Select Page

সব্যসাচী আলমগীর

সব্যসাচী আলমগীর

তিনি  নায়ক, গায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক। সব মাধ্যমেই ছড়িয়েছেন দ্যুতি; শুধু অভিনয় দিয়েই নয়, নিজের দৈহিক সৌষ্ঠব, চলন-বলন, ফ্যাশন সচেতনতা, সৌন্দর্য দিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে পেয়েছেন চিরসবুজের খেতাব। চলচ্চিত্রে তিনি একের পর এক দারুণ চরিত্র করে দর্শকনন্দিত হয়েছেন, ‘আগুনের দিন শেষ হবে একদিন’ থেকে ‘তুমি আমার কত চেনা’ কিংবা ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’  গান শুনলেই যে সুদর্শন নায়কের চেহারা ভেসে আসে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ‘আলমগীর’।

বাবা ঢাকার ইতিহাসের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অন্যতম প্রযোজক। তাই ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রজগৎ তার পরিচিতি। ১৯৭৩ সালে নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’তে। প্রথম সিনেমাই মুক্তিযুদ্ধের, সঙ্গে সহশিল্পী কালজয়ী জুটি রাজ্জাক-কবরী। নিজের প্রতিভার আলো প্রথম ছবিতেই বেশ ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার পরবর্তী এক দশক ছিল শুধুই হতাশা আর নিজেকে প্রমাণ করার সময়। সমসাময়িকেরা যেখানে পেয়ে যাচ্ছেন মহাতারকার খেতাব, কিন্তু সেখানে তিনি তখনো দর্শকমহলে এককভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাননি।

১৯৮০ সালে এসে দিলীপ বিশ্বাসের তারকাবহুল ছবি ‘জিঞ্জির’ ও আমজাদ হোসেনের ‘কসাই’ এই ছবি দুটি ক্যারিয়ারে অন্য মাত্রা আনলেও, মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ১৯৮২ সালে সুভাষ দত্তের সুপারহিট ছবি ‘সবুজ সাথী’ ছবি দিয়ে। এরপর আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত ছবি ‘ভাত দে’ করার পর নতুনভাবে আলোচনায় আসেন তিনি।

ওনার ক্যারিয়ারের অন্যতম সিনেমা মালেক আফসারীর ‘ক্ষতিপূরণ’, থ্রিলার ধাঁচের এই ছবিতে একজন পোড় খাওয়া চিত্রশিল্পীর ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে গেঁথে আছেন। এ ছাড়া কাজী হায়াতের ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিতে চিত্র পরিচালকের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় ছবিটিকে করে প্রাণবন্ত। ক্যারিয়ারের আরেক যুগান্তকারী ছবি ‘মরণের পরে’, দুর্ঘটনায় হাত কেড়ে যাওয়ার পর অসুস্থ স্ত্রীর তিলে তিলে চলে যাওয়া দেখেছিলেন, একের পর এক সন্তান পালক দিয়েছিলেন অশ্রুসজলে।  উপরিউক্ত তিনটি সিনেমাতেই তিনি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন। এ ছাড়া মা ও ছেলে, পিতা মাতা সন্তান, মান সম্মান, গীত, অপেক্ষা, সত্য মিথ্যা, ব্যথার দান, দোলনা, ঘরের বউ, গরিবের বউ, সান্ত্বনা, ক্ষমা, শিল্পী, বাংলার বধূ, অন্ধ বিশ্বাসসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ওঠেন শীর্ষ নায়কদের একজন। খল চরিত্রেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন পোকা মাকড়ের ঘর বসতি, রানী কুঠির বাকি ইতিহাস ছবিতে। নারগিস আক্তারের ‘চার সতীনের ঘর’ ছবিতে চারজন নায়িকা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিষ্প্রভ হয়ে যাননি, বরং সমুজ্জ্বল ছিলেন। কয়েক বছর আগেও দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘হেডমাস্টার’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন।

পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি ১৯৮৬ সালের ছবি  ‘নিষ্পাপ’। নির্মাতা হিসেবে প্রথম ছবিতেই সফল, এই ছবিতে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি গায়করূপেও আবির্ভূত হন। এই ছবিটিও ক্যারিয়ার গতিশীল করতে বেশ সাহায্য করে। পরবর্তীতে তিনি বৌমা ও নির্মম পরিচালনা করেন। কলকাতায়ও পরিচালনা করেন তিনি। এ ছাড়া ‘মায়ের দোয়া’সহ বেশ কিছু ছবি প্রযোজনা করেন। নব্বই দশক ও পরবর্তী সময়ে সত্যের মৃত্যু নেই, মায়ের অধিকার, সুখের ঘরে দুঃখের আগুন, মিলন হবে কত দিনে, লাট সাহেবের মেয়ে, আমি সেই মেয়ে, বাপের টাকা, শেষ বংশধর, টাকাসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও পেয়েছেন দারুণ সাফল্য। সে হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় বাবাও  তিনি।

বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা অভিনেত্রী শাবানার ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্যময় হয়েছিল আলমগীরের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন বলেই। জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা রোজিনা সেই সোনালি সময়ের মতো এখনো আলমগীরের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করতে  চান। বহু দর্শক যার গান শুনে বিমুগ্ধ হয়েছিল সেই কিংবদন্তি রুনা লায়লার পর্দার নায়ক থেকে জীবনের নায়ক হয়েছেন এই আলমগীর। চম্পা, দিতির বিপরীতে যেমন অভিনয় করেছেন নায়ক আলমগীর, তেমন তাদের বাবা হয়েও এসেছেন চলচ্চিত্রের পর্দায়। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়েই রাইসুল ইসলাম আসাদ, জাফর ইকবালদের বাবা হয়েছেন। সমসাময়িকদের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে যেনতেনভাবে পার্শ্ব চরিত্র বা অশ্লীল ছবিতে অভিনয় করেননি।

আলমগীর তার বর্ণিল ক্যারিয়ারে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা, সর্বোচ্চ সাতবার সেরা অভিনেতাসহ মোট দশবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন। জুরি বোর্ডের সদস্যও হয়েছেন। তবে বছর কয়েক আগে জুরি বোর্ডের সদস্য থাকাকালীন পুরস্কৃত হওয়ায়  সমালোচিত হয়েছিলেন। অনেক বছর বিরতি দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘একটি সিনেমার গল্প’, তবে এটি দর্শকদের হতাশ করেছে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন