Select Page

মাটির প্রজার দেশে : বাংলা চলচ্চিত্রের কাল্ট

মাটির প্রজার দেশে : বাংলা চলচ্চিত্রের কাল্ট

চলচ্চিত্র বা সিনেমার আদিকালে খুব সহজেই বলা হতো সিনেমা হচ্ছে চলমান চিত্র। যা অন্য কলায় অনুপস্থিত ছিল। কালের পরিক্রমায় সেই চলমান চিত্রে যুক্ত হয়েছে শব্দ, কাহিনি, সংবাদ, সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, সাহিত্য, নাটকের নাটকীয়তা, ক্যামেরার নানান খেলা, রঙ্গের খেলা, আলোছায়ার খেলা, এডিটিং-এর নানা কলাকৌশল, বিজ্ঞানের নানান জটিল আবিষ্কার।

মোদ্দাকথা চৌষট্টি কলার সকল কলার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক নতুন ও অসম্ভব শক্তিশালী ভাষা। যে কারণে সারা পৃথিবীতে এর এত জনপ্রিয়তা। আমরা কি পেরেছি এই শক্তিশালী ভাষার যথাযথ ব্যবহার করতে? আচ্ছা এ প্রশ্নের উত্তরে না হয় পরে আসছি। অন্যদিকে তাকানো যাক।

সমগ্র বিশ্বের চলচ্চিত্রকে আবার দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে আমদের দর্শক শ্রেণি। এক হলো মূলধারার চলচ্চিত্র, অন্যটি হলো আর্টফিল্ম বা মূলধারার বাইরের চলচ্চিত্র। আমাদের দেশে আবার এই আর্টফিল্মের দারুণ এক নামে ডাকা হয়, নামটি হলো বড় দৈর্ঘ্যের নাটক। এখানে ধুপুস ধাপুস নাচ গান থাকে না, থাকে না ইয়া ঢিশুম শব্দের ৪০ গজের কোন খেলার পিচ যেখানে একদিকে পাঞ্চ করা হয় আর ৪০ গজ দূরে উঠে দিয়ে বলরূপী ভিলেন উড়ে চলে যায়। আসলে সিনেমার কোন ভাগ নেই সব সিনেমাই মূলধারার। কারণ সিনেমা নির্মান করা হয় দর্শকদের জন্য এবং মূল উদ্দেশ্য থাকে ব্যাবসা করা। তারপরও অনেকের কাছে সিনেমার ধারা দুটি। এই অনেকের কাছে সিনেমার ধারা যে একটি তা ‘মাটির প্রজার দেশে’ সিনেমাটি বুঝিয়ে দিয়েছে।

কী নেই সিনেমাতে? গল্প, নাটকের নাটকীয়তা, ক্যামেরার নানান খেলা, রঙ্গের খেলা, আলোছায়ার খেলা, এডিটিং-এর নানা কলাকৌশল, বিজ্ঞানের নানান জটিল আবিষ্কার। মোদ্দাকথা চৌষট্টি কলার সকল কলার সংমিশ্রণে তৈরি ‘মাটির প্রজার দেশে’ নতুন ও অসম্ভব শক্তিশালী এক সিনেমা। যার নেশাতে বুদ হয়ে থাকতেই হবে আপনাকে।

সিনেমাটি নিয়ে কথা বলার আগে একটু গল্পটা বলে নেওয়া যাক। ১০ বছর বয়সী দুরন্ত কিশোর জামাল মায়ের সাথে প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করে। যার ইচ্ছা তার খেলার সাথীকে নিয়ে মেলায় যাবার যেখানে রয়েছে তাদের কল্পনার বাইরের এক জগত, যা তারা কেউ দেখেনি শুধু শুনেছে। বাল্য বিবাহের যাতাকলে পিষ্ট এ সমাজে জামালের বান্ধবীর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। একাকী এগিয়ে চলে জামাল ও ‘মাটির প্রজার দেশে’ চলচ্চিত্র।

খুব সরল একটি গল্প, কিন্তু এ সরলতার মাঝেও লুকিয়ে রয়েছে জটিল এক বার্তা। তথাকথিত সমাজের মুখে প্রতি পদে পদে চপেটাঘাত করে এগিয়ে এ চলচ্চিত্র। শিল্পের ছোঁয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের ভালো-মন্দ দিকগুলোকে দেখিয়ে চলছে।

