Select Page

রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি

রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি

রায়হান রাফি পরিচালিত ‘দহন’-এ সিয়াম-পূজা। ছবি : জাজ মাল্টিমিডিয়া

নাম : দহন
ধরন : সোশ্যাল পলিটিক্যাল ড্রামা
পরিচালক : রায়হান রাফি
কাস্ট : সিয়াম আহমেদ (তুলা মিয়া), পুজা চেরি (আশা বেগম), জাকিয়া বারী মম (সাংবাদিক), ফজলুর রহমান বাবু (কবির), শিমুল খান (পুলিশ ইন্সপেক্টর), তারিক আনাম খান (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), রাইসুল ইসলাম আসাদ (ইমাম), শহীদুল আলম সাচ্চু (চেয়ারম্যান), মুনিরা আখতার মিঠু (আশা’র মা), হারুন-অর-রশিদ (পাড়ার দোকানদার), জামিল হোসেন (গুপ্তচর), রাশেদ মামুন অপু (মর্গের কর্মী), সুষমা সরকার (ডাক্তার), ববি (সুষমার বাবা), জামশেদ শামীম (কাওসার), রিপা রাজ (ফুলবানু), জাহিদ হোসেন শোভন (ডাক্তার), মেহেদী হাসান পিয়াল (ডাক্তার) প্রমুখ।
প্রযোজনা : জাজ মাল্টিমিডিয়া
শুভমুক্তি : ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

নামকরণ : ছবির প্রেক্ষাপট গত কয়েক বছর আগে দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া পেট্রোল বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে। যাত্রীবাহী বাসে ছুড়ে মারা সেই পেট্রোল বোমায় পুড়ে ছারখার হয়ে যায় জন ত্রিশেক প্রাণ। রাজনৈতিক ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কুটনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যেই কেড়ে নেওয়া হয় এসব নীরহদের প্রাণ; এটা বলার বিষয় রাখে না। তাই বলা যায় মূল থিম অনুসারে ‘দহন’ নাম যথার্থ।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : তুলা, ঢাকার এক পাতি গুন্ডা, যাকে সবাই এলাকায় ‘হারামী তুলা’ নামে চেনে। সমসাময়িক ঢাকার শাহবাগে ঘটা সেই পেট্রোল বোমা হামলার একমাত্র জ্যান্ত/জীবিত আসামি হলেন তিনি। এরকম এক‌টি ন্যক্কারজনক ঘটনা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়, জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। আর এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ কী হয় তা আমরা সবাই জানি, এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষে দোষ চাপানো! কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট সম্পুর্ণ আলাদা, তাই সরকার মহল খুব গুরুত্বের সাথে সবকিছু তদন্ত করা শুরু করে। ঠিক সেরকম এক পরিস্থিতিতেই বোমা হামলার মূল হোতা তুলা সবাইকে রীতিমতো চমকে দিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে।

কী গল্প রয়েছে এর পেছনে, কেনই বা তুলার মতো এক পাতি গুন্ডা জানের ভয় থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলো, আর আদালত এই বোমাবাজ ও এর পেছনের লোকদের বিরুদ্ধে কী রকম অবস্থান নেয়, তাদের কি শেষ পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায় নাকি আড়ালেই থেকে যায়… এর সবকিছু পুরো ছবিতে দেখতে পাওয়া যায়।
প্রথমে একটি বিষয় আলোচনা করে নেওয়া ভালো; ক্ষেত্রবিশেষে ছবির কিছু সিন অনুপ্রাণিত বটে, আর আমি মনে করি একজন ডিরেক্টরের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা নেওয়া মোটেও দোষের কিছু না। তবে এ ছবির গল্প মৌলিক, কোনো পুরোনো ছবি থেকে ছাপা কিংবা কপিপেষ্ট করে বসিয়ে দেওয়া হয়নি।

ছবির সংলাপগুলো বেশ শক্তিশালী এবং ক্ষেত্রবিশেষে হৃদয়স্পর্শী ছিল; যেকোনো মানুষকে ইমোশনাল করার জন্য যথেষ্ট।

পূজা, সিয়াম আহমেদ ও জাকিয়া বারী মম।

ছবির চিত্রনাট্য বলতে গেলে প্রায় ঠিকঠাক। প্রায় বলছি, কারণ বেশ ভালো জনপ্রিয়তা পাওয়া এ ছবির ট্রেলারটি গল্পের অনেকটাই খোলাসা করে ফেলেছে। তাই প্রথমার্ধ ঠিকঠাক এগুলেও দ্বিতৗয়ার্ধে ছবির গল্প অনেকটাই সমতল হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ এরপর কী ঘটতে চলেছে দর্শক হিসেবে তা অনেকটাই আন্দাজ করার মতো পরিস্থিতি চলে এসেছিল। ট্রেলারটি ভালো ছিল বটে, তবে ছবির গল্প বেশ খানিকটা খোলাসা করে ফেলাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

