![অনুদান পাওয়ার সাত বছর পর মুক্তি পাচ্ছে ‘আজব কারখানা’](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2024/06/ajob_karkhana1_bmdb_image.jpg?resize=150%2C150&ssl=1)
‘স্বপ্নজাল’ ছিন্ন করে
স্বপ্নজাল আর দর্শকের মাঝে দাঁড়ায়া থাকে আরেকটা গল্প। যেটা মনপুরা সিনেমার। সেটা নিছক প্রত্যাশার চাপ অথবা সচরাচর এ ধরনের সিনেমা দেখতে না পারার আদেখলাপনা। আর অবশ্যই এক সিনেমায় লব্ধ গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ব্র্যান্ড ভ্যালু। এর বাইরে গিয়া বলা যায়, মনপুরার তুলনায় স্বপ্নজাল আরো পরিণত গল্পের। হ্যাঁ, প্রশ্ন হলো সেই গল্প আমরা কীভাবে দেখলাম, কী বুঝলাম।
মনপুরায় গ্রাম্যতার ভেতর একটা রাবীন্দ্রিক ভাব ছিল (গানগুলাও খেয়াল করেন), নিটোল একটা সৌন্দর্য ছিল, তার ছিল গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তি। আর পরিপাটি ভাব দুই সিনেমায় আছে। মনপুরার গল্প পুরাটা একটা ভাবের মধ্যে খেলছে। সেই খেলায় দর্শক অংশ নিতে পারছেন সহজে। এই ভাবটা উৎরাইয়া যাইতে চাইছেন হয়তো দর্শক। সেটা স্বপ্নজাল বানানোর সময় হয়তো নির্মাতাও ভাবছেন। আমরা আরেকটা মনপুরা চাই নাই, নির্মাতাও চান নাই।
স্বপ্নজালের গল্পটা স্বপ্ন ছিড়ে-ফুড়ে বের হতে চায়। তাই হয়তো নানা চাপের কারণে ব্যর্থ প্রেমটাই কোনো মহত্ব আরোপের অবসর মেলে না, উল্টো শেষাংশ বেশ দীর্ঘায়িত মনে হয়, ক্ষণে ক্ষণে গল্পে প্রেম অনুপস্থিতিও ছিল। সেই অনুপস্থিতি আবার প্রেমরে জোরদার করে নাই। হয়তো প্রেম ব্যর্থ হয় না, সিনেমাটাও ঝুলে গেছে।
স্বপ্নজাল কিশোর বয়স পার হয় হয়— এমন দুজনের গল্প। মাঝে আছে হিন্দু নায়িকা শুভ্রার বাবার অচমকা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। যার কারণে দেশান্তরী নায়িকা, আর নায়কের ঘাড়ে দুইটা দায়িত্ব। কলকাতায় নায়িকার কাছে পৌছানো আর তার বাপের অন্তর্ধান রহস্য করা। মোটের উপর এ পর্বের প্রেম-যাতনা-সৌন্দর্য দারুণভাবে ফুটে উঠছে। দর্শকমাত্র সাক্ষি।
তারপরও এ প্রেম দাগ কাটে না। মোটাদাগে প্রেমের গল্পের বাইরে নায়িকার বাবার খোঁজাখুঁজি আর ভিলেনের কমেডিয়ান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা গল্পের ফোকাস নষ্ট করে। ফলত, অপুর প্রেম অনুধাবনে ক্রমিক ক্রমিক বিরতি ঘটে। অথচ এই উম্মাতাল আবেগে ভাইসা যাইতে চান দর্শক। কারণ, বাংলাদেশে প্রেমের অভাব।
ভাইবা দেখেন— এই সিনেমা ফেরতা দর্শকরা কোন বিষয় নিয়া কথা বলছেন বেশি। ঠিক ধরছেন। ফজলুর রহমান বাবু। তিনি এ সিনেমার ভিলেন। প্রকৃতি তারে শাস্তি দিছে। খুনটা করার পর থেকে খাইতে পারেন না। বমি হয়ে যায়। আবার বমি না হইলে অন্য অত্যাচার ঘটে। তা না-ই বললাম।
প্রকৃতির এমন বিচারে কে আস্থা রাখে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু ভিলেনের কমেডিয়ান হয়া উঠা শুধু মূল গল্পকে ব্যাহতই করেন না, দুই অর্থে স্থুলতা ঘটে। খারাপ মানুষের প্রতিও ভালো মানুষের একটা জাস্টিসের ধারণা থাকে বা নিদেন পক্ষে দেখার চোখকে আরেকটু সহানুভূতিশীল করতে পারতেন তা হয় নাই। এটা অবশ্য দোষের না। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমন। ক্রসফায়ারের বৈধতার যুগে যেটারে আপনি ইভিল বলবেন তাকে উপস্থিত করবেন ঘৃণ্যভাবে। সে দেখতে অসুন্দর, তার কাজ অসুন্দর, দুনিয়াতে তার থাকাথাকিও অসুন্দর। এছাড়া ঘন ঘন বমি বা বাথরুমে যাওয়ারে কোন রুচি দিয়া উপস্থাপন করবেন? যদিও বাংলা সিনেমার ট্র্যাডিশনাল দর্শকরা এগুলাতে আগে থেকে অভ্যস্ত। দিলদারের সিনেমা ভালো উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু এটা আপত্তি না। বাবুর কষ্টকর ক্যারিশমাটিক অঙ্গভঙ্গি গল্পের ফোকাস নষ্ট করছে। কারণ, আমরা প্রেমময় অনুভূতির ভেতর দিয়া বাইর হইতে চাইছিলাম। সেলিমই বার বার বলছিলেন, বাঁধন হারা প্রেমের গল্প। হয়তো এখানে মনপুরার সঙ্গে মোটাদাগে একটা পার্থক্য রচিত হয়। এটাকে বাবুর ব্যর্থতা বলছি না, ভালো অভিনয়ও হয়তো বলা যায়। কিন্তু আরো ভালোর জন্য আপাত অনেক ভালো জিনিস বাদ দিতে হয়।
তবে হ্যাঁ, আমরা এক বন্ধু ভালো একটা জিনিস আবিষ্কার করছেন। তিনি বিকল্প একটা গল্পের সন্ধান পাইছেন। যেখানে বাবুই মূল চরিত্র। আর তার গল্পটা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘ম্যাকবেথ’-এর সঙ্গেই মিলে যায়। এই অনুধাবণটা যুতসই। সমস্যা হলো আমাদের মন যেহেতু পড়ে থাকে ‘প্রেমহীন’ বাংলাদেশে প্রেমময়তায়, ম্যাকবেথের ধারণাটা শুধু মনে করা যায়, কিন্তু ততটা উচ্চতার সঙ্গে আরোপ করা যায় না। আর ম্যাকবেথের সামগ্রিকতা, তার সঙ্গে এর তুলনা না করাই ভালো। তারপরও আইডিয়া হিসেবে খারাপ না।
এবার প্রসঙ্গান্তর হোক। যেহেতু শুনলেন নায়িকা হিন্দু, নিশ্চয় ধরতে পারতেছেন এ প্রেমের মাঝে বাধা হয়া আসছে ধর্ম। মোবাইল আবিষ্কারের আগের যুগের গল্পে সেটাই মনে হলো। সিনেমা যেমন দেখাইছে— তাতে ধর্ম আকারে নায়িকার মায়ের আপত্তি ধরতে পারছি। আমিও গ্রাহ্য করছি। কিন্তু নায়কের বাবা-মার আপত্তি পুরা এস্তেমাল হয় নাই। একটা কারণ হতে পারে, তাদের বয়স নিতান্তই কম। আর কী?
সিনেমাজুড়ে নায়িকা ও তার মাকে নানান ধরনের ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে দেখি। ফলত অধর্ম তাদের কাছে একটা সমস্যা। কিন্তু নায়কের বাবা-মা’র কাছে? আমার কান বন্ধ হয়া না গেলে বলতে পারি, নায়ক হারায়া গেলেও বাবা-মায়েরে ‘আল্লাহ’র নাম নিতেও শোনা যায় না। ধর্মের বাধা নিশ্চয় সরাসরি আসমান থেকে নাজিল হয় না, আচারি দিক থেকেও। তাদের দিক থেকে ধর্ম কীভাবে জোরদার সমস্যা হয় বোঝা গেল না। হয়তো সমস্যা না, দর্শকের বোঝার ভুল।
তবে এটা নিশ্চয় বুঝতে ভুল হয় নাই— মুসলমানরে তার আচার-আচরণের ভেতর দিয়া মুসলমান বলতে চরম অবহেলা আছে, নয়তো অবজ্ঞা আছে। ভালো হিন্দু হইলে পূজা-আর্চণা করে, আর ভালো মুসলমান হইলো আচারহীন। এমনটা আমরা মেনে নিছি। বাঙালি শিক্ষিত নির্মাতারা মুসলমানকে আচারহীনভাবে দেখাতে পারেন, এমনকি অপু নায়িকার বাড়ির তুলসি গাছে পানি দেবে— এটাও মহৎ ব্যাপার।
সিনেমাটাই আরেকটা বিষয় আছে চোখে লাগার মতো। কারণ একই ঘটনা সাম্প্রতিক দুই যৌথ প্রযোজনায় (শঙ্খচিল, শিকারি) চোখে পড়ছে। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই অবৈধ পথে বাংলাদেশিদের ভারতে পাড়ি জমানো। কলকাতা বা আগরতলা যেভাবে ডালভাত হয়া গেছে নাইবা বললাম। বাট, ভূ-রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতার সময়ে এসে এসব চোখে লাগে। একদিকে আসতেছে রোহিঙ্গা, অন্যদিকে ঘাই মারছে আসাম। তা-ই বলা আরকি।
স্বপ্নজালে যেভাবে একটা মফস্বল (চাঁদপুর) শহরে তুলে ধরা হইছে— ভাবতে ভালো লাগে বাংলাদেশের ছবি এটা। সৌন্দর্য ঝরে ঝরে পড়ছে। পরী মনি বা ইয়াশ রোহানের অভিনয়ও সুন্দর। আরোপিত লাগে মিশা সওদাগরকে। খুব আবেদনময় না হলেও গান শুনতে ভালোই লাগে।
গিয়াসউদ্দিন সেলিমের কাছে আরো সুন্দর সুন্দর সিনেমা আশা করি। আর সিনেমাটাকে এভাবে বলাবলি বা দেখাদেখি ভালোবাসা থেকে। সেলিম মনপুরায় দৃশ্যায়নের যে কাব্য তৈরি করছেন, স্বপ্নজালে তার থেকে আগায়া গেছেন। বলতেই হয়। আর সবাই তো ভালোই বলছেন দেখছি। আমি না-ই অতৃপ্তির কথাটা বললাম।