Select Page

সিকোয়েন্সে সিকোয়েন্সে সালমান শাহ

সিকোয়েন্সে সিকোয়েন্সে সালমান শাহ

সিকোয়েন্স – ১

মৌসুমীকে গুলি করেছে কবির খাঁ এবং সে মারা গেছে। সালমান শাহ চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মৃত্যু দেখে। তারপর কোমরে গুঁজে রাখা চাকুটা বের করে পেটে ঢুকিয়ে দিতে থাকে। বাবা রাজিব, মা খালেদা আক্তার কল্পনা, বড়বাবা আবুল হায়াত, দাদী সবাই ছুটছে তাঁকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সালমান পেটে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে এবং মৌসুমীর বুকে ঢলে পড়েছে মৃত্যুকে বরণ করে। তার অভিনয় বাস্তবিক তখন।

ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।

সিকোয়েন্স – ২

পাগল সালমান শাহকে মানসিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানে গিয়ে তার সরল পাগলামি, টাই নিয়ে খেলা করা, শিশুর মতো সবকিছু দেখে আনন্দ প্রকাশ করার অভিনয় অন্য লেভেলের। এর কোনো তুলনা নেই, একদম নেই।

ছবির নাম ‘আনন্দ অশ্রু’।

সিকোয়েন্স – ৩

সালমানের ফাঁসির আদেশ হয়েছে খুনের দায়ে। শেষ দেখা করার জন্য মা শাবানা এসেছে। মাকে পেয়ে সালমান শেষ সত্যটি বলে-’মা, যে খুনটির জন্য আমার ফাঁসি হচ্ছে সে খুনটি আমি করিনি।’ মা শাবানা অবাক হয়। কেন সে বলেনি আদালতে তখন সালমান বলে-’আমার মায়ের কথা মিথ্যা হয়ে যাক তা আমি চাইনি।’ সালমানের কান্নাজড়িত অভিনয় তখন যে কাউকে ইমোশনাল করে দেবে।

‘চিঠি এলো জেলখানাতে’ গানের অভিনয় তো আলাদাভাবেই ক্লাসিক হয়ে আছে।

ছবির নাম ‘সত্যের মৃত্যু নেই’।

সিকোয়েন্স – ৪

শাবনূরকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে সালমান। একা একা রান্না করে খায়। মা শর্মিলী আহমেদ চুপ করে দেখতে গেছে ছেলেকে। ছেলের কষ্ট দেখে কাঁদতে থাকে আড়ালে। সালমান বুঝতে পেরে খোঁজে কে কাঁদছে। মাকে দেখে চমকে যায়। মায়ের কাছে দোয়া নেয় যেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। রান্না করা, পেঁয়াজ কাটার অভিনয়ের সাথে সালমান এমনভাবে মিশে গেছে চোখ সরানো যায় না।

ছবির নাম ‘তোমাকে চাই’।

সিকোয়েন্স – ৫

মায়ের হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনতে সালমান বুদ্ধি করে যায় অহংকারী দাদীমা ফেরদৌসী মজুমদারের বাসায়। শাবনাজকে বিয়ের পর পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। মা ববিতাকে যেভাবে তার দাদী সিঁড়ির ওপর থেকে অপমান করে বাড়িছাড়া করেছিল সালমানও সেই একইভাবে শাবনাজকে কৌশলে অপমান করে। শাবনাজ সিঁড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই বলে-’দাঁড়াও, ওখানেই দাঁড়াও। সামনের সিঁড়িগুলো বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা কোরো না।’ কারণ জানতে চাইলে সালমান মনে করিয়ে দেয় পুরনো ঘটনা এবং তার মাকে জাহান মঞ্জিলে তার প্রাপ্য অধিকার না দিলে শাবনাজকেও ঢুকতে দেবে না জানিয়ে দেয়। সালমানের দরাজ কণ্ঠের অভিনয় তখন দুর্দান্ত।

ছবির নাম ‘মায়ের অধিকার’।

সিকোয়েন্স – ৬

শাবনূর রাত জেগে অপেক্ষায় আছে সালমানের জন্য। সালমানের ফিরতে সেদিন দেরি হচ্ছিল। কৈফিয়ত দিতে হবে ভেবে মজা করে কোক খেয়ে মাতালের অভিনয় করে। শাবনূর রেগে যায়। যার জন্য ঘর ছেড়েছে তার এ অবস্থা দেখে বিষের শিশি নিয়ে মুখে ঢেলে দেয় সালমান আটকাতে চেষ্টা করে কিন্তু বিষ ছিল না। মরে যাবার অভিনয় করে শাবনূর। কাঁদতে থাকে সালমান। সামান্য একটি দৃশ্য ছিল কিন্তু দৃশ্যের ভেতর ডুবে গিয়ে সালমান যে অভিনয়টা করেছে তা মনে দাগ কাটে।

ছবির নাম ‘জীবন সংসার’।

সিকোয়েন্স – ৭

* কাজের বিনিময়ে টাকা চাইতে গিয়ে মাস্তান কাবিলাকে শায়েস্তা করে সালমান তারপর বলতে থাকে-’আমি বুইজা গেছি আমার কী করতে হইব।’ শহরে ক্ষমতার জোরের বিষয়টা তার বোঝার বাকি থাকে না। হাসতে থাকে সালমান।

*  সালমান নিজেই মাস্তান হয়ে ওঠে। কানা আজম মাস্তান কাবিলাকে উল্টো চাঁদা দিতে হয় সালমানকে। মাস্তানের লুক যে কী পরিমাণ স্টাইলিশ হতে পারে সালমানের চোখ ধাঁধানো কস্টিউম দেখলে বোঝা যায়। সিগারেট ধরানোর স্টাইলের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হয়।

ছবির নাম ‘বিচার হবে’।

সিকোয়েন্স – ৮

শাবনূর দরজায় কড়া নাড়ছে কিন্তু মা বাধা দিচ্ছে দরজা খুলতে। ভালোবাসার মানুষের কষ্ট ভাগ করে নিতে সালমান চাকু নিয়ে হাতের পাঁচ আঙুলের মাঝখানে এক এক করে চালাতে থাকে। দরজায় শাবনূরের কড়া নাড়ানো আর সালমানের আঙুলের মাঝখানে চাকু চালানো তখন সমার্থক হয়ে ওঠে। একসময় চাকু লেগে রক্ত বের হয়। সালমানের ঐ সময়ের অভিনয় ছিল মাইন্ডব্লোয়িং।

ছবির নাম ‘বুকের ভিতর আগুন’।

সিকোয়েন্স – ৯

শাবনূরের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সালমান মা আনোয়ারাকে বোঝাতে পারছে না। নিজের কষ্ট হাসতে হাসতে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে মাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ক্লান্ত লুকে সালমানের সেই অভিনয় ম্যাজিক্যাল। সালমানের অভিনয়ক্ষমতার একটা উদাহরণও ছিল এ সিকোয়েন্সটি।

ছবির নাম ‘প্রেম পিয়াসী’।

সিকোয়েন্স – ১০

সালমান শাহ বন্ধুদের কাপড় পরে দেখা করতে শাবনূরের সাথে। বন্ধুরা তাকে খোঁচা মারে তোর নেই বলে চুরি করবি? সালমানের উত্তর-’এটা কিন্তু ঠিক নয়, আমার নেই বলে তোদেরটা পরি, বন্ধুই তো আমরা।’ সহজ সরল স্বীকারোক্তি। তার কথা বলার ভঙ্গি এত ন্যাচারাল যে সাদামাটা সংলাপগুলোও অনন্য হয়ে ওঠে। আর সেলসম্যানের কাজ করা সালমানের যখন শাবনূরের সাথে দেখা হয় সালমানের গেটআপের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। একজন সেলসম্যানকে যে কতটা ফ্যাশনেবল দেখানো যায় সালমান তার সেরা উদাহরণ।

ছবি ‘তুমি আমার’।

সিকোয়েন্স – ১১

সালমান গেছে শাবনূরকে পটাতে। বন্ধুদের নিয়ে শাবনূরের বাড়ির পেছনে গাছের নিচে সবাই মিলে গান ধরেছে-’কথায় বলে গাছের ব্যাল পাকিলে তাতে কাকের কী? ওরে কাকের ডাকে যদি একে একে গাছের ব্যাল ঝরিয়া যায়/ তাতে দোষের কী!’ লুঙ্গি কাছা মেরে সালমানের গ্রামের ছেলের যে অভিনয় এটা গোটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেই অন্যতম সেরা অভিনয়। চরিত্রের মধ্যে ডুবে যাওয়াই যেন তার স্বাভাবিক ক্ষমতা। ‘সব সখিরে পার করিতে’ গানের অনবদ্য অভিনয় তো আছেই।

ছবির নাম ‘রঙিন সুজন সখি’।

সিকোয়েন্স – ১২

সালমানের বোনকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছে জহির উদ্দিন পিয়ার। সালমান তাড়া করে পিয়ারকে। পিয়ার তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে লড়ছে সালমানের সাথে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। পিয়ার সালমানকে মারার ফাঁদ পেতে নিজেই ফাঁদে পড়ে। পুরো বৃষ্টির মধ্যে ফাইটিং-এ সালমানের অভিনয় যেন আগুন। বৃষ্টির মধ্যে এরকম ফাইটিং খুব কম হয়েছে আমাদের ছবিতে। ‘একাত্তরের মা জননী’ গানের অভিনয় তো হীরকখণ্ড।

ছবির নাম ‘বিক্ষোভ’।

সিকোয়েন্স – ১৩

রাজিব সালমানের বাবা যে অত্যাচারী শাসক। গরিবের সাথে তার শত্রুতা আর সালমান বাবাকে ত্যাগ করে গরিব প্রজাদের সাথেই থাকে। রাজিব ছেলের সাথে বোঝাপড়া করতে আসে। খোলা মাঠে ঘোড়ায় চড়ে থাকা বাবা রাজিবের সাথে প্রজাদের প্রতিনিধি হয়ে ছেলে সালমান তর্ক করে। কথোপকথন এত ধারালো যে সংলাপ সব বাঁধাই করে রাখা যায় যেন। সালমানের অভিনয় তখন অসাধারণ।

ছবির নাম ‘স্বপ্নের পৃথিবী’।

সিকোয়েন্স – ১৪

সালমানকে জোর করে বিয়েতে বাধ্য করা হয় বৃষ্টির সাথে। বৃষ্টির বাবা খলিল এটা করে। নতুন বউ বৃষ্টি কিছুই খায় না বাড়িতে। অন্যের রোজগারে সে খাবে না, খাবে স্বামীর রোজগারে। সালমান শাহ বাইরে কাজ করতে বের হয়। রড পিটিয়ে কাজ করে টাকা উপার্জন করে ঘরে ফেরে বৃষ্টির জন্য খাবার আর বাড়ির বড়দের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে। সবাইকে দেয়ার পর খাবারটা বৃষ্টির সামনে রেখে বলে-’শুনেছি কুকুর বেড়ালকেও কেউ না খাইয়ে রাখে না, এখানে রইল ইচ্ছে হলে যেন খেয়ে নেয়।’ আত্মমর্যাদাবোধ জন্ম নেয়া একজন পুরুষ যে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কথায় পাল্টে যায় সেই পুরুষের অভিনয়ে সালমান শাহ অনবদ্য।

ছবির নাম ‘এই ঘর এই সংসার’।

সিকোয়েন্স – ১৫

চায়ের দোকানে শাবনূরকে দেখে ভালোবেসে ফেলে সালমান। তারপর তার ছবি আঁকতে থাকে। ছবির আঁকার ফাঁকে সালমানের এক্সপ্রেশনগুলো শুধু খেয়াল করতে হয়, এ যেন এক্সপ্রেশনের জাদুকরী খেলা। তারপর বাজতে থাকে গাড়ি ড্রাইভ করা সালমানের ব্যাাকগ্রাউন্ডে ডিফারেনটাচ ব্যান্ডের কালজয়ী গান ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে।’

ছবির নাম ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’।

সিকোয়েন্স – ১৬

বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে নাতি সালমান শাহ। আনোয়ারা তার দাদী। তার ড্রেসআপ আর স্টাইলের দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। গাছের মধ্যে ক্যামেরা ফিট করে একা ছবি তোলে টেকনিক করে। সালমানের স্টাইলিশ পোশাক, গ্রামের প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

ছবির নাম ‘অন্তরে অন্তরে’।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন