Select Page

রূপনগরের রাজকন্যা শবনম

রূপনগরের রাজকন্যা শবনম

দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি শবনমের মতো কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে ততোটা মূল্যায়ন করেনি

সাদাকালো যুগে টেলিফোনে প্রেমিকার সাথে আলাপনের মাঝে নায়করাজ রাজ্জাকের লিপে ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ এই গানটি সিনেমাপ্রেমীদের অন্তরে এখনো বিরাজমান। যে অসাধারণ সৌন্দর্য্যের অধিকারিণীর উদ্দেশ্য এই গানটি গাওয়া হচ্ছিলো; তিনি শবনম। তার প্রকৃত নাম হচ্ছে ঝর্ণা বসাক।

১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ননী বসাক ছিলেন স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারী। পরিবারের আগ্রহের কারণে শৈশবেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখেছিলেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে সেই সময় তিনি পরিচিতি লাভ করেন। একটি নৃত্যের অনুষ্ঠানে কিংবদন্তী পরিচালক এহতেশাম তার নাচ দেখে ‘এদেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের নৃত্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। মায়ের আপত্তি থাকার পরও বাবার অনুমতি নিয়েই তিনি আরও কিছু চলচ্চিত্রে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। এভাবেই চলচ্চিত্র জগতে আগমন ঝর্ণা বসাকের, তখনো তিনি শবনম হননি।

পরিচালক এহতেশামের ভাই মুস্তাফিজের নজর কাড়তে সক্ষম হন শবনম। মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন‘ সিনেমাতে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ সিনেমাতেই ঝর্ণা বসাক থেকে হয়ে উঠেন শবনম। এই সিনেমার ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘আমি রূপ নগরের রাজকন্যা’ গানটির কল্যাণে রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। এই শবনম নামেই তিনি তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে (পরবর্তীতে পাকিস্তান) তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। পাকিস্তানে তিনি আজো কিংবদন্তি একজন তারকা হিসেবে পরিচিত। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও শবনমের আগে কিংবা পরে পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে এতো জনপ্রিয়তা আর কারো ভাগ্যে জোটেনি। টানা তিন দশক রাজত্ব করা চাট্টিখানি কথা নয়।

‘হারানো দিন’-এর পর ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’র মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান পান। এ দুটি সিনেমাই তৎকালীন ঢাকায় নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত। পরের বছর ‘তালাশ’ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ওই সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসাসফল সিনেমার মর্যাদা লাভ করে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। পেশাজীবী মনোভাবের কারণে তিনি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচীতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। তিনি নায়িকা হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে ধ্বস নামার পূর্বে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন।

সম্ভবত বিশ্বে শবনমই একমাত্র চলচ্চিত্র অভিনেত্রী যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনটি দশক ধারাবাহিক ও সফলভাবে রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছিলেন। শবনম-নাদিম জুটির অভিনীত ‘আয়না’ হলে দীর্ঘদিন যাবৎ চলার রেকর্ড করেছিলো। যা এখনো অন্য কোন সিনেমা ভাঙতে পারেনি। পাকিস্তানে শবনম-ওয়াহিদ মুরাদ, শবনম-নাদিম জুটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে শবনম-নাদিম জুটির আলাদা একটা খ্যাতি এবং আবেদন ছিলো সেসময় যা আজো লক্ষ্য করা যায়। এমনকি এই প্রজন্মের বহু পাকিস্তানি তারকা শবনমকে ‘আইডল’ মানেন।

