Select Page

যে কারণে ‘কারণ’ এখনো মনে পড়ে

যে কারণে ‘কারণ’ এখনো মনে পড়ে

আমাদের সিনেমার দর্শকেরা বলিউড ও তামিল সিনেমায় রজনীকান্তকে দেখে বিনোদিত হয়, তামিল নায়কদের হিরোজমের ভক্ত হয়। অথচ আমাদের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও একজন রজনীকান্ত ছিলেন যার সিনেমা দেখতে ৮০- ৯০ দশকে সিনেমা হলে মারামারি লেগে যেতো নিয়মিত। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সেই রজনীকান্ত হলেন মেগাষ্টার খ্যাত উজ্জ্বল।

তার সিনেমা ৮০-৯০ দশকে ছিলো দর্শকদের কাছে ১৬ আনা পয়সা উসুল করা বিনোদন। উজ্জ্বলের সিনেমা মুক্তি পাওয়া মানেই সিনেমা হলে দর্শকদের মাঝে ধুন্ধুমার কান্ড, মারমার কাটকাট অবস্থা। উজ্জ্বলের সিনেমা মানেই বিশাল ক্যানভাসে বিগ বাজেটের সিনেমা।

৮০ এর দশকের শুরুতে মমতাজ আলীর ‘নালিশ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে রোমান্টিক ও ক্লাসিক সিনেমার তারকা ইমেজের উজ্জ্বলের যে পরিবর্তন হয় তা ছিলো রীতিমতো দর্শকদের কাছে এক বিস্ময়কর। ৭০ এর দশকের ‘বিনিময়’, ‘বলাকা মন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী’, ‘স্বীকৃতি’, ‘সমাধি’, ‘নাত বৌ’, ‘অনুরোধ’, ‘দাবী’সহ আরও অনেক মিষ্টি মধুর, শীতল, রোমান্টিক ও পারিবারিক গল্পের সিনেমার শান্তশিষ্ট ইমেজের দর্শকদের প্রিয়মুখ উজ্জ্বল হয়ে যান দুর্ধর্ষ ইমেজের এক নায়ক। দুর্ধর্ষ উজ্জ্বল হয়েই পরের এক দশক সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রি কাপিয়েছেন উজ্জ্বল।

যে মমতাজ আলী একসময় ওয়াসিমকে কেন্দ্র করেই সিনেমা বানাতেন তাকে পরে দেখা গেলো উজ্জ্বলকে নিয়েই সিনেমা হলে ঝড় তুলতেন। মমতাজ আলী-উজ্জ্বল জুটির তেমনই একটা ঝড় তোলা সিনেমার নাম ‘কারণ’, যা মুক্তি পেয়েছিলো ৯০ দশকের শুরুর দিকে। সিলেটের নন্দিতা সিনেমায় স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখার স্মৃতিটি আজও ভুলতে পারিনি। টিকেট কাউন্টার থেকে অনেক চেষ্টা করেও টিকেট কাটতে পারিনি। ৩ গুণ চড়া দামে ব্ল্যাকার থেকে টিকেট কিনে দেখেছিলাম তবু্ও এতটুকু কষ্ট পাইনি।

ছবির শুরুতেই মুখভর্তি দাড়িওয়ালা উজ্জ্বলের আগমন হতে না হতেই পুরো হল জুড়ে করতালিতে উজ্জ্বলকে দর্শকদের মুখরিত অভিবাদন। চলন্ত ট্রেনের ছাদে উজ্জ্বল ধাওয়া করছেন তার শত্রুকে এমন দুর্ধর্ষ দৃশ্য দিয়েই সিনেমার শুরু। উজ্জলের হাতে খুন হয় একজন আর সেই খুনের সাক্ষী হয়ে যায় ববিতা। ববিতার কাকুতি মিনতিতে উজ্জ্বল ববিতাকে খুন করে না, নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমরা মনে করি সিনেমার গল্প বুঝি শুরু কিন্তু না সিনেমার গল্পের শুরু হয় আরও পরে। খুনের সাক্ষী ববিতাকে উজ্জ্বল চোখে চোখে রাখে। ববিতার পরিবারের প্রতিও উজ্জ্বল দৃষ্টি রাখে। শহরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একের পর এক খুনে পুলিশ প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে কিন্তু খুনীকে কেউ শনাক্ত করতে পারেনা, খুনের রহস্যও উদঘাটন করতে পারে না। সবগুলো খুনের কোন সাক্ষী নেই।

