Select Page

সমাজবাস্তবতা: মোল্লা বাড়ীর বউ

সমাজবাস্তবতা: মোল্লা বাড়ীর বউ

 ‘social realism’ বা ‘সমাজবাস্তবতা’ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। সব ভাষার সাহিত্যেই এটা আছে। সাহিত্য ও ছায়াছবির সম্পর্ক গভীর। সাহিত্য থেকে নির্মিত না হলেও একটা ছবিকে সাহিত্যের টার্ম দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে সেই স্বাধীনতা আছে সাহিত্যে।

সালাউদ্দিন লাভলু পরিচালিত ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ ছবিতে সমাজবাস্তবতা দেখানো হয়েছে। পল্লীগ্রামের প্রচলিত সমস্যাকে টাচি করে তুলে ধরেছেন তিনি। পারিবারিক বৈষম্যকে যেমন দেখিয়েছেন তার সাথে সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরে প্রতিবাদের ভাষাও দেখিয়েছেন। লাভলুর মাইলফলক ছবি।

সমাজে ধর্মব্যবসা নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ নামের চরিত্রে যে ধরনের ভণ্ডামি আছে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের উপর তার প্রয়োগ আছে। একবার ভণ্ডামিটা প্রয়োগ করতে পারলেই রাজত্ব করা যায়। ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ ছবিতে ধর্মব্যবসা সে অর্থে না থাকলেও ভণ্ডামিটা আছে। তিনটি প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে লাভলু সমাজবাস্তবতাকে দেখিয়েছেন অসাধারণভাবে।

কাঠমোল্লা চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান তার একক রাজত্বের জন্য পরিবারের বড় পুত্রবধূ মৌসুমীর উপরে অত্যাচার করে। ছেলে রিয়াজকে তার সরলতার সুযোগ নিয়ে নিজের মতো চালায়। এছাড়া এটিএম সামাজিকভাবেও সমস্যা দেখানো চরিত্র। ইসলামী সভা বা অনুষ্ঠানে গিয়ে কম জেনেও বেশি বলে এবং ভুল ব্যাখ্যা করে। মানুষের সম্মান পাবার লোভে সেটা করে।

রিয়াজ সরল চরিত্র। তার সরলতাকে কাজে লাগিয়ে এটিএম নিজের মতো করে তাকে চালায়। রিয়াজের নিজের মতামত বলে কিছু থাকে না। মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিলে যে পরাধীনতা আসে রিয়াজ তুলে ধরে সমস্যাটা তাই তার মুখে থাকে, ‘আব্বা বলছে।’ রিয়াজের চরিত্রটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাকে দেখায় প্রথমত।

মৌসুমীও পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরে। সেও সরল হওয়াতে এটিএম তার রাগের প্রয়োগ করে মৌসুমীর উপর। কারণে-অকারণে মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করে। মৌসুমীও তার মত প্রকাশের অধিকার পায়নি। পায়নি গৃহবধূর প্রকৃত মর্যাদা।

শাবনূর এই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার বিপরীতে থাকা প্রতিবাদী চরিত্র। মোল্লা বাড়ীতে তার কাজ হয় দুটি – মৌসুমী ও রিয়াজের বাস্তবতা চিহ্নিত করা এবং এটিএমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। তার জায়গায় সে সফল হয় এবং মৌসুমী, রিয়াজের পরিবর্তন ঘটে তার মাধ্যমে।

প্রতিবাদের কথা বললে মৌসুমী, শাবনূর, রিয়াজ তিনজনই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এটিএমের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে শাবনূরের ছোট ছোট মজা, বুদ্ধি ও জিনের মাধ্যমে করা প্রতিবাদের ফলে রিয়াজও প্রতিবাদী হয়। শাবনূর তাকে সরল লুঙ্গি, গেন্জি থেকে জিন্স, শার্টে ইন করা স্মার্টনেসে নিয়ে আসে। সেকেলে বিষয় থেকে আধুনিকতায় নিয়ে আসা হয় তাকে। লাভলু এখানেও একটা কাজ করেছে আধুনিক মানসিকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

চূড়ান্ত প্রতিবাদটি মৌসুমী করে এটিএমকে হত্যা করে। হত্যার বিপরীতে ছিল শাবনূরকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য। শাবনূর স্যাক্রিফাইস করে মৌসুমীর জন্য। রিয়াজকে বলে, ‘বুবু চিরকাল তোমার ভালোবাসার কাঙাল তারে বুক ভইরা ভালোবাইসো।’ ভালোবাসার জয় দিয়ে ছবি শেষ করেন লাভলু। পুরো ছবিটি একটা নির্দিষ্ট ‘chain of command’-এর ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে যার কোথাও ফাঁকফোকর নেই।

‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ মোটের উপর পরিবার ও সমাজের সমস্যা তুলে ধরার মাধ্যমে সমাধান বা প্রতিবাদের একটা নজির দেখানো মানবিক আবেদনের অসাধারণ সৃষ্টি। সালাহউদ্দিন লাভলু তাঁর সৃজনশীলতাকে আরো তুলে ধরতে পারতেন এ ধরনের জরুরি বিষয়ের আরো কিছু ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। বলতে গেলে তিনি দর্শককে বঞ্চিতই করেছেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন