সিনেমার পপকর্ন জোয়ার, শুধু পয়সাওয়ালাদের মনোরঞ্জন হবে না তো
করোনার বিপর্যয়ের আগের দর্শক খরা পরবর্তীতেও ভয় ধরিয়ে রেখেছিল। অনেকেই সিনেমা মুক্তির তারিখ নিয়ে চিন্তিত ছিল। সেই ভয়াবহ সময়েই কোন এক দৈবিক ভরসায় যেন মুক্তি পেল ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’। হলগুলো নড়েচড়ে বসে। যদিও ‘মিশন এক্সট্রিম’ হালকা একটা নাড়া দিয়েছিল গেল বছরের শেষে। তবে মূলধারার দর্শকদের একটা বড় অংশকে টেনে আনে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’। তারপর তো ব্যাক টু ব্যাক রান হতে থাকলো সিনেমার খেলায়।
‘গলুই’ এবং ‘শান’-এর একটা ছোটখাটো ঝলকের পর এবার তো সোনায় সোহাগা হয়ে ঝড় তুলে দিলো ‘পরাণ’ এবং ‘দিন দ্য ডে’। সেই ঝড় থামার আগেই ‘হাওয়া’ যেন ঘূর্ণিঝড় হয়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশি সিনেমা বহু বছর এমন টানটান সময় দেখেনি। যদিও দিন শেষে ত্রয়ী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বদৌলতে প্রযোজক কত টাকা ফেরত পাবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তবে এটা বলা যেতে পারে যে, দর্শক সিনেমাগুলো দেখছে। দর্শকের ভিড় ছিল আকর্ষণীয়।
এখানে কিন্তু একটা দূর্দান্ত ঘটনা ঘটে গেছে। আর তা হচ্ছে উপরে উল্লেখিত প্রতিটি সিনেমা একটি থেকে আরেকটি একদমই আলাদা। এই যে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের সিনেমা এবং তার দর্শক কখনো আলাদা, কখনো কমন হয়েই হলে আসছে এটা অনেক বড় ব্যপার। সিনেমার বিচিত্রকে দর্শক যে গ্রহণ করছে এর পুরো ক্রেডিট আসলে সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবার পাশাপাশি দর্শকেরও।
খরচের খাতা শেষ হবার কারণে এবার কিন্তু অপেক্ষার পালা শুরু নতুন সিনেমার। ইতিমধ্যে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ট্রেইলার ছেড়েছে। অবশ্যই বড় ধামাকা দেয়ার সম্ভাবনা রাখছে। অন্যদিকে মূলধারার দর্শকদের হলে আনার দায়িত্ব পড়বে ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ এবং ‘যাও পাখি বলো তারে’র উপর।
এছাড়াও পাইপ লাইনে আছে ক্যাসিনো, দামাল, বিউটি সার্কাসসহ একঝাঁক সিনেমা। নায়কের সহযোগিতা পেলে ‘লিডার, আমিই বাংলাদেশ’ সিনেমাটিও ঝড় তোলার কথা।
এখন দেখার বিষয়, সিনেমার যে হাইপটা ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’ থেকে ‘হাওয়া’তে এসে চলছে, তা কতদিন চলবে!
কারণ এবার বাংলা সিনেমার মূলধারার দর্শকদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতে (সম্ভবত জাজের) যে প্রজেক্টর তা আরো ৫ বছর আগেই বদলে ফেলা উচিত ছিল। সিঙ্গেল স্ক্রিনের হলে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা এবং টয়লেটের পরিবেশ ঠিক করা জরুরি। ১৫০-২৫০ টাকার বড়লোকের সিনে/মাল্টিপ্লেক্সে আমাদের গার্মেন্টস কর্মী, রিক্সাওয়ালা, নিম্ন মধ্যবিত্ত এমন কি মধ্যবিত্তরা যাওয়ার বা নিয়মিত যাওয়ার ক্ষমতা রাখে না। অথচ সিনেমাকে সবচেয়ে বেশি ফেরত দিয়েছে এই শ্রেণী।
সারাদেশে সিনেপ্লেক্স হতেই পারে। কিন্তু আমাদের মূলধারার দর্শকদের অর্থনৈতিক অক্ষমতাকে অবজ্ঞা যেন করা না হয়। যতদিন এই দর্শককে হলে ফেরত আনা না যাবে, যতদিন এই দর্শকদের একটু আরামে বাতাসের নিচে বসে পরিস্কার স্ক্রিনে, পরিস্কার সাউন্ডে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করা না হবে, ততদিন এই দেশের সিনেমার ভাগ্য কিছুটা বদলালেও সেটা হবে অনেক বড় বৈষম্য।
সিনেপ্লেক্সের কল্যাণে প্রযোজক একসাথে বেশি টাকা পেলেও, এটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি আনন্দের যে বেশি দর্শকের কাছ থেকে কম কম করেও অনেক বেশি আয় করা। তাই সবাই মিলে সিনেমার বিনোদন নিতে, সিনেমার ব্যবসাকে প্রসার করতে সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোকে দর্শক উপযোগী করাটা সময়ের দাবী। যদিও মূলধারার দর্শকদের কথা ভাবাটা কারো কারো কাছে ছোটলোকি মনে হতেও পারে। সে হিসেবে আমি ছোটলোক। যত দর্শক একসাথে সিনেমা দেখবে, টিকিটের দাম তত কমবে। তাই সুস্থ পরিবেশের সিনে/মাল্টিপ্লেক্সের চেয়ে সিঙ্গেল স্ক্রিন অনেক বেশি জরুরি।
বি.দ্র.: পুরো লেখায় কারো নাম উল্লেখ করিনি সচেতনভাবে। তবে একটা নাম এখন উল্লেখ করে বলতে চাই। আমার মনে হয় এবার প্রযোজকদের নির্মাতা ‘শিহাব শাহীন’কে সিনেমার জন্য ডাকা উচিত। না কোন থ্রিলার, পুলিশ ক্রাইম সিনেমার জন্য নয়। সেসব পপকর্ণ বানাবার আরো লোক আছে। শিহাব শাহীনকে দিয়ে পিউর রোমান্টিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের সিনেমা নির্মাণ করানোটা খুব প্রয়োজন বলে মনে করছি। বুক ধুকধুক প্রেম, আনন্দের কান্নায় গলা ব্যাথা করা অভিজ্ঞতা দেয়া বেসিক প্রেমের সিনেমা। অনেকদিন এই জনরার ভাল সিনেমা পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই শুধু পপকর্ণ বানাতে ব্যস্ত।