Select Page

প্রচারবিহীন সফল আওয়াজ ‘মাটির প্রজার দেশে’

প্রচারবিহীন সফল আওয়াজ ‘মাটির প্রজার দেশে’

মাটির প্রজার দেশে– বিকল্প ভাবনার সিনেমাটির কাজ শেষ হয়েছে ২০১২ সালে। বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত এই সিনেমা বড় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল গত ২৩ মার্চ তাও আবার ঢাকার দুটো আর রাজশাহীর একটি হলে। এই নিয়ে দর্শকদের মনে নানান প্রশ্ন, হল মালিকরা বলেছেন– টেলিফিল্ম।কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সিনেমাটি পুরো সপ্তাহ জুড়ে চলেছে হাউজফুল।

এই বিষয়ে সিনেমাটির প্রযোজক আরিফুর রহমান বলেছেন, চলচ্চিত্রটিকে আর্ট ফিল্ম ভেবে পরিবেশনায় এগিয়ে আসেনি কোনো পরিবেশক। এমনকি চলচ্চিত্রটির প্রচারণায় নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও কোনো টাইটেল স্পন্সর না পাওয়ায় অর্থসংকটে ব্যাহত হয়েছে প্রচারণাও।

সিনেমাটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় ২০১৬ সালে সিয়াটল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ওই বছরেই শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয় গুপী বাঘা প্রডাকশনস লিমিটেডের ছবি ‘মাটির প্রজার দেশে’। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক রামশ্রেয়াস রাও ও এন্ড্রু ওয়েসমান। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, কচি খন্দকার, শিউলি আক্তার, চিন্ময়ী গুপ্তা, রমিজ রাজু, আবদুল্লাহ রানা, মনির আহমেদ শাকিল, রিকিতা নন্দিনী শিমু, প্রধান চরিত্রে মাহমুদুর অনিন্দ্য এবং আরো কিছু শিশু শিল্পী।

বিকল্প ব্যবস্থায় ৬৪ জেলায় যাওয়ার কথা ভাবছেন চলচ্চিত্রটির নির্মাতা ও প্রযোজক আরিফুর রহমান। এবার ছবিটি বিকল্প পদ্ধতিতে দেশের ৬৪টি জেলার দর্শকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হলো। চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘মাটির প্রজার দেশে’ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর এই যাত্রা শুরু হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে জানালেন প্রযোজক।

এবার হলে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে একেবারেই আলাদা ছিল, কারণ বিরতিতে যাবার আগ অব্দি গল্পের ধারাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। লক্ষী চরিত্র পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে- এখানে বাল্যবিবাহ দেখানো হয়েছে। আবার জামালকে দেখে মনে হচ্ছিল তাকে আবর্তন করে চারদিকে ঘটে চলেছে নানা ঘটনা। এই দুটো চরিত্রের মাঝে সেতু আবিষ্কার করতে গিয়ে দর্শক একটা সময় বুঝতে পারে একটি গ্রামের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার দ্বারা পরিবেষ্টিত মাটির প্রজারা যারা একে অন্য সূতোর সাথে বাঁধা পড়ে আছে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে আশ্রিত ফাতেমা, তাকে উদ্ধার করেছে রাজ্জাক হুজুর। জামাল সেখানেই বড় হচ্ছে, স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ফাতেমা মুখোমুখি হয় তার অতীতের সাথে। হুজুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়ে বাঁধা পড়ে যান বিবেকের সামনে, এমন একটার পর একটা ঘটনার পর জামাল খুঁজে পায় তার পূর্ণাঙ্গ পরিবার।

এই সিনেমা দেখতে দেখতে দর্শকের মনে নানা রকম প্রশ্ন উদয় হয়েছে- এটা কি বাংলাদেশের কাহিনী নিয়ে করা ছবি, এখানে এমন পালকির ব্যবহার কেন? আমিও প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম পরিচালকের মুখোমুখি সুদূর আমেরিকাতে। তিনি মেসেঞ্জারে তার চিত্রনাট্য লেখার গল্পটা বলে গেলেন-

