Select Page

প্রথম সিনেমা দেখার মধুর স্মৃতি ‘মা ও ছেলে’

প্রথম সিনেমা দেখার মধুর স্মৃতি ‘মা ও ছেলে’

আমি অপেক্ষায় ছিলাম ‘মা ও ছেলে’র, যথা সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে কামাল আহমেদ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেল …

১৯৮৫ সাল। আমার বয়স তখন দশ-বারো, আমার ভাই নতুন বিয়ে করেছে। ভাবী সিনেমা পাগল তরুণী। বিয়ের আগে বান্ধবীদের সাথে যে সব সিনেমা দেখেছে, সেই সব গল্প বলতো। চোর, সবুজ সাথী, ঘরের বউ, ধন দৌলত, অংশিদার, জিঞ্জির, ঘর সংসার, বৌরাণী, প্রতিহিংসা, মায়ের দাবী, সাম্পানওয়ালা, সানাই, অলংকারসহ অনেক ছবির গল্প করতো ভাবি আমার কাছে।

ভাবীর খুব প্রিয় নায়িকা ছিল শাবানা। আর প্রিয় জুটি আলমগীর-শাবানা।

ভাবী ছিল চট্টগ্রামের; তাই ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিটি বেশি প্রিয় ছিল। কর্ণফুলী নদী তীরের আকবর মাঝি আর হাসিনা বানুর প্রেম কাহিনী নিয়ে নির্মিত ‘সাম্পানওয়ালা’।

ভাবীর বাড়ি ছিল মধ্যম হালিশহর নিশিন্তাপাড়া। কাছাকাছি ছিল নেভাল অডিটোরিয়াম (নিউ মুরিং) ও সাগরিকা সিনেমা। বান্ধবীদের নিয়ে এই দুই হলে ছবি দেখতো বেশি, দুটি হল ছিল নারীদের জন্য আদর্শ। কারণ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় টিকিটের দাম অন্য হলের চেয়ে অর্ধেক। কালোবাজারি ছিল না। কোনোপ্রকার বখাটেপনা ছিল না। নৌবাহিনীর পরিবাররা এই সব হলে সিনেমা দেখতো।

এইসব সিনেমা হল ছিল নারী ও শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। তাই আশপাশের কিশোরী-তরুণীরা এখানে সিনেমা দেখতে আসতো, ভাবীও দেখতো।

বিয়ের পর ভাবী ভাইয়ের সাথেই সিনেমা দেখতো। তবে বনানী কমপ্লেক্স, সানাইতে।

আমি ভাবীর কাছে আবদার করলাম আমাকে একবার সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করে দিতে, মানে তিনি যখন ভাইয়ের সাথে সিনেমা দেখতে যাবে তখন যেন আমাকেও সাথে নিয়ে যান।

ভাবি বললো, ঠিক আছে। সামনের সাপ্তাহে শাবানা-আলমগীরের ‘মা ও ছেলে’ মুক্তি পাবে (ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে)। তোমার ভাইকে বলবো তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে।

ভাবীর কাছে আশ্বাস পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা! রীতিমত ভাবীর চামচা হয়ে গেলাম। তার সবকিছুতে আমার ‘হ্যাঁ’ থাকতো। যেমন; ভাবীর সালোয়ার-কামিজ পরা পছন্দ করতো না ভাই। তার এককথা বিবাহিত নারীদের শাড়িই আসল।

ভাবী বাপের বাড়ি গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরতো। তেমন একদিন আমি ভাইয়ের সাথে গেলাম। ভাবী তাড়াতাড়ি সালোয়ার-কামিজ খুলে শাড়ি পরলো।

শাড়ি পরে এসে বললো, ‘আকবর বলতো সালোয়ার-কামিজ পরলে আমাকে কেমন লাগে?’, ‘শাবানার মতো লাগে’, ‘দেখো আকবর বোঝে কিন্তু তুমি বোঝো নাহ!’

ভাই আমার কান মলতে মলতে বললো, ‘ভাবীর চামচা তুই জীবনে শাবানাকে দেখেছিস…!’

আমাদের ঘরে ন্যাশনাল ৫৪৩ নামে পুরাতন একটি টুপিস ছিলো। টুপিস মানে, রেডিও ও ক্যাসেট প্লেয়ার। দুপুর সোয়া বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত রেডিও বাংলাদেশ চট্টগ্রাম (তখন বাংলাদেশ বেতার বলা হতো না) থেকে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ প্রচার হতো।

বিজ্ঞাপন তরঙ্গের মাধ্যমে ‘মা ও ছেলে’ ছবির বিজ্ঞাপন শুনতাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে আগস্ট মাস ছিল। তালপাকা গরমে দুপুরবেলা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনতাম।

