Select Page

‘মাটির পাহাড়’ নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি

‘মাটির পাহাড়’ নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি

১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করে এফডিসি। ঢাকায় শুরু হয় সিনেমা নির্মাণের তোড়জোড়। তবে এখানে চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার চল তারও আগে থেকেই। কয়েকটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ‘চিত্রালী’। সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর নাম লেখান চিত্রপ্রযোজনায়। পরিচালনার দায়িত্ব দেন মহিউদ্দিনকে। সিনেমার নাম ‘মাটির পাহাড়’।

১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ঢাকার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন সুভাষ দত্ত। পরের বছর ঢাকায় দেখানো হয় সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। দেখে মাথা ঘুরে যায় তার। ঠিক করেন সিনেমা বানাতেই হবে। সেজন্য দরকার প্রত্যক্ষভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হওয়া। এর নাড়ি-নক্ষত্র জানা। সিনেমার প্রতি প্রেম তার আগে থেকেই ছিল। সেজন্য ১৯৫১ সালে বোম্বে গেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। এবার দ্বারস্থ হন এস এম পারভেজের। ‘মাটির পাহাড়’-এ তাকে একটা কাজ দিতেই হবে।

প্রথমে আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হন এস এম পারভেজ। তাকে পাঠান হাসান সাহেবের কাছে। চলচ্চিত্রটির শিল্প নির্দেশক। সেজন্য তাকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল কোলকাতা থেকে। সুভাষ দত্তের আঁকা ছবি দেখে তিনি পছন্দ করেন। একটা সেটের নকশা করে দিতে বলেন। এফডিসির ১ নং ফ্লোরে একটা কাঠের বাংলো বানানোর। সে পরীক্ষাতেও পাশ করেন সুভাষ দত্ত। যুক্ত হন ‘মাটির পাহাড়’-এর সঙ্গে।

‘মাটির পাহাড়’ সিনেমার পোস্টার

ততদিনে এফডিসিতে বেশ কিছু ছবির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ‘আসিয়া’ (১৯৬০) ও ‘আকাশ আর মাটি’ (১৯৫৯) দিয়ে চিত্রগ্রাহক হিসেবে নাম লিখিয়েছেন কিউ এম জামান। সেই সূত্রে সিনেমা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু হয় তার স্ত্রীর। সৈয়দা হোসনে আরা শরীফা। তেমনি গিয়েছিলেন কোনো একটা ছবির মহরতে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এস এম পারভেজ ও তার বোন লায়লা আর্জুমান্দ বানু। দুজনেরই তাকে ‘মাটির পাহাড়’-এর নায়িকা চরিত্রের জন্য পছন্দ হয়। বাসায় দাওয়াত করে দেন প্রস্তাব। শুনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যান হোসনে আরা। সম্পর্কে খাতিরে সরাসরি নাও করতে পারেননি। তবে বাসায় ফিরে স্বামীকে সরাসরি জানিয়ে দেন, অভিনয় তিনি করবেন না।

কিছুদিন পরে তাদের বাড়িতে আসেন মহিউদ্দিন ও এস এম পারভেজ। দুজনেই তার স্বামীর ঘনিষ্ঠ। আসলে এসেছিলেন হোসনে আরাকে দেখতে। তাকে না জানিয়েই। তবে তার স্বামী জানতেন। তিনি তখন আলাউদ্দিনের ছাতার একটি বিজ্ঞাপনচিত্র বানাচ্ছিলেন। সেখানে কাজ করার জন্য বলেন স্ত্রীকে। নিজেদের প্রোডাকশন। একরকম নিমরাজি হয়ে কাজ করেন হোসনে আরা। মারা হয় এক ঢিলে দুই পাখি। বিজ্ঞাপন বানানোর পাশাপাশি হয়ে যায় স্ক্রিন টেস্ট। এরপর মুন্নু টেক্সটাইলের শাড়ির বিজ্ঞাপন দিয়ে হয় ভয়েস টেস্ট। সব যাচাই-বাছাই শেষে আবারও দেয়া হয় প্রস্তাব। এবার ঘুরেফিরে সবাই মিলে। শেষে রাজিও হয়ে যান হোসনে আরা। বিশেষ করে স্বামী নিজেই যেহেতু ছবিটিতে কাজ করছেন।

পোস্টার থেকে তৈরি কোলাজ

১৯৫৭ সালের মার্চে শুরু হয় শুটিং। নায়ক কাফি খানের বিপরীতে অভিনয় করেন হোসনে আরা। আর ইকবালের বিপরীতে রওশন আরা। দুই নায়িকারই সেটা প্রথম ছবি। রওশন আরা তখন মেডিকেলের ছাত্রী। পড়েন ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে। আগের বছরই পাশ করেছিলেন আইএসসি। অন্যদিকে হোসনে আরা ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন রাজিয়া নামে। এমনকি তাকে নিয়ে প্রচার-প্রচারণা না করার জন্যও বলে রেখেছিলেন। কিন্তু শুটিং শুরু হতে না হতেই চিত্রালীর প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয় ছবি। অবশ্য সেটাও ‘রাজিয়া’ নামেই।

তার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল বাবাকে নিয়ে। তিনি জানলে কী করবেন কে জানে! আর পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। শুটিং শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আসেন বেড়াতে। এরমধ্যেই আসে শুটিংয়ের গাড়ি। প্রোডাকশন বয় এসে তার কাছেই হোসনে আরার খোঁজ করে। বাবা নিজেই ডেকে দেন মেয়েকে। ফেরার পরে কথা হয় দুজনের। বাবার আপত্তি নেই শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন হোসনে আরা।

চলচ্চিত্রটির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছিল কক্সবাজারে। বাকি অংশ ঢাকায়। এফডিসিতে হয় পোস্ট-প্রোডাকশন। মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ২৮ আগস্ট। অবশ্য খুব একটা ব্যবসা করতে পারেনি। সে বছরই ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু হয়। আরেক সিনেপত্রিকা ‘চিত্রাকাশ’-এর হাত ধরে। ‘মাটির পাহাড়’-এর জন্য প্রথম আসরেই পুরস্কৃত হন রাজিয়া। তবে দ্বিতীয় ছবিতেই সে নাম বদলে ফেলেন হোসনে আরা। ‘জোয়ার এলো’তে (১৯৬২) অভিনয় করেন মীনা জামান নামে। বেশ জনপ্রিয়তা পান। তবে খ্যাতির চূড়ায় ওঠেন তৃতীয় ছবি ‘চান্দা’ (১৯৬২) মুক্তির পর। সেই ছবি থেকেই তিনি সুলতানা জামান নাম গ্রহণ করেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাবীল অনুসূর্য

চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক

মন্তব্য করুন