‘মাটির প্রজার দেশে’র প্রধান চরিত্র কোনটি? বলতে হবে এ সিনেমার প্রধান কোন চরিত্র নেই, এক একটি চরিত্র একটি একটি স্তম্ভ। একটিকে ছাড়া অপরটিকে বিবেচনা করা খুব কষ্টকর। জোর করে কোন চরিত্রকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, আবার হুট করে উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়নি। যতটুকু দরকার ঠিক ততটাই দেওয়া হয়ছে। যাকে বলা হয় ‘ওয়েল কুকড।’

ফাতেমা, লক্ষ্মী, রাজ্জাক হুজুর, জামাল কিংবা স্কুলের সেই কেরানি বা ছোট মেয়েটি সবাই একে অন্যের সাথে জড়িত। এখানেই গল্পের সার্থকতা, এখানেই গল্পের বুবনের গভীরতা বুঝা যায়। এ সিনেমা কতগুলো পুরস্কার পেল-কতগুলো পায়নি সেটা দেখার আসলেই বিন্দুমাত্র সময় নেই। কারণ চলচ্চিত্রটি আসলেই সুনির্মিত। পুরস্কার এখানে নিতান্ত একটি প্রভাবক মাত্র সিনেমার প্রচারের ক্ষেত্রে।

প্রথমে একটি কথা বলেছিলাম ‘আমরা কি পেরেছি চলচ্চিত্রের শক্তিশালী ভাষার যথাযথ ব্যবহার করতে?’ এবার উত্তর দেবার পালা। হ্যাঁ, আমরা না পারলেও ‘মাটির প্রজার দেশে’ পেরেছে চলচ্চিত্রের শক্তিশালী ভাষার যথাযথ ব্যবহার করতে। প্রতিটি চলচ্চিত্রের একটি নিজস্ব ভাষা থাকে, ‘মাটির প্রজার দেশে’র নিজস্ব ভাষা আছে। যাকে বলে চিত্রনাট্য। কখনো ঘোমটার মধ্য দিয়ে সংকুচিত হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনকে দেখিয়েছেন, কখনো জানালার শিক ধরে জীবনের স্বপ্নগুলোকে বন্দী করে রাখা বৃদ্ধার চোখের ভাষাকে পড়তে সাহায্য করেছে, কখনো বা পালকি থেকে নেমে দৌড়ে যাওয়া লক্ষ্মীকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার শেকল ছিড়ে বের হবার দিক নির্দেশনা করেছে। পানি থেকে উঠানোর পর মাছের লাফালাফি দিয়ে জামালের মনের অবস্থা বুঝিয়েছে, দূরের আকাশে রক্তিম সূর্য দিয়ে নব জীবনের গানের সূচনা দেখিয়েছেন। দৃশ্যগুলো জুড়ে ছিল সিনেমাটোগ্রাফির জাদু।

সাউন্ড, এডিটিং নিয়ে কথা বলার কিছু আছে বলে মনে হয় না। শুধু বলা উচিত, শতভাগ সিনকোনাইজড সাউন্ডের জন্য ‘মাটির প্রজার দেশে’ শতভাগের থেকেও বেশি নাম্বার পাবে। পরিচালক বিজন ইমতিয়াজের কাজ দেখে মনে হবে না এটি তার প্রথম কাজ। ২০-৩০টা চলচ্চিত্রে কাজ করা পরিচালকও এধরনের কাজ করতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই আসবে।

অপূর্ব কাব্যময় এই চলচ্চিত্র। ‘পথের পাঁচালী’র কাঁশবনের ভেতর দিয়ে অপু-দুর্গার দৌড়ের কথা মনে করিয়ে দেয় জামাল আর লক্ষ্মীর দৌড়, যদিও মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণে এই দৌড়ের মানে পুরোটাই ভিন্ন অর্থ বহন করে। সত্যজিৎ রায় যদি এ সিনেমা দেখত তাহলে তিনিও বলতেন ‘মাটির প্রজার দেশে’ একটি কাল্ট সিনেমা, একটি ক্লাসিক সিনেমা।

‘মাটির প্রজার দেশে’ আসলেই বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কাল্ট সিনেমা হিসাবে বিবেচিত হবে অদূর ভবিষ্যৎ- এ একথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার পর সেরা বাংলা সিনেমার তালিকায় থাকবে ‘মাটির প্রজার দেশে’। সংসারকে উপজীব্য করে জহির রায়হান বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্যাতন যেভাবে তুলে ধরেছিলেন বিজন ইমতিয়াজ তার ‘মাটির প্রজার দেশে’ সিনেমাতে জামালের জীবন সংগ্রামকে উপজীব্য করা আমাদের দেশের মুখোশধারী মানুষগুলোর মুখোশ উন্মোচন করেছেন।

রেটিং : ৮.৫/১০


মন্তব্য করুন