মাটির প্রজার দেশে’র বিষয়বস্তু বাস্তবধর্মী হলেও নির্মাণশৈলী আসলে অনেকটা স্বাপ্নিক, সেই ক্ষেত্রে রিয়েলিস্ট approach নেয়া হয়নি। আমি আসলে ভাবিনি এটা কোন সময়ের গল্প অথবা কোন এলাকার গল্প। ছবির কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কোন সালে অথবা কোন অঞ্চলে আছি আমরা। বাস্তব জগতের অনেক মানুষের সাথে চরিত্রগুলোর মিল থাকতে পারে, ফুলবাড়ি গ্রামের সাথে বাংলাদেশের অনেক গ্রামেরও মিল থাকতে পারে- কিন্তু মাটির প্রজার দেশে’র সব চরিত্র ও ছবি শুধুই মাটির প্রজার দেশের জগতের; কোন নির্দিষ্ট সময় অথবা অঞ্চলের নয়। লাল রঙের পালকিটিও সেই চিন্তার ব্যতিক্রম নয়, এরকম পালকি বাংলাদেশে নেই, কিন্তু মাটির প্রজার দেশে’তে আছে।

দ্বিতীয় প্রশ্নটা করেই ফেললাম- বাল্য বিয়ে দেখানোর মধ্য দিয়ে কি ব্যবসায়িক কোন কারণ ছিল, যেমন এমন ছবিগুলো অনেক দেশে পুরস্কার পায়।

পরিচালক বলেন, লক্ষ্মী চরিত্রটি আসলে আমার বড়মা’র অনুপ্রেরণা। আমার নানুর মা। উনি একশ বছরের বেশী বেঁচেছিলেন। আমার নানা মারা গিয়েছিলেন খুব অল্প বয়সে তাই আমার মামা, মা, খালারা নানা বাড়িতে বড় হয়েছেন। বড়মা ছিলেন উনাদের অভিভাবক। মা’র কাছে শুনেছি উনাকে সবাই অনেক ভয় পেতেন। আমি তখন অনেক ছোট, বড় মা’কে দেখতে আমরা সবাই গিয়েছিলাম, তখন উনার কাছেই আমি তার ছোটবেলার গল্প শুনেছিলাম। উনার বিয়ে হয়েছিল ৭ বছর বয়সে এবং বিয়ের দিন উনাকে যখন পালকি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল উনি পালকি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়েছিলেন। সারা সন্ধ্যা আশেপাশের গ্রাম খুঁজে তাকে পাওয়া গিয়েছিল। একটা ছোট্ট মেয়ে লাল শাড়ি পড়ে সবুজ ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে- এই চিত্রটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে গল্পটি period piece ছিল। কিন্তু আমি আর আরিফ যখন পুরো বাংলাদেশ ঘুরছি লোকেশনের জন্য, তখন আমি একটা বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলাম বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রামে। আমি জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম যে কনের বয়স ১৩, ঠিক তখন থেকেই আসলে সময়কাল আর গুরুত্বপূর্ণ রইল না আমার কাছে। আর সত্যি বলতে চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে, আমি বাল্য বিবাহ নিয়ে আগ্রহী নই। আমি আগ্রহী লক্ষ্মী নামের একটি মেয়ের গল্প বলতে, যার জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে একটা সত্য হচ্ছে ওর বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সে। আর মাটির প্রজার দেশে একটি কাল্পনিক গল্প, এটা তথ্যচিত্র নয়, তাই বাস্তব বাংলাদেশের সাথে মিল থাকতে হবে বলে আমি মনে করি না। আর যদি পুরস্কারের কথাই বলেন, আমার মনে হয় না শুধু একটা image ব্যবহার করে পুরস্কার পাওয়া সম্ভব, সেই image কি বলতে চাইছে এবং কেন বলতে চাইছে সেটাই মুখ্য বিষয়।

চিত্রনাট্য পরিচালক নিজেই করেছেন। সিনেমার শ্যুটিং করেছেন মূলত রাজশাহীর চারঘাট এবং তার আশপাশের এলাকায়। শুধু ধানক্ষেতে পালানোর দৃশ্যটি ছিল ধামরাইয়ে।

যে বিষয়টা জানার তীব্র কৌতুহল ছিল প্রশ্নটা করেই ফেললাম- শুনেছি দীর্ঘ আট বছর লেগেছে সিনেমাটি মুক্তি দিতে, ভেতরের কথা জানতে চাই।

বিজন বললেন, অর্থ অবশ্যই একটা বিষয় আমাদের জন্য। আমরা অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে ছবিটি শেষ করে বাংলাদেশের মানুষকে ছবিটি দেখাতে পারছি। আমার পরিচিত অনেকেই জানি তারা তাদের অনেক যত্নের কাজ শেষ করতে পারেননি। আমাদের সামগ্রিক সিনেমা ব্যবসার দিকটা অনেক আমলাতন্ত্র, অসততা, অপ্রয়োজনীয় গোলযোগে ভরা। সেটা আরেক দিনের দীর্ঘ আলোচনা।

সিনেমাটি মাত্র তিনটি হলে মুক্তি দিল, এ সম্পর্কে আপনার অভিব্যক্তি।

পরিচালক বললেন, প্রথমত; আমার শিল্পচর্চার সাথী আরিফুর রহমান আর আমি স্বাধীন ধারার নির্মাতা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে “স্বাধীন ধারার নির্মাতা” এই কথাটার মানে কী? আমার কাছে এর মানে হচ্ছে, মুক্তভাবে কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে আমরা যা বলতে চাই তা আমাদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলতে পারা। আমাদের ছবি আমাদের চিন্তার অভিব্যক্তি। কেউ টাকা দিলো বলে ছবি বানানো অথবা এখন একটা ট্রেণ্ড চলছে তাই সেই ভাবে ছবি বানালে পয়সা কামানো যাবে- এরকম প্রজেক্ট করতে আমরা আগ্রহী না। তার মানে কি আমাদের বাণিজ্যিক কোন উদ্দেশ্য নেই? অবশ্যই আছে। আমাদের পরিবার আছে, বাবা মা সন্তান আছে, মাস শেষে বাড়ি ভাড়া আছে, দায়িত্ব আছে। দিন শেষে আমরা ভিজ্যুয়াল মিডিয়াতে কাজ করেই ভাত খাই। আমাদের বাণিজ্যিক পরিকল্পনাটাও আমাদের মতই যেটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই আমাদের মত নির্মাতা আছে এবং আমাদের মত ছবির বাজার আছে। পার্থক্য হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের মত “বিকল্প ধারা” পদবি দেয়া হয় না। ভিন্ন Genre-র ছবির জন্য ভিন্ন বাণিজ্যিক মডেল থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা সেই প্রক্রিয়া দিয়েই যাচ্ছি।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ডিস্ট্রিবিউটাররা মার্কেটিং-এর কোন দায়িত্ব নেয় না অথবা কোন টাকা আসলে ইনভেস্ট করেন না। তাদের কাজ একটাই- হল বুক করা এজেন্টের মাধ্যমে। তাই আসলে তাদেরকে ডিস্ট্রিবিউটার উপাধি দেয়া যায় কিনা সন্দেহ আছে। মার্কেটিং-এর সম্পূর্ণ ব্যয়ভার নির্মাতাদেরই নিতে হয়। এবং বাংলাদেশ মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে হলের প্রজেক্টরের আলদা ভাড়া আছে, সেই প্রজেকশন সিস্টেমে ফাইল আপলোড করতেও আলাদা ফি আছে। এছাড়া আর অনেক সরকারি ফি, এজেন্ট ফি, আর অনেক লুকনো ফি তো আছেই। একটা ১০০ টাকার টিকিটে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আসলে কত টাকা পায় সেটা শুনলে আপনারা আকাশ থেকে পড়বেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, নির্মাতার ছবি বানানোর পর হল পর্যন্ত যেতে অনেক খরচ আছে। যেটা আমাদের নেই। তাই আমরা স্বল্প পরিসরে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মার্কেটিং করছি। আর হল সংখ্যার কথা বললে, আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মডেল অনুসরণ করছি। ছোট সংখ্যা দিয়ে শুরু করা, এর পরে সেখান থেকে যদি মানুষ পছন্দ করে হল সংখ্যা বাড়ানো।

তৃতীয়ত, আমরা বিশ্বাস করি “মাটির প্রজার দেশে” দেখার মত দর্শক বাংলাদেশে অনেক আছেন। এই রিলিজের মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্য তাদের সাথে একটা যোগাযোগ তৈরি করা। অন্য কোন ছবির সাথে প্রতিযোগিতা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে আমরা ছবিটি দেখিয়েছি, অনেক মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত যে আমরা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছবিটি স্বল্প পরিসরে হলেও নিয়ে যেতে পারছি এটা আমাদের জন্য একটা অনেক বড় পাওয়া।

কোন গান রাখা হয়নি বলে অনেকেই বলেছে আর্টফিল্ম, আপনার মতামত কী?

