Select Page

২০২১ সালে ওয়েব-বড়পর্দা মিলিয়ে সেরা দশ চলচ্চিত্র

২০২১ সালে ওয়েব-বড়পর্দা মিলিয়ে সেরা দশ চলচ্চিত্র

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আগের কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর খুবই কম চলচ্চিত্র সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। সে তুলনায় দেশি-বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বছরজুড়েই বেশকিছু সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে।

২০২০ সালে এতই কম চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল, সেবার সেরা চলচ্চিত্রের তালিকা বানানোর আগ্রহ জন্মায়নি। সে তুলনায় ২০২১ সালে পরিমাণ কিছুটা বেশি। যেসব চলচ্চিত্র সেন্সর ছাড়পত্র পায়নি, সেগুলোও দর্শকের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, নানামুখী ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সহায়তায়। এরকম সুযোগ-সুবিধা আগে দর্শকেরা তেমন পেতো না।

এ বছর হাতেগোনা কয়েকটা বাদে প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্র আমি দেখেছি, নিয়মিত রিভিউ করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ১১টি চলচ্চিত্রকে এই তালিকা রাখছি; ১০টি সেরা ও ১টি বিশেষ—

বিশেষ: নীল মুকুট

‘শুনতে কি পাও!’-খ্যাত কামার আহমেদ সাইমন পরিচালিত তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকু-চলচ্চিত্র ছিল এটি। ২০২০ সালের মার্চে হলে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও করোনার প্রথম ঢেউয়ের কারণে সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ৮ আগস্ট ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে শুধু দেশের দর্শকদের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়।

এই চলচ্চিত্রে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়া একদল নারী পুলিশের দৈনন্দিন জীবনতুলে ধরা হয়েছে। ডকু-ফিকশন ঘরানার ‘নীল মুকুট’ ফোরকে রেজুলেশনের ক্যামেরা দিয়ে শুট করা হয়েছে। এখানে কোনো স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করা হয়নি, ছিল না কোনো প্রফেশনাল অভিনয়শিল্পী। অর্থাৎ, যা শুনতে ও দেখতে পাওয়া গেছে, ডকু-ফিকশনের ধরন অনুযায়ী সবই বাস্তব।

এবার আসা যাক মূল তালিকায়…

১০. নেটওয়ার্কের বাইরে

‘বড় ছেলে’, ‘বুকের বাঁ পাশে’-খ্যাত মিজানুর রহমান আরিয়ান নাটক নির্মাণে জনপ্রিয় হলেও প্রথমবার ওয়েবফিল্ম বানিয়ে যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন! সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, চারজন বন্ধু ঠিক করে কক্সবাজার হয়ে সেন্টমার্টিন ট্যুর দেবে। তা নিয়ে হাসি-কান্নার গল্প।

কামিং-অফ-এজ অ্যাডভেঞ্চার ঘরানার এই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ, নাজিফা তুষি, ইয়াশ রোহান, তাসনুভা তিশা, খায়রুল বাসার, নাজিয়া হক অর্ষা, জুনায়েদ বোগদাদী, তাসনিয়া ফারিণসহ অনেকে। চলচ্চিত্রের গানগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ‘চরকি’তে।

৯. মিশন এক্সট্রিম

বছরের সবচয়ে বড় বাজেটের চলচ্চিত্র। মূল চরিত্রে আরিফিন শুভ, শুধু এই একটি নির্দিষ্ট চরিত্র রূপদানের জন্য নিজেকে আমুল বদলে ফেলেছেন। বানিয়েছেন সিক্স প্যাক অ্যাবস। পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলার ঘরানার চলচ্চিত্রটির মেকিং বিশ্বমানের। এ ছাড়া জঙ্গিবাদের মতো ইউনিভার্সেল গল্প বাছাই করায় সব ধরনের দর্শকের কাছে বোধগম্য।

সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ পরিচালিত প্রথম ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী, সাদিয়া নাবিলা, সুমিত সেনগুপ্ত, তাসকিন রহমান, ফজলুর রহমান বাবু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, মনোজ প্রামাণিক, সৈয়দ নাজমুস সাকিব, মাজনুন মিজানসহ অনেকে। ৩ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে এখনো দেশ-বিদেশের কিছু হলে চলছে।

৮. রাত জাগা ফুল

২০২১ সালের অন্যতম প্রাপ্তি মীর সাব্বিরের মতো ভার্সেটাইল অভিনেতার পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক। একাধারে গল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তারা, পরিচালনা করেছেন, গান লিখেছেন, অভিনয়ও করেছেন। বিশেষ করে ‘রইস’ চরিত্রে তার অভিনয় এবং তার লেখা গান আমার খুবই ভালো লেগেছে।

গ্রাম্য রাজনীতিনির্ভর গল্পে প্রাণিসম্পদ ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে খুব সুন্দরভাবে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যা বোধকরি সব ধরনের দর্শকের কাছে ভালোভাবে গ্রহনযোগ্যতা পাবে। ২০১৯-২০ সালে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটির শুট করা হয়েছে বরগুনাতে। মনিরুল ইসলাম মাসুমের ডিওপি ও ইমন চৌধুরীর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ অতুলনীয়। আরও অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী, আবু হুরায়রা তানভীর, তানিন তানহা, জয়রাজ, আবুল হায়াতসহ অনেকে। বছরের শেষ শুক্রবার মুক্তি পেয়ে চলচ্চিত্রটি বেশকিছু হলে চলছে।

৭. নোনা জলের কাব্য

পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবনযুদ্ধ তুলে ধরা হয়েছে চলচ্চিত্রে। এ সারভাইভাল ড্রামা কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া বিশ্বের নামি-দামি সব ফেস্টিভ্যাল ঘুরে এসে ২৬ নভেম্বর দেশে মুক্তি পায়।

সরকারি অনুদান ও বিদেশি তহবিলে নবীন পরিচালক রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া, ফজলুর রহমান বাবু, তাসনুভা তামান্না, অশোক বেপারীসহ অনেকে।

খুবই সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি ও সাউন্ড ডিজাইনের কাজ পাওয়া গেছে, যার চোখ ও কানের প্রশান্তি এনে দেয়। পরিচালক জানিয়েছে, যে গ্রামে তারা শুট করেছিলেন, এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সেই গ্রাম এখন পানির পেটে।

৬. খাঁচার ভেতর অচিন পাখি

এই বছরে আমার দেখা সেরা টুইস্টনির্ভর কাজ। প্রধান টুইস্টটি বলতে গেলে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, গল্প নিয়ে শুরুতে যেমন চিন্তাভাবনা ছিল তাও বদলে দেয়। পরে ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝতে পেরেছি, দুই চিত্রনাট্যকার রায়হান রাফী ও নাজিম উদ দৌলা শুরু থেকেই আমাদের একের পর এক হিন্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন, অনেকেই হয়তো সেটা তৎক্ষনাৎ ধরতে পারবে না। সারভাইভাল থ্রিলার চলচ্চিত্রের স্ক্রিণপ্লে তো এমনই হওয়া উচিত!

চাকরির উদ্দেশ্যে আসা এক বিবাহিত নারী আচমকা একটি বন্ধ ফ্যাক্টরিতে আটকে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি আবিষ্কার করেন, এক বয়স্ক ব্যক্তি ৩-৪ বছর ধরে সেখানে আটকা পড়ে রয়েছেন। মূল চরিত্রে অভিনয় করা তমা মির্জা ও ফজলুর রহমান বাবুর অসাধারণ পারফরম্যান্স দীর্ঘদিন মনে থাকবে। চলচ্চিত্রের থ্রিলিং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। এটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ‘চরকি’তে।

এবার আসা যাক সেরা ৫ এ…

৫. চন্দ্রাবতী কথা

ষোড়শ শতকে জন্ম নেওয়া বাংলার প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী অবলম্বনে ২০১৪-১৫ সালে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। গল্প বলা হয়েছে পটের চিত্র ও পালাগানের ব্যবহারের মাধ্যমে, যা খুবই ইউনিক। এ ছাড়া বিশ্বাসযোগ্যভাবে ষোড়শ শতকের আবহ ও সে সময়কার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এন রাশেদ চৌধুরীর পরিচালনায় অভিনয় করেছেন দিলরুবা দোয়েল, ইমতিয়াজ বর্ষণ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, কাজী নওশাবা আহমেদ, গাজী রাকায়েতসহ অনেকে। বায়োগ্রাফি জনরায় আমাদের সেরকম উল্লেখ করার মতো কাজ কম, এটি সে বিবেচনায় দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো কাজ।