ছবির প্রথমার্ধ অনেক ভালো ছিল। রায়হান রাফির দূর্দান্ত পরিচালনায় আপনি ইমোশনে জড়াতে বাধ্য। গরিব ঘরে বেড়ে ওঠা কলেজ পড়ুয়া ছেলের মানুষিক কষ্ট কিংবা অসুস্থ মাকে শুধুমাত্র সুস্থ দেখার জন্য মিথ্যা বলে নিজের কিডনি বিক্রি করে দেওয়া, একজন আল্লাহওয়ালা লোকের ছেলেরা যদি দিনরাত মাতলামো, জুয়াখেলা এবং ঝগড়া-মারামারিতে ব্যস্ত থাকে.. তার মনে যে কী যন্ত্রণা, এসব বিষয়গুলো খুব ইমোশনালি পর্দায় ফুটে উঠেছে।

কিন্তু এ ছবির দৈর্ঘ্য একটু কমই মনে হয়েছে; বিশেষত, ছবির দ্বিতৗয়ার্ধ। কিছু বিষয়ে এছবির চিত্রনাট্য ওতটা গভীরে যায়নি; ছবির দেখার সময় মনে হচ্ছিল এই বিষয়গুলো থাকা দরকার ছিল। যেমন; বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, প্রতিবারই কোনো রাজনৈতিক কারণে দূর্ঘটনা হলে সরকারপক্ষ কিংবা বিরোধী পক্ষ কেউই দোষ/দায় নিজের কাঁধে নেয় না। তাহলে এসবের পেছনে কারা থাকে? কেন তারা এগুলো করে? বোমাবাজদের অর্থের যোগান কীভাবে হয়? সেসব বিষয়ে এ ছবিতে তেমন হাত দেয়া হয়নি, একরকম এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। এই বিষয়টির অভাব ছবি দেখার সময় উপলব্ধি করেছি।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫৫।

অভিনয় : এটি ছবির সেরা অংশ । একবার কাস্টিংয়ে চোখ বুলিয়ে নিন। পুরো ছবিটিই দূর্দান্ত সাপোর্টিং কাস্টে ভরা! এমন অনেকে আছে যাদের অভিনয় মন ছুঁয়ে গেছে কিন্তু সঠিক নাম জানি না বিধায় রিভিউ এর শুরুতে তাদের নাম উল্লেখ করতে পারিনি। আমি মনে করি এছবির একটি শক্তিশালী অংশ ছিল এর সাপোর্টিং কাস্ট।

‘পোড়ামন ২’ এর সুজন শাহ থেকে ‘দহন’ এর তুলা’র উন্নতি চোখে পড়ার মতো! ইমোশনাল সিনে সিয়াম এতোটাই দারুণ অভিনয় করেছে যা চিন্তার বাইরে; যা আশা করেছি তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালো! তুলা চরিত্রটি দিয়ে সিয়াম যদি এবার ন্যাশন্যাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়ে যায়, অবাক হবো না।

পুজা যে লম্বা রেসের ঘোড়া, দিনকে দিন তার পারফরমেন্সে তার প্রমাণ দিচ্ছেন। কোনোরকম জড়তাবিহৗন অভিনয়ে তিনি আরো পোক্ত হয়েছেন এছবিতে।

আরেকটি দারুণ বিষয় ছিল, চরিত্রের প্রতি সিয়াম-পুজা’র ডেডিকেশন! এটা নিয়ে অনেক সময়ই অভিনয় দূর্বলতা ঢেকে দেওয়া যায়; যা প্রত্যেক অভিনেতার মধ্যেই থাকা জরুরী।

বাকি যারা আছেন তাদের মধ্যে ফজলুর রহমান বাবু, তারিক আনাম খান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, জাকিয়া বারী মম, সুষমা সরকার, মনিরা মিঠু, হারুন-অর-রশিদ, শিমূল খান এরা সবাই পরিমিত পর্যায়ে ছিলেন। সিনিয়র অভিনেতা ববিকে সম্ভবত এই প্রথম কমেডি রোলের বাইরে কোনো বিশেষ চরিত্রে দেখলাম, ভালোই লেগেছে। ছবিতে পরিচালক রায়হান রাফিকেও কিছু সময়ের জন্য দেখা যায়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০।

‘দহন’ সিনেমায় সিয়াম আহমেদ ও পূজা। ছবি : জাজ মাল্টিমিডিয়া

কারিগরি : রায়হান রাফির ডিরেকশন আর ভালো ক্যামেরাওয়ার্ক, এটি একপ্রকার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছে।’পোড়ামন ২’ এর মতো এ ছবিতেও চোখজুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফি রয়েছে। এডিটিং এ কিছুটা দূর্বলতা ছিল, বিশেষ করে ছবির ভিএফএক্সে। কিন্তু বাসে আগুন লাগানোর সময়কার ভিএফএক্স বেশ ভালো ছিল। প্রায় ৫ মিনিট স্থায়ী ছিল ওই সিক্যুয়েন্সটি; ভালো মেকআপ এবং কোরিওগ্রাফিও অনেক ভালো হয়েছে, যার কারণে পর্দায় ইমোশন ফুটে উঠেছে। ওই সিক্যুয়েন্সটিই এই ছবির সেরা!

কালার গ্রেডিং ঠিকঠাক। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক জাদুকরী কিছু না হলেও মোটামুটি ছিল। আর জাজের ছবির জনবল নিয়ে কোনো কথা হবে না। বড় প্রডাকশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি, যথেষ্ট জনবল থাকার কারণে তারা বড় রিস্ক নিতে পারে, ডামি ব্যবহার না করে আসল লোকেশনে শ্যুট করতে পারে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।

বিনোদন : ছবির প্রথমার্ধে বেশকিছু কমেডি সিন রয়েছে। আগেই বলেছি, ছবির প্রথমার্ধে যে কেউ গল্পের ইমোশনে জড়িয়ে যাবেন। সিক্যুয়েন্সের সাথে মানানসই বিজিএম এবং ভালো অভিনয়ের ফসল হলো এটি।

ছবিতে মোট গান রয়েছে ৫টি। সমালোচিত ‘হাজির বিরিয়ানি’ গানটিতে শুধু ‘হিসু’ নয়, যতপ্রকার আপত্তিকর শব্দ ছিল তার সবকিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, তাই গানটি শুনে ভালোলেগেছে। তবে ছবিতে অনেকটাই জোর করে গানটি বসানো হয়েছে, সিচ্যুয়েশন অনুসারে আসেনি। একই সমস্যা ‘প্রেমের বাক্স’ গানটির ক্ষেত্রেও; হুট করেই পর্দায় আগমন। তবে এই গানের কোরিওগ্রাফি অন্য লেভেলের ছিল। অন্য তিনটি গান গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, তাই শুনতে এবং দেখতে ভালো লেগেছে।

ছবির দ্বিতৗয়ার্ধে বেশকিছু সোশ্যাল মেসেজ দেওয়া হয়েছে। অন্যায় স্বার্থ হাসিলের জন্য নীরহ অসহায় মানুষদের ব্যবহার করা যে ঠিক না, এমন বার্তা পাওয়া যায় এ ছবি দেখে। অন্তত আর যাই হোক, কেউ যেনো তুলার মতো অপরাধী না হয় সেই বার্তা পাওয়া যায়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।

ব্যক্তিগত : রায়হান রাফি হলেন এইসময়ের অন্যতম ট্যালেন্টেড একজন পরিচালক। তার প্রথম ছবি ‘পোড়ামন ২’ যেমন মেকিং এ মুগ্ধ করেছিল, ঠিক তেমনি ‘দহন’ এর মেকিংও মুগ্ধ করেছে। বহুদিন পর কেউ রাজনৈতিক সিনেমা নিয়ে বড়পর্দায় হাজির হলেন, এটিও ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার একটি কারণ।

সবমিলিয়ে বলবো, ছবির স্ক্রিনপ্লেতে আরেকটু সাসপেন্স রাখলে ছবিটা অন্যরকম হতো। ট্রেলারের ভুলভ্রান্তিগুলো গল্পের গভীরতা এবং সাসপেন্স দুটোই কমিয়ে দিয়েছে। ছবির দৈর্ঘ্যের স্বল্পতা অনুভব করেছি। এছাড়া এডিটিংয়ে একটু দূর্বলতা ছিল, যদিও এক্ষেত্রে বাজেট একটি ব্যাপার। সবমিলিয়ে ছবিটি আমার কাছে মোটামুটি ভালো লেগেছে।

রেটিং : ৭.৫/১০

ছবিটি কেন দেখবেন : সিয়াম-পুজা-রায়হান রাফির ভক্তদের জন্য এছবি মাস্টওয়াচ! তিনজনই তাদের সেরাটা দিয়েছেন এ ছবিতে। এছাড়া যারা সোস্যাল পলিটিক্যাল ছবি পছন্দ করেন কিংবা ক্রাইম ড্রামা জনরার ছবি পছন্দ করেন যারা তাদের এ ছবি ভাল্লাগবে।


মন্তব্য করুন