ববিতার প্রেমিক মাহমুদ কলি পুলিশ অফিসারের উপর দায়িত্ব পড়ে খুনের রহস্য উদঘাটনের। পুলিশ যে খুনিকে খুজছে ববিতা সেই খুনির আশ্রয়ে যা ববিতা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। ববিতার কাছে এক আতংকের নাম উজ্জ্বল, ঘৃণিত ব্যক্তি উজ্জ্বল যে শহরের সবার কাছে একজন বড় ব্যারিস্টার হিসেবে পরিচিত। উজ্জলের বোবা ও মা হারা শিশু সন্তানের প্রতি ববিতার মায়া মমতা বাড়ে। একসময় উজ্জ্বলকে ববিতা প্রশ্ন করে তার স্ত্রী কোথায় আর কেন উজ্জ্বল এতো প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও অপরাধ জগতের বাসিন্দা। শুরু হয় এখান থেকেই সিনেমার গল্প।

ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় উজ্জ্বলের সুখের অতীত যা এক ভয়ানক ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায়। ব্যারিস্টার উজ্জ্বল আর শবনমের সুখের সংসার। একদিন মাফিয়া ডন আহমেদ শরীফের ভাইয়ের ফাসি হয় নীতিবান ব্যারিস্টার উজ্জ্বলের কারণে। আহমেদ শরীফ প্রতিশোধ নিতে উজ্জ্বলের ঘরে আক্রমণ করে। উজ্জ্বলকে নির্মম নির্যাতন করে ও তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে যে ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী তাদের একমাত্র সন্তান যে ঐ ঘটনার পর বোবা হয়ে যায়। শবনম মারা যায়। সেই কালো রাত্রের ঘটনা উজ্জ্বলকে তাড়িয়ে বেড়ায় আর তাই উজ্জ্বল প্রতিরাতেই সেই খুনীদের খুজে বেড়ায়। অনেক দিন পর শহরে ফিরে আসে পালিয়ে থাকা আহমেদ শরীফ ও তার দলবল। শুরু হয় আরেক গল্প।

… উজ্জ্বল ও তার সন্তানকে রক্ষা করতে পাশে দাঁড়ায় ববিতা।এমনই টানটান উত্তেজনায় ভরা পুরো সময়টা কেটে যায় দর্শকদের। এক বসাতেই দর্শক শেষ করে ‘কারণ’ নামের জমজমাট এক বাণিজ্যিক সিনেমা যার নায়ক উজ্জ্বল। মমতাজ আলী – উজ্জ্বল মানেই ভিন্নকিছু। আজকের তামিল/ তেলেগু সিনেমায় আমাদের দর্শকেরা যা দেখে মুগ্ধ হয় আজ থেকে ২৮/২৯ বছর আগের আমাদের বাংলাদেশের সিনেমায় তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমরা। তামিলের রজনীকান্ত আজ আমাকে টানে না, আমাকে টানে আমাদের নায়ক উজ্জ্বল।

সিনেমার বয়স আজ থেকে ২৮/২৯ বছর আগের হলেও ক্যামেরা, কালার গ্রেডিং সহ কারিগরি দিকগুলো ছিলো আজকের যে কোন সিনেমার চেয়ে এগিয়ে। প্রচুর ঝুকিপূর্ণ শর্ট ছিলো কিন্তু ক্যামেরাম্যান ছিলেন অনেক ডেডিকেটেড ও প্রশিক্ষিত যার কারণে প্রতিটি শর্ট বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছিলো। ছবির গল্পে ও চিত্রনাট্য ছিলো থ্রিলার ও টুইষ্টের দারুণ সংমিশ্রণ যার কারণে একটা মুহূর্তেও দর্শকদের বিরক্তির কারণ হয়নি। এই সিনেমার ‘এ জীবন তো আর কিছু নয়, তোমার আমার কাহিনি’ গানটির দুটো ভার্সনই ছিলো সে সময় সুপারহিট।

আজ থেকে ২৮/২৯ বছর আগে আমাদের সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, কলাকুশলীরা দর্শকদের প্রতি যে পরিমাণ আন্তরিক ছিলো তার ছিটেফোঁটাও আজকের কোন সিনেমায় দেখা যায়নি। আজকে ইন্ডাস্ট্রিতে সুপারষ্টারের অভাব নাই অথচ দর্শকদের জন্য একটা সত্যিকারের সুপারষ্টার নাই। মেধাবী পরিচালকদের নাকি অভাব নেই আজ অথচ দর্শকদের চাহিদা বুঝার মতো কোন মেধাবী পরিচালক নেই।


Leave a reply