তিনি বললেন, আসলে organic-ভাবে কোথাও গান রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। তাই কোন গান নেই। আর আমি ঠিক জানি না মানুষ আর্টফিল্ম বলতে কী বুঝায় আর বাণিজ্যিক ছবি বলতেই কী বুঝায়। পথের পাঁচালি ব্যবসা করেছে, আমাদের মাটির ময়না আমেরিকার ৩৪টা শহরে ৪ মাস চলেছে, আসগার ফাহরাদির A Separation সারা দুনিয়ায় ২২ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে; সেখানে গান তো দূরের কথা আবহ সঙ্গীত পর্যন্ত নেই। সারা পৃথিবীতে বাস্তবধর্মী ছবি হলেই তাকে আর্টফিল্ম অথবা বিকল্প ধারা বলে না। শুধু আমাদের দেশে মনে হয় এই categorization আছে। এমনকি Bollywood ও এখন বাস্তবধর্মী ছবি বানাচ্ছে নিয়মিত এবং সেই ছবিগুলো ব্যবসা করছে খুব ভালোভাবেই। শুধু আমরাই মনে করি এক ধরনের ছবি ছাড়া কোন কিছুই ব্যবসা করতে পারবে না। বাংলাদেশের দর্শক খুব একটা পিছিয়ে নেই। তারা নিয়মিত বিশ্ব সিনেমার খবর রাখেন এবং দেখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই “বিকল্প ধারা” তকমাগুলো দর্শক থেকে আসে না। আসে ইন্ডাস্ট্রির সেই সব মানুষদের থেকে যারা পরিবর্তনকে ভয় পান, কারণ তারা মনে করেন নতুন ধারা প্রতিষ্ঠিত হলে তার প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বেন। তাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অনেক ক্ষমতাধর মানুষগুলোই সবসময় নতুন কোন ধারণাকে সফল হতে দিতে চান না। কিন্তু সত্যি বলতে পরিবর্তন আসবেই, যদিও সেটা সময়ের চাহিদা।

এত গেল সিনেমা নিয়ে পরিচালকের কথা, কিন্তু দর্শক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে “মাটির পজার দেশে” একটি সাংঘাতিক মেসেজ। এখানে এমন কিছু সংলাপ আছে যা ইসলাম-ধর্ম সম্মত, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক। পরিচালক বিজন ইমতিয়াজ ধর্মতত্ব নিয়েই পড়াশোনা করেছেন। কুরআন এবং ইসলামিক আইন নিয়েই বেশী সময় কাটিয়েছেন তিনি। সিনেমায় যে আধুনিক হুজুরকে দেখা যায় চরিত্রটি বিজনের আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন যা তিনি শক্তিশালী সংলাপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সিনেমা নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলাম- বাংলা সিনেমা নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে কি? লস এঞ্জেলেসে কোন ধরনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ?

বিজন বললেন, আমি গল্প বলতে ভালোবাসি, এই কাজটিই করতে চাই বাকি জীবন। সেই ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশেই কাজ করবো এমন কোন কথা নেই, আবার বাংলাদেশে কাজ করবো না সেটাও না। সমান্তরালভাবে সবই চলবে। আমি আর আরিফ নিয়মিত documentary করছি। আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের লাইভ ফর্ম ঢাকা’র আন্তর্জাতিক পরিবেশনা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের পরের ছবির একটার চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে, আরেকটা চিত্রনাট্য লিখছি এখন যেটার জন্য একজন আমেরিকান প্রযোজক যুক্ত হয়েছেন। এই মুহূর্তে জাপানিজ নির্মাতা মাকতো সুগানো’র পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি ডল হাউস প্রযোজনা করছি গুপী বাঘা থেকে। আমার আমেরিকান বন্ধুদের সাথেও কিছু গল্প ডেভেলপ করছি। আসলে একটা ছবির সফলতা অথবা বিফলতা আমাদের প্রেরণা নয়। আমরা ম্যারাথন দৌড় শুরু করেছি, স্প্রিন্ট এ আমরা আগ্রহী নই।

