Select Page

সুলতানা বিবিয়ানা : গল্পকার, নির্মাতা ও দর্শকের সিনেমা

সুলতানা বিবিয়ানা : গল্পকার, নির্মাতা ও দর্শকের সিনেমা

সিনেমা মুক্তির পর দর্শকের সম্পদ হয়ে যায়। দর্শক নিজের মতো দেখে, কথা বলে। তার আগে সিনেমা অনেকের থাকে। প্রত্যেকটি সিনেমার জন্যই এটা সত্য। ‘সুলতানা বিবিয়ানা‘ সিনেমা মোটাদাগে তিনটি ক্ষেত্র রেখে আলোচনায় এসেছে। গল্পকার, নির্মাতা ও দর্শক তিনটি পর্যায় থেকে সিনেমাটি এ বছরের প্রথম গঠনমূলক আলোচনা আনতে সক্ষম হয়েছে।

গল্পকার ফারুক হোসেন কক্সবাজারে সমুদ্রে গোসল করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ‘সুলতানা বিবিয়ানা‘-র গল্পটি তাঁর লেখা। তাঁকে নিয়ে দর্শক ও বিজ্ঞরা কথা বলেছেন। তাঁর মেধার প্রশংসা করেছেন। তিনি থাকলে আমরা আরো ভালো গল্প পেতাম যেগুলো থেকে সময়োপযোগী সিনেমা নির্মিত হত। ফারুক হোসেন নাটকের গল্প যখন লিখতেন সেটা ছিল আলাদা তার সাথে সিনেমার গল্পকে তিনি ভিন্নভাবে বলতে পেরেছেন। সেই গল্পটাকে নির্মাতা হিমেল আশরাফ তার নির্মাণের মাধ্যমে ভালো কাজ হিশাবে দর্শককে উপহার দিয়েছেন। হিমেল আশরাফ-ও নাটক নির্মাণ করতেন তার ‘মা, বিকেলবেলার গল্প’ এ নাটকগুলো দেখলে রুচিসম্মত দিকটি ফুটে ওঠে। নাটক ও সিনেমার ভাষাটা তিনি জানতেন যার প্রমাণ ‘সুলতানা বিবিয়ানা।’ দর্শক সিনেমাটি দেখে তাদের মতো কথা বলছে, প্রশংসা করছে, সমালোচনা করছে, ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে। এগুলো সবই দরকারি গঠনমূলকভাবে। ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে যার ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। তিন ক্ষেত্রে সিনেমাটি এ বছরের প্রথম সফল আলোচনা তৈরি করেছে।

প্রেম নিয়ে ঢালিউডে সিনেমা সবচেয়ে বেশি নির্মিত হচ্ছে এখন। প্রেমের বাইরে দু’একটি সিনেমা হলেও সেগুলো লাইমলাইটে আসছে না। গল্পের অভাব প্রচণ্ডভাবে জেঁকে বসেছে ইন্ডাস্ট্রিতে। গল্পের অভাবেই দুর্বল সিনেমা বেশি হচ্ছে।যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে একটা মন্দের ভালো ঘটনা চলছে কিন্তু গল্পের মৌলিকত্ব সেখানে নেই আছে মিশ্র গল্পের ঝনঝনানি। সেই শূন্যতা থেকে শহুরে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে অনেকদিন বাদে গ্রামগণ্জের সিনেমা নির্মাণে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন হিমেল আশরাফ। ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ তার গ্রামীণ প্রকৃতি ও জীবন থেকে উঠে আসা প্রেমের কাহিনী। এ গল্পে প্রেম আছে, আছে বেদনা, সামাজিক বাধা, বিসর্জন। সব মিলিয়ে আমাদের পরিচিত জীবনের সিনেমা।

ওপেনটি বাইস্কোপ
নাইন টেন তেইশ কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংএর চাবি আঁটা
যার নাম মনিমালা
তাকে দেবো মুক্তার মালা।

ছোটবেলায় এ ছড়াটা গানের তালে তালে আমরা শুনে এসেছি। এর ভেতরে একটা গল্প থাকে যাকে ফোক কালচার থেকে উঠে আসা প্রেম, পরিবার, সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে চেনা যায়। সিনেমার নামটি রুচিসম্মত এখানেই কারণ সেটা আমাদের জীবন থেকে নেয়া সাংস্কৃতিক উপাদান। সে প্রেমের কথক প্রথমত সুলতান যার জীবনে একটা গল্প আছে। সে তার নিজের গল্পটা বলে জীবননদীর স্রোতে নৌকা ভেড়ানো ঘাটের মাধ্যমে। তাই তার মুখে শোনা যায় স্বীকারোক্তি-‘আমার ঘাটের নাম কি জানো? আমার ঘাটের নাম সোনালি।’ সোনালি সেই মেয়েটি যাকে ঘিরে দর্শক গল্পতে প্রবেশ করে সুলতানের ভালোবাসার বিবিয়ানা-য়। সোনালি মেয়েটি চোখে চোখে কথা বলেছিল তার সাথে। কিছু খুনসুটি আর ভুল বুঝাবুঝির পরে যখন সুলতান জেল খাটে সোনালি বুঝতে পারে তার জীবনের শেষ ঠিকানা ঐ সুলতান-ই। জেল থেকে ছাড়াতে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কারণ সে জানত প্রেম তার জীবনে এসে গেছে। সুলতানকে বলে-‘আমার জন্য আপনি জেল খাটছেন।’ সুলতানের অনুভূতি-‘যদি জানতাম তুমি ছাড়াতে আসবা তাহলে শতবার জেল খাটতে রাজি।’ বিবিয়ানা সোনালি জড়িয়ে ধরে সুলতানকে। তখন আকাশ আর দেরি করে না ভালোবাসার বৃষ্টি নামাতে। ভালোবাসার পথে চিরকালই বাধা ছিল। সামাজিক বাধাই প্রধান। সুলতান আর সোনালির প্রেমের ফাটল ধরাতে বিবিয়ানার বাবাই বাদ সাঁধে। তারপর দূরত্ব। পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরলে সোনালি রেগে বলে সুলতানকে-‘আমি কিন্তু বাড়ি গিয়া আমার হাত কাইট্টা ফালামু।’ সোনালির বাবা তার কৃতকর্মের সাজা পায় কিন্তু ফাঁসিয়ে দিয়ে যায় সুলতানকে। সুলতানকে রক্ষা করতে থাকা আফাজ তারই শত্রু হয় ভেতরের কামবাসনার জন্য। একসময় নিজের ভুলটা বুঝতে পারে আফাজ। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। সুলতান আর সোনালি দুজনই কি বিসর্জন দেয় নিজেদের? সেটা না হয় উহ্যই থাক তবে ট্রাজেডি তো ঘটেই। সাহিত্যে বলে নায়ক মরে গেলে ট্রাজেডি হয় কিন্তু নায়িকা মরে গেলে কি হয় না বা দুজনই মরে গেলে তখন কি হয় না? উত্তরগুলো ছবিঘরে নেয়াই ভালো।

সুলতানা বিবিয়ানা‘ অভিনয়ের সিনেমা। যার কাছে অভিনয়টা সেভাবে আশা করতে গিয়ে হোঁচট খায় দর্শক তাকে দিয়েও অভিনয়টা আদায় করে নিয়েছে নির্মাতা। বাপ্পির কথাই বলছি। বাপ্পি সুলতান এ সিনেমার। হরহামেশা অ্যাকশন সিনেমাতে ব্যবহার হয় ‘সুলতান’ নামটি। কিন্তু হিমেল আশরাফ আনলেন প্রেমে। এ সুলতান খুব সরল, সোজা ছেলে যার শখ ছিল ফুল চাষ করা। ফুলের বাগানে কাজ শিখতে গিয়েই গোড়ায় গণ্ডগোলটা হয়। ভালো লাগে ষোড়শী সোনালি আঁচলকে। ‘সোনালি’ শব্দটি গ্রামীণ সংস্কৃতি বা প্রকৃতিকে তুলে ধরে। যেমন কবিরা বলেন ‘সোনালি সোনালি চিল’ এভাবে। বাপ্পি তার সহজাত শিশুসুলভ ইমেজ থেকে বেরিয়ে নির্মাতার মনমতো অভিনয় করার চেষ্টা করেছে। বেড়ার ফাঁক থেকে দেয়া ক্লোজ শটের এক্সপ্রেশন বা মামুনুর রশীদ, শহীদুজ্জামান সেলিম-দের সাথে ফেস টু ফেস অভিনয় করাটা তার জন্য কঠিন ছিল। অন্তত সে দিকে সে কিছুটা হলেও এগিয়ে গেল এ সিনেমায়। আঁচলের চরিত্রে বৈচিত্র্য আছে। বাপ্পির থেকে দ্বিগুণ সেটা। আঁচল গ্রামের চিরায়ত সাজতে ভালোবাসা মেয়ে, সে প্রেমে পড়া আবেগী মেয়ে, সে বাবার জন্য প্রেমকে বলি দেয়া মেয়ে, ভুল কেটে গেলে আবার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করা মেয়ে, নিজের সৌন্দর্যের জন্য কাছের বিশ্বাসী লোকের কাছে সে ভোগের বস্তু, নিজেকে উজাড় করে প্রেমকে অমর করা মেয়ে। এতগুলো সত্তা থেকে অভিনয়টা এত সোজা না অথচ সবগুলোকে ভেতর থেকে ধারণ করে নিজের সহজাত অভিনয়টা করেছে। তার অভিনয়ের জায়গাটিকে দর্শক, সমালোচক, প্রতিষ্ঠিত নির্মাতাসহ সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। মামুনুর রশীদ ও শহীদুজ্জামান সেলিম সিনেমার প্রভাবক চরিত্র। মামুনুর রশীদ মেয়ের প্রেমের পথে বাধা হয় এবং শেষ পর্যন্ত জটিলতা তৈরি করে। বাপ্পির পাল্টে যাওয়ার প্রভাবক ছিল প্রথমত মামুনুর রশীদ এবং অমিত হাসান। শহীদুজ্জামান সেলিম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা ভালো সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র। একই সাথে আঁচলের, বাপ্পির দুজনের জীবনেই জটিলতা তৈরি করে। প্রথমদিকে দুজনকেই আগলে রেখেছে, মাঝখানে নিজের কু-প্রবৃত্তির জন্য দুজনের মাঝখানে দেয়াল ছিল নিজেই আবার শেষে অপরাধ স্বীকার করে নিজেকে শুদ্ধ করে। তিন তিনটি বৈচিত্র্যে সিনেমার গল্পে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে সেলিম। অমিত হাসানকে নিয়ে সমালোচনা বেশ হয়েছে তবে এটুকু বলতেই হয় তার অন্যান্য বাণিজ্যিক সিনেমার অহেতুক লাউড ভয়েসের আধিক্য এ সিনেমাতে ছিল না। ‘বিউটিফুল’ শব্দটি বারবার এসেছে বাণিজ্যিক সিনেমায় খলনায়কের একক ভাষার ডিমান্ডেই।

সিনেমার শিক্ষণীয় দিক আছে প্রেমের মধ্যেও। মনের মানুষকে বুঝতে না পারলে বা ভুল বুঝলে, সত্য-মিথ্যা যাচাই না করলে সে মানুষটি পাল্টে যেতে পারে। ভালো থেকে খারাপ মানুষ হতে পারে। বাপ্পি সেটা করেছে। অমিত হাসানের সাথে ডাকাতিতে বেরিয়েছে নিজের মধ্যে থাকা সরল মানুষটিকে খুন করে। তাই অপারেশন শেষে গাছের ডালে বসে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে। শহীদুজ্জামান সেলিমের চরিত্রটিও শিক্ষণীয় কারণ কাছের মানুষের প্রকৃত রূপ অনেকেই বুঝতে পারে না। অপরাধ করে সে অপরাধের জন্য অনুশোচনা করা এটাও জরুরি বিষয় শেখার জন্য। সেলিমের চরিত্রে আছে এ দিকটি।

নির্মাণের গুণে আজকের ডিজিটাল সিনেমা দর্শককে আকর্ষণ করে। তামিল-তেলেগু সিনেমার নির্মাণের গুণ ক্যামেরার কাজকে বাণিজ্যিক সিনেমাতেও নিপূণ করে তুলে ধরে। আমাদের এখানে অফট্র্যাকে ইদানিং এটা শুরু হলেও বাণিজ্যিকে টুকটাক হচ্ছে। ‘সুলতানা বিবিয়ানা’-র ক্যামেরা কথা বলেছে নির্মাতার ভাষায়। প্রকৃতি কথা বলেছে গ্রামের মেঠোপথে বাপ্পি-আঁচলের হাত ধরে হেঁটে যাওয়াতে, আঁচলের নদীতে ডুব দিয়ে ওঠা জলতরঙ্গ ধরাতে, বিশাল রাস্তাকে সোজাসুজি সবুজ করে দেখানোতে, সূর্যাস্তের সৌন্দর্য তুলে ধরাতে, শীতের কুয়াশাকে বিরহের গানে প্রতীকী করাতে। ‘এক পলকে ভালোবেসে’, ‘বলে দে’ গানগুলোতে প্রকৃতি কথা বলেছে। নির্মাতা ক্যামেরার কাজ জানে দর্শকরা বলেছে এটা।

ভালো কাজে খুঁত কিছু থাকেই। ‘দাগ ছাড়া শিখবে কী করে?’-বিজ্ঞাপনের এ ভাষাকে যদি কাজে লাগাই তবে এটুকু সমালোচনার অংশ অবশ্যই। তবে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের কাজগুলো ভালো করার প্রেরণা যাতে নির্মাতার থাকে সমালোচনার লক্ষ্য সেটাই। সিনেমার খুঁতটা দর্শক একবাক্যে বলেছে ফিনিশিং ফাইটকে। সেটটা ছিল এফডিসিতে আর সেখানেই সমস্যাটা হয়েছে। অনেকে বলেছে ফাইট না থাকলে সিনেমাটা ওভারঅল মানসম্মত হত। কিন্তু নির্মাতার কথাটা মাথায় রাখতে হবে। মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়ালে ফাইট না থাকলে দর্শক সবসময় ঠিকভাবে গ্রহণ করে না এমনকি হ্যাপি এন্ডিং এর চিন্তাও সেজন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেসব সমীকরণে গিয়েই ফাইটিং সিকোয়েন্সটি গোটা সিনেমার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি করেছে তবে সেটাকে ‘ব্ল্যাক হোল’ জাতীয় মনে করলে ভুল করবে সেসব সমালোচক যারা বড় করে দেখতে চায়। সিনেমার গল্পের সুন্দর প্রেজেন্টেশনে শেষের খুঁতটিকে বড় না করাই সিনেমার প্রতি সুবিচার হবে। তবে খুঁতটি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না সেটা সত্য।

সুলতানা বিবিয়ানা‘ কি রোমান্টিক ড্রামা নাকি রোমান্টিক ট্রাজেডি। গল্পে কিন্তু দুটোই আছে। দর্শক-সমালোচক যে যার মতো বেছে নিতে পারবে।

‘সুলতানা বিবিয়ানা’ একজন নতুন সম্ভাবনাময় গল্পকারের সিনেমা। সেটা থেকে নির্মাতা প্রথম সিনেমাতে দর্শকের পজেটিভ রায় পেয়েছেন আর দর্শক পেয়েছে বছরের প্রথম মৌলিক গল্পের সুন্দর সিনেমা। গল্পকার-নির্মাতা-দর্শকে একাকার এ সিনেমা। এভাবে আগামী দিনগুলোতে একাকার হতে পারলে ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে।


মন্তব্য করুন