৪. কষ্টনীড়

পারিবারিক গল্পের আদলে এই ওয়েবফিল্মে গোটা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ রকম মেটাফোরিক ট্রিটমেন্ট আমরা ক্লাসিক ‘জীবন থেকে নেয়া’তে দেখতে পেয়েছিলাম। নির্মাতা আশফাক নিপুণ প্রমাণ করেছেন, এই ধরনের মেটাফোরিক ট্রিটমেন্ট এ সময়ে এসেও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। নির্মাণ ও অভিনয় এই চলচ্চিত্রের অনেক বড় শক্তির জায়গা।

ফ্যামিলি ড্রামা ঘরানার এই ওয়েবফিল্মের অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, সাবেরী আলম, রুনা খান, সাইদ বাবু, শ্যামল মাওলা, সাবিলা নূর, ইয়াশ রোহানসহ অনেকে। দেখা যাচ্ছে হইচই-এ।

৩. জানোয়ার

২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে দেশে সংগঠিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অবলম্বনে রায়হান রাফী নির্মাণ করেছেন এ ওয়েবফিল্ম। অভিনয় করেছেন তাসকিন রহমান, রাশেদ মামুন অপু, ফরহাদ লিমন, জাহাঙ্গীর আলম, এলিনা শাম্মীসহ অনেকে।

প্রচুর পরিমাণে ভায়োলেন্স ও ব্রুটালিটি দেখানো হয়েছে। তাই যারা দূর্বল হৃদয়ের তাদের চলচ্চিত্রটি না দেখাই ভালো। তবে ওয়েবফিল্মটি মুক্তির পর ইতিবাচক সাড়া পায়। বিশেষ করে নেগেটিভ চরিত্র রূপদান করা রাশেদ মামুন অপু ও তার সঙ্গীরা খুবই ভালো পারফরম্যান্স করেন। ক্রাইম সাইকোলজি ঘরানার চলচ্চিত্রটি দেখা যাবে সিনেম্যাটিকে।

২. লাল মোরগের ঝুঁটি

বহুদিন বাদে এমন একটি মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্র পাওয়া গেল, যাকে অন্য ৮-১০টি একই ঘরানার চলচ্চিত্র থেকে আলাদা করা যায়। একাত্তরে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের পেছনের গল্প নিয়ে পরিচালনা করেছেন নুরুল আলম আতিক। ২০১৪-১৫ সালে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল, দিলরুবা দোয়েল, আশনা হাবিব ভাবনা, শিল্পী সরকার অপু, জয়রাজ, জ্যোতিকা জ্যোতি, আশীষ খন্দকার, দীপক সুমনসহ অনেকে।

‘কষ্টনীড়’-এর মতো এই চলচ্চিত্রেও প্রচুর মেটাফোরিক ট্রিটমেন্ট দেখতে পাওয়া গেছে। আহমেদ রুবেল, ভাবনা, জয়রাজ ও পাকিস্তানি মেজরের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতার পারফরম্যান্স নজরকাড়া! এই চলচ্চিত্রের সাউন্ড ডিজাইন অন্যতম আকর্ষণীয় দিক।

নাম্বার ওয়ান নিয়ে আলোচনা করার আগে কিছু honourable mentions দেখে নিন; আগস্ট ১৯৭৫, দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা, ট্রল, যদি কিন্তু তবুও, স্ফুলিঙ্গ, অলাতচক্র এবং মুন্সীগিরি

১. রেহানা মরিয়ম নূর

কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে un certain regard বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে চলচ্চিত্রটি দেশে টক অফ দ্য টাউনে পরিণত হয়। এর আগ অব্দি কোনো বাংলা চলচ্চিত্র বিদেশের মাটিতে এত বড় সাফল্য পায়নি।

সাইকোলজিক্যাল ড্রামা ঘরানার চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। অভিনয় ও কারিগরি দিক থেকে চলচ্চিত্রটি যা করে দেখিয়েছে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা সত্যিই অতুলনীয়। আমি অনেকের মুখেই শুনেছি, সিনেমা হলে ছবিটি দেখতে দেখতে তারা বেশ মানসিক চাপ অনুভব করেছেন। আজমেরী হক বাঁধন অভিনয়ের দিক থেকে নিজেকে অন্য লেভেলে নিয়ে গেছেন। একটি সার্থক চলচ্চিত্রের সার্থকতা তো এগুলোতেই!

এই ছিল আমার দৃষ্টিতে ২০২১-এর সেরা ১০ চলচ্চিত্র। আপনার দৃষ্টিতে সেরা চলচ্চিত্র কোনটি?


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

মন্তব্য করুন