Select Page

সূর্য দীঘল বাড়ি, দহনের চিত্রগ্রাহক প্রয়াত

সূর্য দীঘল বাড়ি, দহনের চিত্রগ্রাহক প্রয়াত

আনোয়ার হোসেন (১৯৪৮-২০১৮)।

শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেল থেকে খ্যাতিমান আলোকচিত্রী-চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান হলো এক বর্ণাদ্য জীবনের। জানা যায়, দু্ই যুগ ধরে তিনি ফ্রান্সের নাগরিক। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি আলোকচিত্রী প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আসেন।

আনোয়ার হোসেন গত ২৮ নভেম্বর হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে ওঠেন। তিনি শুক্রবার রাত ১০টার দিকে শেষবার হোটেলে ফেরেন। পরদিন সকালে প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানের আয়োজনকারী দলের সদস্যরা ওই হোটেলে আসেন। আনোয়ার যে কক্ষে ছিলেন, সেই কক্ষের দরজায় ধাক্কা দিলেও কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না তারা। আধা ঘণ্টা ধরে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পরও সাড়া না পাওয়ায় তাঁরা পুলিশ ডাকেন। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভেঙে আনোয়ারের লাশ উদ্ধার করা হয়।

আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৮ সালে ৬ অক্টোবর পুরোনো ঢাকার আগা নবাব দেউড়িতে। তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিকমানের একজন আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র ভিডিওগ্রাফার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রহণে অবদানের জন্য বেশ পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠা ছিল অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু জীবনকে জয় করেছিলেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, খুবই অর্থকষ্ট ছিল বাল্যকালে। আরমানিটোলা স্কুলে ফার্স্টবয় থাকলেও ক্লাসে নিয়মিত আমার নাম ডাকা হতো না। কারণ বাবা তিন মাস পর্যন্ত বেতন দিতে পারেননি। ১০ টাকা বেতন, তিন মাস পর পর না দিলে নামটা কাটা যেত। যখন টাকা পরিশোধ করতেন, আবার নাম তোলা হতো। ক্লাস ফাইভ না এইটে পড়ার সময় স্কলারশিপ পাই। বাবা স্কুলের পোশাক কিনে দিতে পারেননি। আমার আর দু-তিনজন ছাত্রের পোশাক ছিল না। এসব আর্থিক দ্বন্দ্ব-কষ্ট মিলে বেড়ে ওঠা।

আনোয়ার হোসেন (১৯৪৮-২০১৮)

বুয়েটে পড়াশোনার মাঝে ভারতে চিত্রগ্রহণের উপর স্কলারশিপ পান। সে সুযোগ হাতছাড়া করেননি। বুয়েট শেষ না করেই পাড়ি জমান ভারত। এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি একই সপ্তাহে পুনে ও পোল্যান্ডের দুটি স্কলারশিপ পাই। পুনে বেছে নেওয়া হয়। থার্ড ইয়ারে আর্কিটেকচারে শিক্ষকদের বলে ফেলেছিলাম, আমি কিন্তু আর্কিটেক্ট হব না; যদিও ক্লাসে ফার্স্টক্লাস পেয়েছি। পুনেতে স্কলারশিপ পেলাম, টিচাররা খুব রেগে গিয়েছিলেন। যেভাবেই হোক পুনেতে গেলাম। সেখানে নামটি এভাবে ছড়াল- আমি হলাম বাংলাদেশের কেকে মহাজন; যদিও মহাজনের চেয়ে ভারতে ভালো ক্যামেরাম্যান আছে। আমি মনে করি, সুব্রত মিত্রের ধারেকাছে কেউ যায় না। সুব্রত মিত্র ও সত্যজিতের যে কম্বিনেশনটা, বিশ্বের মধ্যে ফাইনেস্ট কম্বিনেশন।

দেশে ফিরে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র ক্যামেরার কাজ করেছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এ ছবি নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছবির ক্যামেরার কাজ জীবন্ত ছবির মতো।’ আনোয়ার হোসেনের মতে, ছবিটায় খুব প্রাণ ছিল। তবে অপু ট্রিলজি বা ঘটকের সুবর্ণরেখা কিংবা অযান্ত্রিকের ধারেকাছেও যায় না। আমরা তো অল্প কিছুতেই তৃপ্ত হয়ে যাই। সূর্যদীঘল বাড়ি করে খুব আনন্দিত বা গর্বিত ছিলাম। কিন্তু এখন আমি লজ্জিত অনুভব করি। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটা কিন্তু দুর্বল ছবি। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই চলচ্চিত্র একটি পরিবর্তন আনে এবং বিরাট অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি মনে করি, সত্যিকারার্থে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো ভালো ছবি হয়নি। যদি আমরা আন্তর্জাতিক অর্থে ভাবি। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার রয়ে গেল।

অন্যান্য ছবি প্রসঙ্গে বলেন, আমার তো শুরু হলো ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ আর ‘এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী’ দিয়ে। ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র সাকসেসের ফলে অনেকে এগিয়ে আসে, আমাকে দিয়ে ছবি করাবে। যেমন- চিত্রালীর এডিটর বাদলকে নিয়ে উজ্জ্বল আসেন। মমতাজ ভাই, মমতাজ ভাইয়ের ‘নালিশ’। আমি বলি যে কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করব না। এই ডিশিসনটা দিই। এরপর সত্য সাহা আসেন। ‘পুরস্কার’ নামের চলচ্চিত্রটা করেন। নেয়ামত ভাই কিন্তু ইমিডিয়েটলি আবার চেষ্টা করেন, পর পর দুটি ছবি করেন। একটা হলো ‘অন্য জীবন’, আরেকটা ‘দহন’। সূর্যদীঘল বাড়ির পরপরই দহন চলচ্চিত্রটি হয়, আমি, শেখ নেয়ামত আলী আর ডলি- এই তিনজনের মতে, এটি ফার্স্ট সুপিরিয়র ফিল্ম দ্যান সূর্যদীঘল বাড়ি। এটা বাংলাদেশের কিছু ক্রিটিকও সম্প্রতি বলেছেন। এ ছবিটা কিন্তু হাইলি আন্ডারএস্টিমিটেড। তারপর মোর্শেদুল ইসলামের সঙ্গে ‘চাকা’। চাকা করার পর ‘বৃষ্টি’ নামের একটা ছবি, ‘দীপু নাম্বার টু’- এগুলোর কাজ শুরু হলো। একদম প্রথম দিকে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর ‘ঘুড্ডি’তে কাজ শুরু হয়েছিল। সর্বমোট গোটা পনেরো ছবি করি বোধ হয়। ফিচার ফিল্ম। গোটা তিরিশেক ডকুমেন্টারি ছবি করি বোধ হয়। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একটা ছবি করি ‘শ্যামল ছায়া’।

সূত্র : কালের কণ্ঠ ও প্রথম আলো

 


মন্তব্য করুন