপটি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তারা রাতের ঢাকা দেখতে বেরিয়েছে, এই এঙ্গেল থেকেই গল্পের মূল প্লটে তাদের প্লেস করা যেত অনায়াসেই।

যেহেতু গল্পে পাঞ্চ নেই, এলিমেন্ট অব এনগেজমেন্ট অতি সামান্য, ক্যামেরা ব্যস্ত ছিল মোশাররফ করিমকে নিয়ে, এবং সে থানার ওসি, তার কনট্রাস্ট চরিত্রের প্রতি দর্শকের নজর পড়বে। অনুমিতভাবে তাই ঘটেছে। সাব-ইন্সপেক্টরটিকে নজরে না পড়ে উপায় ছিল না। মোশাররফকে হাইলাইট করতে সাব-ইন্সপেক্টরকে কিছু ফুটেজ দিতে হতো, সেটাই করা হয়েছে। কিন্তু সেই ফুটেজগুলো মমকে দেয়া হলে গল্পের গতিপ্রকৃতিতে আরও চনমনে ভাব লক্ষ্য করা যেত। সাব-ইন্সপেক্টর গল্পের গাঁথুনিতে তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র হওয়ার মেরিট রাখে না। ডিরেক্টর চাইলেই তো হবে না রে ভাই।

সার্বিকভাবে ‘মহানগর’ আসলে কাদের গল্প? ঢাকার ক্লাবপাড়ার বিত্তশালীদের ইন্দ্রিয়সর্বস্বতার, নাকি আন্ডারকভার নীতিবান অফিসারের, নাকি তারকা-অতারকা মিলিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কয়েক ঘণ্টার ফুটেজ তৈরি?

এই গল্পের অবজেক্টিভ কী ছিল; সিস্টেমের অনুগামী হয়ে, সিস্টেমের সুবিধাভোগী হয়ে সুযোগ বুঝে সিস্টেমের সঙ্গে সিস্টেমবাজি করা? যদি তা-ই হয় সাপোর্টিভ কার্যক্রম কোথায়? শুধু দুটো কথা মনে রাখবা গিমিক দিয়ে আর মোশাররফ করিমকে ভাঙিয়ে সেই চাওয়া পূরণ হবে?

মান্না বা জসিমের প্রেডিক্টেবল স্টোরিলাইনের সঙ্গে তুলনা করলে প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু আমরা ২৩ পাওয়া ফেল্টুসকে রেফারেন্স ধরবো, নাকি ৭৯ পাওয়া লেটারমার্কসের স্পর্শগামী দূরত্বে থাকা কাউকে? ওই যে বললাম, রুচির বাটখারাতেই সমস্যা, যে কারণে আকাশে উড়েও দাঁড়কাক শেষপর্যন্ত ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্টেই আহার খোঁজে।

বাংলাদেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মিডিওক্রিটিক দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে ব্যতিক্রমী সাহিত্য, সিনেমা, নাটক বা ব্যবসায়িক আইডিয়ার প্রধানতম হন্তারক।

‘মহানগর’ সেই উপলব্ধিতেই স্পন্দন বাড়ালো মাত্র!


মন্তব্য করুন