Select Page

রিভিউ : মায়াবতী ও মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

রিভিউ : মায়াবতী ও মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

আজকাল আপনি দর্শক হয়ে যতই সৎ থাকেন না কেন, সমালোচক হয়ে সৎ থাকার নজির দেখাতে গেলে আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। বলা হবে কেন এটা করছেন ওটা করছেন ইত্যাদি। ছবি নির্মাণ করা পর্যন্ত ওটা নির্মাতার সম্পদ কিন্তু মুক্তির পরে ওটা হয়ে যায় দর্শকের সম্পদ। দর্শক থেকে কেউ কেউ হাত খুলে ছবি সম্পর্কে লিখলে তাকে সমালোচক বলা যায় পরিচিতির জন্য। স্বাধীনতা তার যতটুকুই থাক না কেন কথা বলতে গেলে তাকে কতিপয় আরো দর্শক যারা ছবি দেখেনি তারা বাধা দেয় কিংবা যারা ছবিটি দেখার মতো করে দেখেনি তারাও এতে যোগ দেয়। অতঃপর ঐ সমালোচকের ভাঁড়ে ভবানী।

এই যখন বাস্তবতা, এই যখন পরিবেশ এর মধ্য থেকেই কথা বলতে হবে নিজের জন্য। ছবি দেখা আর বলাই যখন নেশা বলতে তো হবেই। মৌলিক গল্পের ছবির জন্য দর্শকের বড় একটা অংশ খুব হা-হুতাশ করেন এখন। মৌলিক গল্পে ছবি কম নির্মিত হচ্ছে, যতটুকুই হচ্ছে তার মধ্য থেকে খুব ভালো গল্প ও নির্মাণের ছবি পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছে। ‘মায়াবতী‘ (২০১৯) এ সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন মৌলিক গল্পের ছবি। অরুণ চৌধুরী নির্মিত দ্বিতীয় ছবি। তাঁর প্রথম ছবি ‘আলতা বানু’ (২০১৭)। প্রথম ও দ্বিতীয় ছবির মধ্যে মিল হচ্ছে দুটোই নারীকেন্দ্রিক। নারীর সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরা এ পর্যন্ত তাঁর পরিচালনার অংশ। ‘মায়াবতী’ ছবি মায়া নামের একটি মেয়ের জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের ছবি।

মৌলিক গল্পের ছবি ‘মায়াবতী’-র গল্প প্রথমত কেমন সে কথা টানতে হয়। গল্প জীবনমুখী। একটি মেয়ে তার শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত যে ধরণের সামাজিক বাস্তবতা দেখে বড় হয় তারই ছাপ গল্পে আছে। মায়ার জীবন যেখান থেকে শুরু হয়েছিল পরিণতির দিকে যেতে যেতে তাকে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আর এ অভিজ্ঞতাকে বলা যায় অস্তিত্বের লড়াই।

গল্পের প্রধান চরিত্র মায়া-র ভূমিকায় অভিনয় করেছে সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা। তিশাই ছবির প্রাণ। ‘মায়া’ থেকে ‘প্রিন্সেস মায়া’ হয়ে ওঠার যাত্রায় তিশা নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করেছে তার আরো বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করা উচিত। তার চরিত্রের বিকাশে যতটুকু অভিনয় দরকার সে করে গেছে। তার বিপরীতে ইয়াশ রোহান চলনসই। ডায়লগ ডেলিভারিতে তাকে সচেতন হতে হবে। সিচুয়েশন ডিমান্ডে তার ডায়লগ ডেলিভারি সব জায়গায় ঠিক ছিল না। তিশার সাথে তার রসায়ন নিয়ে যে আশঙ্কাটা ছিল ছবিতে সেটা নেই, রসায়ন ভালো ছিল। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু সবসময়ের মতোই নিজের সেরাটা দিয়েছেন। এছাড়া ওয়াহিদা মল্লিক জলি, আফরোজা বানু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, অরুণা বিশ্বাস, দিলারা জামান, বিশেষ চরিত্রের আগুন সব মিলিয়ে ছবিটি মাল্টিস্টারার করা হয়েছে। আরো ভালো বিষয় হচ্ছে কিছু শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এক ছবিতে কাজে লাগানো হয়েছে।

ছবির নির্মাণ হচ্ছে গল্প বা স্ক্রিপ্টের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গল্প ও নির্মাণের সমান্তরাল বিন্যাস থাকলেই ছবিকে ওভারঅল ‘well-made’ বা ‘well directed’ বলা যায়। কিন্তু ‘মায়াবতী’ প্রথমটা করতে পারলেও দ্বিতীয়টিতে দুর্বলতা রেখেছে। গল্প ও নির্মাণে দুটি ভালো দিক আগে দেখা যাক তারপর দুর্বলতার কথা বলা যাবে। গল্পে একটা উল্লেখযোগ্য ভালো দিক ছিল সংলাপ। ছবির সংলাপ মনে রাখার মতো ছিল। বেশকিছু সংলাপ মনে দাগ কাটার মতো। যেমন –
১. মহাদেব-শিবঠাকুর-গণেশ সবাই পুরুষ সমাজটাকেও পুরুষই বানাইছে
২. সবসময় রাজারই কেন সাত রাণী থাকে রাণীদের সাত রাজা থাকে না কেন?
৩. হাফহাতা শার্টের টাকা দিয়া কখনো ফুলহাতা শার্ট পাওয়া যায় না
৪. যে মানুষ যুদ্ধে গিয়ে মারা যায় তার জন্য একরকম কষ্ট হয় আর যে মানুষ যুদ্ধে গিয়ে ফিরে আসে না বেঁচে আছে না মরে গেছে জানা যায় না তার জন্য আরেকরকম কষ্ট
৫. তুমি কি পৃথিবীর ওপর ঘৃণা করে ইচ্ছা করে কথা বলা বন্ধ করেছ মা?

নির্মাণে প্রথমত ভালো দিক দুটি –
১. লোকেশন ২. সুনির্দিষ্ট অতৃপ্তি
ছবির ফার্স্ট হাফের লোকেশন গ্রামীণ সৌন্দর্যকে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছে। সুনির্দিষ্ট অতৃপ্তির জায়গাটা ছবির একটা চরিত্রকে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ করে দেখানো হয়েছে যার সাথে একটা সংলাপের সম্পর্ক আছে।

এবার দুর্বলতার জায়গাটা বলা যাক। ছবিতে সেকেন্ড হাফের অনেক বড় একটা অংশকে টিপিক্যাল ওয়েতে টাইম পাস করে দেখানো হয়েছে। দর্শকের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে এ অংশটি। রহস্যভেদ করতে কতটুকু সময় লাগে সে সম্পর্কে বুদ্ধিমান দর্শকের আইডিয়া থাকার কথা কিন্তু সেটা যখন অনর্থক প্রচেষ্টায় লম্বা করা হয় ছবির শতভাগ ভালো নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। গানের মধ্যে ‘আটকে গেছে মন’ উপস্থাপনায় ভালো, ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’ লিপসিং প্রব্লেমের শিকার। এছাড়া মেকআপে দিলারা জামান ও অরুণা বিশ্বাস ক্ষেত্রবিশেষে পারফেক্ট ছিল না।

রিভিউ শিরোনামে ‘মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’ কথাটাকে ‘মায়াবতী’ ছবির ভালো-মন্দ হিসেবে বিবেচনায় নিলে দর্শক বা সমালোচক উপকৃত হবে এবং নিজেদের জিজ্ঞাসার জায়গাটাও পূরণ হবে। মৌলিক গল্পের ছবি ভবিষ্যতে ভালো গল্পের পাশাপাশি ওভারঅল ভালো নির্মাণের যেন হয় সেদিকে নজর দেয়া দরকার।

রেটিং – ৬/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন