Select Page

চলচ্চিত্রের সুবর্ণা মুস্তাফা ও একটি আক্ষেপ

চলচ্চিত্রের সুবর্ণা মুস্তাফা ও একটি আক্ষেপ

বিভিন্ন সিনেমার দৃশ্যে সুবর্ণা মুস্তাফা

প্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে নিয়ে আক্ষেপ কাজ করে। তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার এত সংক্ষিপ্ত হবে ভেবে। অবশ্য সুবর্ণার এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। তাঁর ভাষায়-‘জীবনের কোনো কাজ নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই, যেটা ঘটার ছিল ঘটেছে।’ তারপরেও তাঁর প্রতিভা অনুযায়ী শাবানা, কবরী, ববিতাদের মতো তাঁরও একটা নাম থাকতে পারত তাঁদের মতো স্টারডম নিয়ে।

হ্যাঁ, সুবর্ণা ঢালাওভাবে সব ছবিতে কাজ করতে চাননি তা সত্য। বেছে বেছে কাজ করেছেন। ঐ বেছে বেছে কাজটাই যদি আরো বড় করতেন তাহলে আমরা কালজয়ী আরো একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে পেতাম শাবানা, কবরী, ববিতাদের মতো।
সুবর্ণা মুস্তাফার ছবিগুলো হচ্ছে – ঘুড্ডি, নয়নের আলো, নতুন বউ, লাল সবুজের পালা, সুরুজ মিয়া, ফুলের মালা, স্ত্রী, অপহরণ, কমান্ডার, শঙ্খনীল কারাগার, পালাবি কোথায়, ফাঁসি, রাক্ষস, দূরত্ব, খণ্ডগল্প-৭১, হেডমাস্টার, আঁখি ও তার বন্ধুরা, গহীন বালুচর।

সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ১৯৮০ সালে যে সুবর্ণাকে চলচ্চিত্রে ব্রেক দিয়েছিলেন তাঁকে দেখে তখনকার তরুণ প্রজন্ম আজকের কালচারে যাকে বলে ‘ক্রাশ খাওয়া’ সেটাই খেয়েছিল। ছবিতে সুবর্ণা ছিলেন অসম্ভব রকমের স্টাইলিশ, আধুনিক। রাইসুল ইসলাম আসাদ ছিল তাঁর সহশিল্পী। আসাদের সাথে রসায়নটাও ছিল অনবদ্য। আধুনিক সমাজ, মন-মানসিকতা এসবের সীমাবদ্ধতাকে চপেটাঘাত করা এ ছবিটি ছিল বক্তব্যধর্মী। মিউজিক্যাল ছবি ‘নয়নের আলো’ ছিল মাইলফলক। জাফর ইকবালের বিপরীতে সুবর্ণা এ ছবিতে মায়াবী এক চরিত্র। ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’ গানটিতে তাঁর রোমান্টিক উপস্থিতি দর্শককে আপ্লুত করবে।

১৯৮৩ সালে ‘নতুন বউ’ ছবি দিয়ে তখনকার নাটকে ক্রেজ সৃষ্টি করা জুটি আফজাল হোসেন-সুবর্ণা আসে। ছবিটিতে সুবর্ণা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তারিক আনাম খানের সাথে ‘লাল সবুজের পালা, সুরুজ মিয়া’ ছবি দুটিও উল্লেখযোগ্য। তখনকার বাংলা নাটকের একচ্ছত্র আধিপত্যের সুবর্ণা সাহিত্যভিত্তিক ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবিতেও দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে মোস্তাফিজুর রহমান ছবিটি নির্মাণ করেন।

বাণিজ্যিক ছবিতে ‘পালাবি কোথায়, স্ত্রী, কমান্ডার, অপহরণ, রাক্ষস, ফাঁসি’ এগুলো ছিল তাঁর নিজেকে কমার্শিয়ালি এক্সপেরিমেন্ট করার প্রক্রিয়া। হুমায়ুন ফরীদির সাথে সুবর্ণার বাণিজ্যিক ছবিগুলো ছিল অসাধারণ। বাণিজ্যিক ছবিতেও বক্তব্যধর্মী একটা ভাষা থাকত তাঁর।

‘পালাবি কোথায়’ ছবিতে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনের গল্পে পুঁজিবাদী মালিক ফরীদির নারীলোভী মানসিকতার শিকার হয় সুবর্ণা। কলিগ শাবানার বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে যায়। ‘রাক্ষস’ ছবিটিতে ফরীদির ভয়ঙ্কর থাবা থেকে সুবর্ণা রেহাই পায় না। সুবর্ণার মা-বাবাকে হত্যা করে তাকে পাবার জন্য। আলমগীরের সাথে বিয়ে হবার পরেও ফরীদি তাঁকে খোঁজে।

‘অপহরণ’ কমেডি ছবি তবে এখানেও সুবর্ণার প্রতিবাদী ভূমিকা ছিল পুলিশের চরিত্রে। মূলত এ ছবিগুলোতে সুবর্ণা নারী অধিকারের একটা প্রতিবাদী ভাষা প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর বাণিজ্যিক ছবি এজন্যই আলাদা। ‘দূরত্ব’ অফট্র্যাকে শিশুতোষ অসাধারণ ছবি। শিশুশিল্পী ফাহাদের মায়ের ভূমিকায় ছিলেন। যদিও তাঁর চরিত্রের ব্যাপ্তি খুব বেশি ছিল না তবে মমতাময়ী মায়ের চরিত্রটি অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। সম্প্রতি ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’ ছবিটিও শিশুতোষ ছিল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘খণ্ডগল্প-৭১’ ভালো ছবি। সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গহীন বালুচর’ ছবিটিও চর দখলের রাজনীতিতে একজন নেত্রীর ভূমিকাতে সুবর্ণা অসাধারণ ছিলেন।

‘শোনো শোনো ও প্রিয় প্রিয় গো
শোনো বলি একটি কথা
কত দিন যে গেল কত কথা হলো
তবু ভালোবাসি হয়নি বলা’

রেডিওতে নব্বই দশকের শেষের দিকে ও ২০০০ পরবর্তী কিছু সময়ে ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ অনুষ্ঠানে এ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গানটি আলমগীর-সুবর্ণার ‘রাক্ষস’ ছবির। আলমগীরের সাথে চমৎকার রসায়ন ছিল।

‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে’

হ্যাপি আখন্দের এই কালজয়ী গানটিও সুবর্ণার ‘ঘুড্ডি’ ছবির। আসাদের সাথে ছিল। সমুদ্র সৈকতে হেলেদুলে আধুনিক পরিবেশনায় গানটি অনবদ্য।

‘ছোট্ট একটি কাগজে লিখেছ কি সহজে
তোমার মনের কথাটি সাজিয়ে’

কিংবা,

‘রূপসী বাংলার এক রূপসী মেয়ে
মনেরই চোখ দিয়ে দেখেছি চেয়ে
এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর
তারও চেয়ে সুন্দর সে’

‘ফাঁসি’ ও ‘কমান্ডার’ ছবির দুটি জনপ্রিয় গান। ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে এ ছবিগুলোতেও অসাধারণ সুবর্ণা।

‘আমার বুকের মধ্যেখানে
মন যেখানে হৃদয় যেখানে
সেইখানে তোমাকে আমি
রেখেছি কত না যতনে’

কালজয়ী আরেকটি গান। জাফর ইকবাল-সুবর্ণার অসাধারণ রসায়ন। গানটি দেখতে দেখতে মনে হবে জাফর ইকবালের সাথে সুবর্ণার একটা জুটি দাঁড়াতে পারত।

সুবর্ণা মুস্তাফা আদর্শ অভিনেত্রী। তাঁর মতো অভিনেত্রী হতে চাওয়া অনেকেরই স্বপ্ন। তিনি বাংলা নাটকের যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইমেজ তৈরি করে গেছেন সেই ইমেজটা নিজের মতো করে চলচ্চিত্রেও গড়তে পারতেন কিন্তু সেভাবে করেননি। সেই আক্ষেপটি রয়েই যাবে।
ও হ্যাঁ, নায়িকার চোখ দেখে যারা কালে কালে খুন হয়েছে সুবর্ণা মুস্তাফার চোখও তার মধ্যে আছে।


মন্তব্য করুন