২০১৯ সালে পাকিস্তানে ‘লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো শবনমকে। যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশটির শোবিজ অঙ্গনের সব তারকারা। আর এই অনুষ্ঠানেই সবার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন অভিনেত্রী শবনম। তার হাতে আজীবন সম্মাননা তুলে দেন ইউনিলিভারের চেয়ারম্যান সাজিয়া সাঈদ। এই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা ফয়সাল কোরেশি, অভিনেত্রী সাবা কামারসহ তুমুল জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আতিফ আসলামও শবনমকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হন। তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতেও নাকি হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিলো। শবনমের পা ছুঁয়ে সম্মান জানান আতিফ আসলাম। দর্শক সারি থেকে গাইতে গাইতে শবনমকে মঞ্চে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে। একজন শিল্পী হিসেবে জীবনের শেষভাগে এসে এই সম্মান প্রাপ্তির পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছসিত এবং আনন্দিত তিনি।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি ১৮০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শবনম ১২ বার নিগার পুরস্কারের পাশাপাশি তিনবার পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। কাজী হায়াতের পরিচালনায় ও ঢাকা প্রোডাকশনের ব্যানারে তিনি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ আম্মাজান চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমার মাধ্যমে ঢালিউডে ‘আম্মাজান’ হিসেবেও খ্যাতি পান তিনি। মাঝে কিছু অফার পেলেও মনমতো না হবার কারণে করেননি তিনি। রাগ, অভিমান ও ক্ষোভের কারণে নিজেকে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে গুটিয়ে রেখেছেন। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও তার দেহ এফডিসিতে যেন না নেয়া বলে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

অনেক বছর অভিনয়ের বাইরে থাকলেও শবনম এখনো বিচরণ করেন তার ভক্তদের মনে। তবে ৮২ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি শিল্পী আবারো কাজ শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের একটি চলচ্চিত্রে; যার নাম ‘আয়না টু’। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে মুক্তি পাওয়া ‘আয়না’ ছবির সিক্যুয়েল এটি। এই সিনেমায় তার সাথে জুটি হিসেবে দেখা যাবে নাদিমকে। তবে করোনার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায় এই সিনেমার।

বাংলাদেশে হারানো দিন, নাচের পুতুল, জুলি, যোগাযোগ, এদেশ তোমার আমার, কারন, কখনো আসেনি, সহধর্মিণী, সন্ধি, দিল, আম্মাজানের মতো কালজয়ী সিনেমা উপহার দেয়া শবনম পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে নিয়মিত কাজ করার কারনে বাংলাদেশে সিনেমায় কাজ করতে পেরেছেন কম। তবে যেকয়টি সিনেমায় তিনি কাজ করেছেন প্রতিটা সিনেমাতেই নিজের নামের সম্মান রেখেছেন তিনি। যে সফলতা, প্রশংসা বা জনপ্রিয়তা তিনি তার প্রথম সিনেমা ‘হারানো দিন’ সিনেমায় পেয়েছিলেন সেই একই রকম জনপ্রিয়তা তিনি তার মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ চলচ্চিত্র ‘আম্মাজান’ সিনেমার জন্যও পেয়েছেন।

জীবনের এ পর্যায়ে এসে কোনো না পাওয়া কিংবা চাওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে একটি সাক্ষাৎকারে কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘অভিনয় জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। এখন আর তেমন কিছু চাওয়ার নেই। তবে যতদিন বাঁচি যেন সুস্থ থাকি এটাই প্রত্যাশা করি। এ জীবনে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো কষ্ট নেই।’ তবে অভিনয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ আছে। তিনি বলেন, ‘অভিনয়ই তো আমার পেশা। শিখেছি তো অভিনয়। অভিনয় করার ইচ্ছা আছে। তবে অভিনয় করতে না পারলে কোনো কষ্ট থাকবে না এটাও সত্যি।’

১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষকে। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন রবীণ ঘোষ। তারপর থেকে একমাত্র পুত্র রনি ঘোষকে নিয়ে ঢাকার বারিধারার ডিওএইসএসে সময় কাটে এখন এই কিংবদন্তির। তবে তার ছেলে এখন ব্যবসার কাজে লন্ডনেই সময় কাটান বেশি।

আশির দশকের শেষদিকে পাকাপাকিভাবে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন শবনম। পাকিস্তানের নানা সংবাদপত্রে তখন লেখা হয়েছিল শবনমের চলে যাওয়া পাকিস্তানের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ধস নামায়। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সেই ইন্ডাস্ট্রির কাছ থেকে তার এমন ভালোবাসা এবং সম্মান প্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্যও গর্বের। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি শবনমের মতো কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে ততোটা মূল্যায়ন করেনি। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের ভক্তদের অন্তরে ‘রূপ নগরের রাজকন্যা’ হিসেবেই তিনি রয়ে যাবেন চিরকাল।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন