শিস বাজানোর মতো সিনেমা ‘শান’
শান; পরিচালনা: এম রাহিম; অভিনয়: সিয়াম, পূজা, তাসকিন, মিশা সওদাগর, নাদের চৌধুরী, আরমান পারভেজ মুরাদ, অরুণা বিশ্বাস, চম্পা, হাসান ইমাম ও অনেকে
ঝড়বৃষ্টি ছিল, আকাশ পরিষ্কার হতেই দেখে এলাম ‘শান’! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে সিনেমাপাড়ার দুর্দিন ঘোচাতে, সিনেমাহল ব্যবসায় মেঘ সরিয়ে তেমনি আকাশ পরিষ্কার করতে পারবে এই সিনেমা।
রিভিউ লিখি অনেকদিন, তাই দর্শকরা কত স্মার্ট সেটা ভালই জানা আছে। কোন প্রতিযোগিতায় না গিয়ে শুধু বলব, ‘শান’ শতভাগ সিনেমা হলে শিস বাজানোর মতো সিনেমা!
‘শান’ মানে ধার। ধাতব অস্ত্রকে কাজের আগে পাথরে ঘষে শান দিয়ে নিতে হয়। ঈদের সিনেমা ‘শান’ যেন মরা সিনেমাপাড়ার আলোচনায় একটা শান দিয়ে গেছে মুক্তির আগে। করোনার জন্য মুক্তি পিছিয়ে সেটা এবার ঈদ পর্যন্ত টেনে আনায় প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও সিনেমাহল থেকে বের হয়ে একটা শব্দই মনে হয়েছে – ‘শানদার’!
ট্রেলারে গল্প যদি আন্দাজ করতে পারেন তবে আপনি সিনেমার বিশ থেকে ত্রিশভাগ জানেন। আমি নিজেও এমন গল্পের মোড়, এমন ক্লাইম্যাক্স, বিরতির পর এমন ধাক্কা কিংবা একেবারে শেষে ভিলেনকে দেখে এতটা অবাক হবো ভেবে যাইনি। বাজেটের সর্বোত্তম ব্যবহার করে সিনেমার ডিজাইন করা হয়েছে এটা যে কেউ বলবে।
গল্পে আসি অল্প!
সিনেমার নাম ভূমিকায় অবশ্যই সিয়াম যে একজন তরুণ পুলিশ অফিসার। এসি শান নামে ডিপার্টমেন্টে তার বেশ নামডাক এবং তার কারণ অবশ্যই সাহসিকতা। তবে সিয়ামের এন্ট্রির আগে শুরুতে ড্রোন শট আর ফাস্ট কাট ন্যারেশানে দেখানো হয় মানবপাচার হতে যাওয়া দুর্দশাপ্রাপ্ত মানুষের জীবনযাত্রা, সাউথ এশিয়ায় হিউম্যান ট্রাফিকিং আর কালোবাজারে অর্গান ট্রাফিকিং নিয়ে অল্প কথায় বর্ণনা। এটা শুরুতেই সিনেমাতে আপনাকে হুক করে দেবে।
সরকার মানবপাচার রোধে অবসরপ্রাপ্ত সচিব, যে চরিত্রে নাদের চৌধুরীকে দেখা গেছে তাকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই তার জীবনের ওপর হুমকি আসে। একটা সময় তাকে বাঁচাতেই শত্রুদের অস্ত্রের শোডাউনে ঠিক মাঝে বাইক নিয়ে উড়ে আসে শান। সিয়ামের এন্ট্রি দৃশ্যে আমজনতা শিস দিতে বাধ্য। এরপর গল্প এগোয় ‘ভস্কো গ্রুপ’ যারা কি না এই পাচারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, তাদের পেছনে বিভিন্ন এক্টিভিটি দিয়ে।
ওদিকে সঙ্গীতশিল্পী চরিত্রে নায়িকা পূজার সঙ্গেও ঘটনাক্রমে দেয়া হয় শানের। তাকে নিরাপদে পৌছে দিতে গিয়ে পূজার মা অরুণা বিশ্বাস আর তার বাবার বন্ধুর ছেলে তাসকিনের সাথে সিয়ামের পরিচয় ঘটে। একটু একটু করে যখন প্রেমে রোমান্স জড়ো হতে শুরু করে তখনই আবার আমরা দেখি শান ভস্কো গ্রুপের মূল হোতাকে ধরতে কোন না কোন ক্লু নিয়ে কাজ করছে। এই মূল হোতা কে, শান কি তাকে ধরতে পারবে, পারলে সেটা কখন, তা নিজের কোন বিপদ বয়ে আনবে কী না, আনলে সেটাই বা কতটা গভীর এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা বাকি গল্পে এগিয়েছি। শেষটা অবশ্যই চমকপ্রদ আর তা দেখতে হবে হলে গিয়েই।
সিয়ামই ‘শান’ সিনেমার প্রাণ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সিনেমার নামটাও যথাযথ। ‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’, ‘ফাগুন হাওয়ায়’, ‘বিশ্বসুন্দরী’ কিংবা ‘মৃধা বনাম মৃধা’তে মনে গেঁথে যাওয়া সিয়ামকে হলে ঢোকার আগেই ফেলে দিন। কেন না, আমি মনে করি ‘শান’-এ নতুন সিয়ামের জন্ম হয়েছে। এও বলছিলাম পাশের সিটের লোককে, এই সিনেমার পর সিয়াম অ্যাকশন অনেক ছবির অফার পাবেই। পারফরমেন্স, অ্যাকশন, এক্সপ্রেশন, রোমান্স আর ডায়লগ ডেলিভারি সবদিকে সিয়াম বেশ ভালো মার্ক পেয়েই পাশ করবে। এটা ঠিক প্রথম এমন মারকাটারি সিনেমা করতে গিয়ে একশন স্টাইল, পাঞ্চ, হ্যান্ডফাইট একেবারে পারফেক্ট লেগেছে তা না তবে পুলিশ অ্যাকশনে এটি ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও ‘মিশন এক্সট্রিম’ এর শুভর একশনের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকবে।
পূজাকে গানে যতটা সুন্দর ও মোহনিয়া লেগেছে, জুটি হিসেবে সিয়ামের সাথে পর্দায় তেমন মানানসই লেগেছে। তবে ক্যারেক্টারটিকে আরো বিল্ড আপ দিয়ে দর্শকের সাথে অ্যাটাচ করা যেতো, যা হয়নি। তাসকিন, মিশা দুজনেই এই ছবির চমক। এরা কেউ আপনাকে সিনেমার একেবারে না গেলে সুস্থির হতে দেবে না। তাসকিনকে ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর পর এই প্রথম সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হলো। মিশার চরিত্র নিয়ে কিছু না বলি, তবে পারফরমেন্স যথারীতি ভালো। এর বাইরে আরমান পারভেজ মুরাদ ভালো একটা রোল করেছেন। সাপোরটিং কাস্ট হিসাবে অরুণা বা চম্পাকে তেমন স্পেস দেয়া হয়নি মায়েদের চরিত্রে। তবে ভালো করেছেন নাদের চৌধুরী।
এই সিনেমার গান, ক্যামেরার কাজ ও বিজিএম নিয়ে আগে থেকেই কথা হচ্ছিল। সিনেমাহলে না দেখলে এই কথার সত্যিকার ভাইব পাওয়া যাবে না। বলিউড ফাইট ডিরেক্টর ও স্ট্যান্টম্যানরা কাজে কত আলাদা তা না দেখলে বোঝা যাবে না। আর মিউজিকে একটা আনরিলিজড গান আছে যা বেশ ভালো, ‘দয়াল’ খুব একটা ভালো না লাগলেও রোমান্টিক ট্র্যাক ‘চলো পাখি’ কিংবা ‘তোর মতো আমাকে’ খুব সুন্দর ছিল। আর অ্যাকশন লাভারদের শুধু এটুকু বলি, আর কিছু বাদ দিলেও শুধু ক্লাইম্যাক্স যেভাবে ডিজাইন ও এক্সিকিউশন করা হয়েছে তাতে পয়সা উসুল মনে হবেই।
সিনেমাপাড়ায় ঈদের সব ছবি ব্যবসাসফল হওয়াটা যেমন জরুরি তেমনি একটু আলাদা করে তৈরি, নতুনত্ব থাকা ‘শান’ এর মত সিনেমা নিয়ে কথা হওয়াটাও খুব দরকার। পুলিশ অ্যাকশন শুধু না, মৌলিক গল্পের এমন একটা চেষ্টা দর্শক হলে গিয়ে না দেখলে আমরা শুধু পেছাতেই থাকব, এগুবো না।