বলছিলাম সিনেমার সংলাপের কথা। ফাতেমাকে যখন জামাল স্কুলে ভর্তি করে দেবার প্রস্তাব করে তখন ফাতেমা বলে-আমি এতো টাকা কই পামু? এখানে একজন মায়ের অসহায়ত্ব চরমভাবে ফুটে ওঠে। লক্ষীকে তার মা ভাত খাইয়ে দিতে দিতে বলে- জামাই যদি তোর হাত ধরে, ধরতে দিস মা। এই সংলাপের মধ্য দিয়ে একজন হতদরিদ্র মায়ের করুণ অবস্থা স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে। এমন করে হুজুর যখন ফাতেমাকে উদ্দেশ্য করে বলে- পরকালে বিচার হবে আত্মার, রুহের। শরীর কিছু না। মনটাই আসল। পুরো দর্শক ভর্তি হল যেন কেঁপে উঠেছে একটি মাত্র সংলাপে। চিত্রনাট্যকার সংলাপের মধ্যে দিয়ে আমাদের সাধারণ জীবনের অনেক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

সিনেমার দৃশ্যায়ন ছিল ভীষণ রকম নান্দনিক যা চোখের ভেতর অনেক দিন লেগে থাকবে। জামালের সাথে ফাতেমার পাতা উড়ানো মাঠ, পেছনে গাছের গায়ে পড়া রোদ, পালকি থেকে লক্ষীর ছুটে পালানো, ক্যামেরার জুমশটে তার মুখ, ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালকি চলছে; পাশেই ইঞ্জিনচালিত পানির ঢল, আধো আলোতে ফাতেমার কপালে টিপ, অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে যাওয়া, আগুনের পাশে হুজুরকে আছড়ে ফেলানো, সূর্য ওঠার মুহূর্ত যার সামনে জামাল, ফাতেমা এবং রাজ্জাক হুজুরের ব্যাকশট। এমন দৃষ্টিনন্দন অনেকগুলো দৃশ্যের সমন্বয় ঘটেছে মাটির প্রজার দেশে চলচ্চিত্রে।

আমার চোখে এতকাল বাংলা সিনেমার ভিলেন হিসেবে-খ্যাত শাকিল আহমেদকে এমন আধুনিক হুজুর হিসেবে দেখে খানিক ধাক্কাই খেয়েছিলাম। সত্যি তিনি চিরায়ত চেনা চেহারাটা ভেঙে ফেলেছেন এক নিমিষেই। চমক খাওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হলো রুমা ভাবীকে রাগত গৃহকর্ত্রির ভূমিকায় দেখে। মেকাপ যিনি করেছেন তাকে ক্রেডিট দিতেই হবে কারণ, রুমা ভাবীকে চিনতে আমার ভালোই সময় লেগেছে।

জামালের মা অর্থাৎ ফাতেমার চরিত্রে চিন্ময়ী গুপ্তাকে নতুনভাবেই আবিষ্কার করলাম। সম্ভবত এটাই তার প্রথম চলচ্চিত্র। একটা দৃশ্যের পর নতুন আর একটা দৃশ্যে যাবার পর চরিত্রের যে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন চিন্ময়ী তা ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছে। বিশেষ করে সিনিয়র আর্টিস্টদের পাশে তার অভিনয়কে পোক্ত লেগেছে। রোকেয়া প্রাচী সবসময়ই আনপ্যারালাল, অনিন্দ্য দুর্দান্ত অভিনয় করেছে, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ আর সবাই যার যার চরিত্রে অকৃত্রিম।

একটি সিনেমাকে ঠিক সিনেমা হয়ে উঠবার জন্য যা যা উপসর্গ দরকার বিজন এবং আরিফ দু’জন মিলে তাই দিয়েছে; অবশ্য গান থাকলে আমার আরো ভালো লাগতো এবং পুরো টিম বেশ আবেগী করে দেবার মতোই একটি কাজ দর্শকদের উপহার দিয়েছে। হল থেকে বেরিয়ে আসবার সময় সবাই সাউন্ডের কথা খুব বলছিলেন, আসলে এই ধরনের মুভির অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের জন্য নতুন। সবার চোখে মুখেই তৃপ্তির ছায়া ছিল স্পষ্ট। তাই হল মালিকদের বলছি– কেবল যৌথ প্রচারনার উপর নির্ভর না করে এমন খাঁটি দেশীয় সিনেমাগুলোকে সাধারণ দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দিন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।


মন্তব্য করুন