আমি অপেক্ষায় ছিলাম ‘মা ও ছেলে’র, যথা সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে কামাল আহমেদ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেল। চট্টগ্রামের বনানী কমপ্লেক্স, জলসা, উজালা, রঙ্গম সিনেমায় মুক্তি পেল। যেদিন থেকে মুক্তি পেল, সেদিন থেকে ভাবীকে তাগাদা দিলাম। বলবে বলবে ভাইয়াকে বলছিল না ভাবী।

অবশেষে আমি কান্নাকাটি শুরু করলাম। এ দেখে অবশেষে ভাইকে বললো। ভাই রাজি হলো তবে শর্ত দিল, ‘মা ও ছেলে’ দেখার পর আর কোনো সিনেমা দেখার আবদার করতে পারবো না। যখন বড় হবো তখন দেখতে মানা নেই। আমি শর্ত মেনে নিলাম।

কিন্তু আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করে করে প্রথম সাপ্তাহ পার হয়ে গেলো। ‘মা ও ছেলে’ দ্বিতীয় সপ্তাহ চলতে থাকল। রেডিও বিজ্ঞাপনে প্রচার হতে থাকে, দর্শকদের অনুরোধে সগৌরবে দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে।

দ্বিতীয় সপ্তাহের তৃতীয়দিন দুপুরবেলা ভাইকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম ‘মা ও ছেলে’ কখন দেখাবে?, “তুই ‘মা ও ছেলে’ দেখতে চাস?”, তিনি মায়ের পায়ে বসে বললেন, “দেখ আমাদের, তাহলে ‘মা ও ছেলে’ দেখা হয়ে যাবে।”

ভাবী ও মা হাসতে থাকে, সিনেমা না দেখার দুঃখে আমার কান্না পাচ্ছিল।

অবশেষে ভাই আমাদের ‘মা ও ছেলে’ দেখাতে নিয়ে গেলো। বিকেল তিনটার শো দেখতে নিয়ে গেলো জলসা সিনেমায়।

জুবলী রোডের এ হল ছিল বিলাসবহুল। পুরুষের চেয়ে নারী দর্শক বেশি। ভাই আমাদের নারীদের বিশ্রামাগারে রেখে গেলো। ভেতরে বসার জায়গা নাই, নারী দর্শকদের ভিড়ে অন্যরকম অবস্থা। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে এরা সবাই শাবানার কারণে এসেছে। সবাই শাবানাকে নিয়ে গল্প করছে। ভাবীও তাদের সাথে মিশে গেল।

নারীদের প্রসাধনীর সুবাসে আমার সর্দি এসে গেল, জন্মের পর থেকে প্রসাধনীর সুবাসে আমার এলার্জি। তাই ভাবী বলতো, তোমার জন্য এমন পাত্রী দেখতে হবে, যে স্লো, পাউডার, লিপস্টিক ব্যবহার করে না। তোমার জীবনে যদি সাজগোজ প্রিয় মেয়ে বউ হয়ে আসে তাহলে তুমিও সুখী হবে না আর ও বেচারিও সুখী হবে না।

আমি ভাবীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘সিনেমা দেখতে এতো মহিলা কেন এসেছে?’, ‘শাবানার ছবি মেয়েরা বেশি দেখে।’

আমি শুনতে থাকলাম; এক মহিলা আরেক মহিলাকে বলছে, শাবানার দুঃখ আছে নাকি? তাদের হাবভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে, সবাই শাবানার দুঃখ কামনা করছে।

ভাবীকে প্রশ্ন করি, ‘ভাবী সবাই শাবানা কষ্টে থাকুক, দুঃখে থাকুক চায় কেন?’, ‘‌তারা বাস্তবে নয়, সিনেমায় চায়। … আমিও চাই ছবিতে শাবানার দুঃখ কষ্ট থাক।’, খুব অবাক হয়ে বললাম, ‌‘কেন শুধু শাবানা কেন? অঞ্জুও নয় কেন?’, ‘সবাইকে সবকিছু মানায় না। শাবানাকে মানায়।’

সোয়া তিনটায় সিনেমা শুরু হলো, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। বিরতির সময় আমি বাহির হতে আসন থেকে উঠছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, সিনেমা শেষ। ভাবী বললো, সিনেমা আরো বাকি আছে।

ভাই আমাদের জন্য পেপসি আনতে গেলো, ভাবীর খুব পছন্দ পেপসি। ভাবী বললো, ‌‘শাবানাকে কেমন লাগলো?’, ‌‘খুব সুন্দর!’, ‘বড় হলে তোমাকে শাবানার মতো মেয়ে বিয়ে করাবো।’, ‘আমি অঞ্জুর মতো মেয়ে বিয়ে করবো।’

ভিউকার্ডের বদৌলতে অঞ্জুকে চিনতাম। কিন্তু ভাবী কেন জানি অঞ্জুকে পছন্দ করতো না। আমাদের বাসার উত্তরের জানালা দিয়ে বানিয়াটিলায় অবস্থিত উজালা সিনেমার বিলবোর্ড দেখা যেত। অঞ্জু অভিনীত ছবির বিলবোর্ড দেখে ভাবী বলতো, ‘ছি ছি কী বে-শরম মাইয়াপোয়া! লাজশরম একটুও নাই। কেমনভাবে পোস্টারে ছবি দিছে? আঁরার চাঁটগাইয়া মাইয়াফোয়া বিউটিকুইন শাবানারে কেউ কোনোদিন এইসব পোজে দেখেছে। দেখাতে পারলে জিভ কাটিয়েরে কুত্তোরে হায়ামু।’

ভাই বলতো, ‘আরে এইসব তো আর্ট! অঞ্জুকে কি ছবিতে এমন বাজে অবস্থায় দেখায়?’, ‌“রাখ, তোমার এইসব কথা। ‘সওদাগরে’ কেমন ছিল দেখছি তো! ও এসে আমাদের সিনেমা জগতটাই বারোটা বাজাইছে।” এইসব নিয়ে ভাই-ভাবীর মিষ্টি ঝগড়া লেগেই থাকতো।

যদিও আমি তখনো সিনেমা দেখা শুরু করিনি, কিন্তু অঞ্জুর প্রতি টান ছিল। ভাবী আমাকে ক্ষ্যাপাতে অঞ্জুর খুঁত খুঁজে বাহির করতো।

সিনেমা আবার শুরু হলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। সিনেমা শেষ হলো, কিন্তু আমি বসে রইলাম। মনে করেছিলাম, সিনেমা তখনো বাকি আরো দেখাবে। ভাবি বললো, ‘চলো, সিনেমা শেষ।’ মন খারাপ করে বের হয়ে এলাম।

ছবির কাহিনী আমাকে মুগ্ধ করেছিল। চৌধুরী বাড়ির বুলবুলের সাথে খান বাড়ির রেহানার বিয়ে হয়। বাসররাতে স্ত্রীর সান্নিধ্যে যাওয়ার আগেই বুলবুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তারী পরীক্ষা করার পর জানা যায় বুলবুলের ব্লাডক্যান্সার।

শাশুড়ি মায়া হাজারিকা রেহানাকে উঠতে-বসতে অপয়া বলতো। কিছুদিন পর বুলবুল মারা যায়। তখন শাশুড়ি রেহানাকে দিয়ে ঝি-চাকরের মতো কাজ করাতো এবং তাদের ঘরে রাখতো। বাবা রেহানাকে নিয়ে যেতে চাইলে সে স্বামীর ঘর ছেড়ে যেতে চায় না। তখন বাবা রেহানার সাথে রাগ করে চলে যায়।

রেহানা যখন অন্তঃসত্ত্বা হয় তখন শাশুড়ি ও ভাসুর খলিল ষড়যন্ত্র করে চরিত্রহীনা বানিয়ে চৌধুরী মঞ্জিল থেকে বাহির করে দেয়। রেহানা স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এক দয়াবান ব্যক্তির আশ্রয়ে সন্তান প্রসব করে। সেই আশ্রয়ে থেকে সেলাই কাজ করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে।

আলমগীর হলো রেহানার ছেলে। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিল্ডার্সের ব্যবসা করে। আলমগীরের জীবনের একটাই লক্ষ্য চাচা খলিল থেকে মায়ের অপমানের-লাঞ্ছনার বদলা নেয়া। তাই খলিলকে ধীরে ধীরে পথের ফকির করে।

আলমগীরের শাবানার প্রেম। আলমগীর পরিচয় না জানলেও শাবানা জানে আলমগীর তার চাচাত ভাই। যখন জানে তখন আলমগীর প্রেমিকার চেয়ে মায়ের অশ্রুকে গুরুত্ব দেয়। কাহিনী আর মনে করতে পারছি না। পঁয়ত্রিশ বছর আগে দেখেছি।

সন্তান যখন দুদিনের পরিচিত প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য মা-বাবা ভুলে যায়, তখন ‘মা ও ছেলে’ ছবির আলমগীর সুন্দরী প্রেমিকা শাবানাকে ভুলে যেতে চায়। কারণ শাবানার বাবা খলিল মা রেহানার কষ্টের কারণ। ছেলে আলমগীরের এই আদর্শিক চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করে।

ছবি দেখে ভাবীর মন খারাপ হয়ে গেলো। কারণ ভাবীর নাম মমতাজ আর রেহানার নাম ছিলো মমতা। রেহানা পিতৃহীন সন্তান অনেক কষ্ট করে লালনপালন করে। ভাবী তখন অন্তঃসত্ত্বা তাই মনমরা। ভাবীর ধারণা নামের কারণে তার সন্তান পিতৃহীন হয়ে যাবে। সিনেমা দেখে এমন আবেগাপ্লুত হতে দেখা প্রথম নারী আমার ভাবী।

প্রথম কিছুর স্মৃতি সহজে ভোলা যায় না, সেটা প্রেম হোক আর অন্যকিছু হোক। প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতি আমার কাছে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো।

এই ছবিতে অভিনয় করে আলমগীর প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পায়!


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন