Select Page

স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রে আলো দেখানো ‘আহত ফুলের গল্প’

স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রে আলো দেখানো ‘আহত ফুলের গল্প’

প্রথমে একটা দৃশ্য মনে করুন।একজন পরিচালক ছবি বানিয়েছেন তারপর ছবিটা প্রদর্শনের জন্য সিনেমাহল পর্যন্ত পৌঁছাতে তার সাধ্যে কুলাচ্ছে না। দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের নানা বাধা আছে। তো তিনি এখন কি করবেন! তিনি নিজে হয়ে গেলেন ঐ ছবির ফেরিওয়ালা। তিনি সারাদেশে নিজের উদ্যোগে ছবি দেখানো শুরু করলেন। নিজে টিকেট বিক্রেতা হয়ে গেলেন।

বাস্তবতার সাথে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকারের এই যে যুদ্ধ এর জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। নিজের ছবির ফেরিওয়ালা হতে পেরেছেন বলেই এ যাত্রার ছবির স্বপ্নদ্রষ্টা তারেক মাসুদ-কে ছবিটি উৎসর্গ করেছেন। বাস্তব যুদ্ধের কারণে খাঁটি চলচ্চিত্রপ্রেমীরা চাইবে তাঁর ছবিটির সাথে থাকতে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিচালক অন্ত আজাদের ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ‘আহত ফুলের গল্প’ দেখা উচিত।

ছবিটি ইনডিপেনডেন্ট ধারার ফিল্মে একটা আলোকিত সমাজের স্বপ্নকে দেখিয়েছে। স্বপ্ন দেখানোই নির্মাতার কাজ। অন্ত আজাদ দেখিয়েছেন তাঁর মতো করে।

প্যারালাল স্টোরি টেলিং-এ ছবির গল্প দুইভাবে বিভক্ত –
১. পিছিয়ে থাকা সমাজ
২. আলোর দিকে ফেরা সমাজ
দুটি সমাজের গল্প একটা সমাজের মধ্যেই পরিচালক দেখিয়েছেন মানে একের ভেতর দুই যাকে বলে। পিছিয়ে থাকা সমাজে ইসলামের অনুশাসনকে ভুলভাবে ব্যবহার করার মতো কিছু লোকজনের বিশ্বাস, কর্তৃত্ব দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে আলো দেখানো মানুষেরা চিন্তাধারায় পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে আলোর দিকে ফিরিয়ে আনে। একই সমাজে দুই চিন্তাধারার মানুষের মাধ্যমে একশ্রেণিকে দিয়ে অন্যশ্রেণিকে কাউন্টার দেয়া হয়েছে। বাল্যপ্রেমের পরিণতি কতটা বেদনার হতে পারে সমাজের দুই শ্রেণির উপস্থাপনে আছে। প্যারালাল স্টোরি টেলিং-এ ছবির গল্প ভালো ছিল।

– তুমি এ বই কেন পড়তে দিয়েছ শাপলাকে? নাজায়েজি বই।
– আপনি পড়েছেন?
– না আমি জানি
– আপনি না পড়েই জানেন? আগে পড়ে দেখুন আপনারও ভালো লাগতে পারে
– সত্যি বলছ তো?
– হ্যাঁ, একবার পড়ে দেখুন
রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়লে মানুষ পিছিয়ে যায় না বরং নতুন কিছু শেখে। বইপড়ার মাধ্যমে নিজেকে নতুন করে জানা ও বোঝার বড় একটা মেসেজ ছবিতে আছে। চমৎকার ছিল।

ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক একটা ছবির মতো গ্রাম। অনেকদিন ধরে গ্রামের ছবি দেখেনি এমন দর্শকের ভালো লাগবে গ্রামটি। দারুণ সিনেমাটোগ্রাফিতে পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামকে জীবন্ত করে দেখানো হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া কুতকুত খেলা, মার্বেল খেলা, পড়ার বইখাতায় যোগ চিহ্ন দিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার নাম লেখার মতো সংস্কৃতি উঠে এসেছে।

চিন্তা করুন তো যে ছবিতে স্টারকাস্ট নেই সেখানে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের অভিনয়শিল্পী দিয়ে অভিনয় করানোটা কতটা চ্যালেণ্ঞ্জিং। ছবিতে নায়ক-নায়িকাও নবাগত। প্রধান নারী চরিত্র শাপলার ভূমিকায় তাহিয়া খান আর নায়কের ভূমিকায় সুজন মাহবুব। তাহিয়া যদি লেগে থাকে এবং সুযোগ পায় সামনে সে ভালো অভিনেত্রী হবে। তার মধ্যে ডেডিকেশন আছে। সুজনের অভিনয়ে একঘেয়েমি থাকলেও চেষ্টা আছে। গাজী রাকায়েতের চরিত্রটি ছিল শক্তিশালী। চরিত্রায়ণে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি নিজের অভিনয়ে দারুণ। তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটি ছিল শাপলা চরিত্র মানে তাহিয়ার বিপরীত। তার মধ্যে সচেতনতা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল। দুই বাবার ভূমিকাতেও ছিল তফাত। ‘রানওয়ে’ ছবিতে জঙ্গি চরিত্রের ছেলেটি এ ছবিতে অন্যতম চরিত্র পাবার পরেও সুবিচার করতে পারেনি অভিনয়ে। কিছুটা মন্থর তার অভিনয়।

ছবির গানের মধ্যে ‘নিঃস্ব হইয়া নাও ভাসাইয়া’ বেস্ট। দোতারার আওয়াজটা বারবার শুনতে মন চায়। ‘ঘাট বাঁধা কূলে’ গানটিও টাচি। ছবির ফার্স্টহাফ স্লো লাগতে পারে। আনকোরা নতুন অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ও বিরক্ত লাগতে পারে তবে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মের বাস্তবতায় স্টারকাস্টের বাইরে দেখলে স্বাভাবিক লাগবে।

ছবির প্রথম দৃশ্যের শাপলা ফুলের সাথে শেষ দৃশ্যের শাপলা ফুলের একটা সংযোগ আছে। মনোযোগী দর্শক হলে এটা ধরতে পারবে কেন দেখানো হয়েছে।

বলা হয়-‘ক্লাইমেক্সই সাহিত্যের প্রাণ।’ শিল্পের কথা চিন্তা করলে চলচ্চিত্রেও সাহিত্যগুণ থাকে। সেদিক থেকে ক্লাইমেক্স গুরুত্বপূর্ণ। এ ছবিটি ক্লাইমেক্সের কারণে কিছুটা হলেও মার্ক বেশি পাবে। চিন্তাভাবনায় পিছিয়ে থাকা মানুষ কিভাবে নিজেকে পরিবর্তন করছে এবং তার প্রকাশ কতটা চমৎকার হতে পারে ক্লাইমেক্সে পরিচালক দেখিয়েছেন।

ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মের বাস্তব যুদ্ধে পরিচালক অন্ত আজাদের আন্দোলনের ফসল ‘আহত ফুলের গল্প’ ছবি। তাঁর মতো আরো যারা ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার আছে তাঁদের সবারই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নিজেদের যুদ্ধ বা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত। এতে করে মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক ছবির হর্তাকর্তারা তাঁদের প্রতি যে অবিচার করছে তার একটা জবাব হয়ে যাবে। এভাবে হয়তো একদিন ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মও বাংলাদেশে নতুন বিপ্লব আনবে।

রেটিং – ৬.৫/১০


মন্তব্য করুন