আইএমডিবি’তে বেশি ভোট পাওয়া ১০ বাংলাদেশি ছবি
ইন্টারন্যাশনাল মুভি রেটিং ওয়েবসাইট হিসেবে “ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজ – আইএমডিবি” সারাবিশ্বব্যাপৗ বিশেষভাবে সমাদিত। এখানে দেশ-বিদেশের নানারকম মুভির রিভিউ, পর্যালোচনা ও রেটিং দেওয়া হয়। শুধু সিনেমাই নয়, এর পাশাপাশি জনপ্রিয় টেলিভিশন প্রোগ্রামের আদ্যোপান্তের খবরাখবর পাওয়া যায় এই ওয়েবসাইট থেকে। প্রতিদিন কয়েক লক্ষাধিক মুভিপ্রেমী এই সাইটটি ঘুরে আসে, পছন্দের ছবির রেটিং ও রিভিউ দেয়, মুক্তিপ্রাপ্ত ও মুক্তিপ্রতিক্ষিত নানা ছবির রিভিউ দেখে।
আমাদের দেশে অবশ্য এই চলনটি এখনো মুভিপ্রেমীদের মধ্যে পুরোদস্তুর শুরু হয়নি। আর বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে তো আরো কম। এটা খুবই অবাক করার মতো বিষয়, আমাদের দেশের কোনো সিনেমাই আইএমডিবি র নিয়মানুযায়ী ২৫ হাজারের বেশি ভোট পায়নি। তাই সিনেমার রেটিং কে গুরুত্ব না দিয়ে ভোট দেওয়ার পরিমাণের ভিক্তিতে লিস্টি টি করা। আজ আলোচনা করবো আইএমডিবির ইতিহাসে সবথেকে বেশি ভোট পড়া সেরা ১০ বাংলাদেশী সিনেমা নিয়ে।
তবে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, এই লিস্টে সেরা দশে আসা মানেই এই নয় যে, এগুলো বাংলা ছবির ইতিহাসের সেরা দশ ছবি। লিস্টটি করতে গিয়ে অনেক ভালো ভালো সিনেমা পেলাম যেগুলোতে ৫০০ ভোটও পড়েনি। আর তালিকাটা অক্টোবর ২০১৯ এর শুরুর দিকে করা।
১০. আগুনের পরশমণি (১৯৯৪): পূর্বের ছবিটির মতো এছবির গল্পও নেওয়া হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের রচিত একই নামের উপন্যাস থেকে। এছবিটির পরিচালকও তিনি, “আগুনের পরশমণি” এর মাধ্যমেই পরিচালক হিসেবে এই গুণী ব্যক্তিত্বের বড়পর্দায় অভিষেক হয়। ওয়্যার ড্রামা জনরার এছবিতে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, শিলা আহমেদ, আবুল হায়াত, ডলি জহুর, দিলারা জামানসহ আরো অনেকে। সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ৮ টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।আইএমডিবির ওয়েবসাইটে মোট ভোট দিয়েছেন ২ হাজার ৩১৯ জন।
৯. গেরিলা (২০১১): বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত এছবিটি জয়া আহসান ও শতাব্দী ওয়াদুদের নজরকাড়া পারফরমেন্সের জন্য তুমুল আলোচিত। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক এর “নিষিদ্ধ লোবান” উপন্যাস অবলম্বনে এছবিটি নির্মিত হয়েছে। জয়া, শতাব্দী ছাড়াও এছবিতে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, আহমেদ রুবেল, এটিএম শামসুজ্জামান, শম্পা রেজা, আজাদ আবুল কালাম সহ আরো অনেকে। সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্রসহ তৎকালীন সময়ে সর্বোচ্চ ১০ টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে! আইএমডিবি তে সিনেমাটিকে ভোট দিয়েছেন ২ হাজার ৩৩৯ জন।
৮. দেবী (২০১৮): মুক্তির পর মাত্র ১ বছরের ব্যবধানেই এছবি সেরা দশের লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে! আর এখানেও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জয়জয়কার। তারই লেখা উপন্যাস “দেবী” থেকে নবীন পরিচালক অনম বিশ্বাস নির্মাণ করেন সাইকো মিস্ট্রি থ্রিলার ধাঁচের এছবি। সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান; এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে আছেন চঞ্চল চৌধুরী, শবনম ফারিয়া, অনিমেষ আইচ, ইরেশ যাকের সহ আরো অনেকে। এছবির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি করা তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী কে প্রথমবার বড়পর্দায় দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমাটি মুক্তির পর তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং ব্যবসাসফল হয়। সিনেমাটি ইতোমধ্যে একাধিক শাখায় বাচসাস এ্যাওয়ার্ড ও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেছে। আইএমডিবি তে এসিনেমাকে ভোট দিয়েছেন ২৪৩১ জন।
৭. আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১): ওয়্যার ড্রামা জনরার এছবিটি অন্যসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা থেকে কিছুটা ভিন্নতর। এসিনেমার গল্পে মূলত কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধ দেখানো হয়েছে। এক কিশোর কীভাবে সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দেশীয় রাজাকারদের শায়েস্তা করেন সেই গল্প দেখানো হয়েছে। নন্দিত লেখক মোহাম্মাদ জাফর ইকবালের উপন্যাস “আমার বন্ধু রাশেদ” থেকে জনপ্রিয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম এছবিটি নির্মাণ করেন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, চৌধুরী জাওয়াতা আফনান, রাইয়ান ইবতেশাম চৌধুরী, রাফায়েত জান্নাত সহ আরো অনেকে। সিনেমাটি মোট তিনটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। আইএমডিবি তে এছবিতে ভোট দিয়েছেন ২৪৯২ জন।
৬. অজ্ঞাতনামা (২০১৬): পরিচালক তৌকীর আহমেদের আরেকটি প্রশংসিত ছবি, গল্প লিখেছেন তিনি নিজেই। সিনেমাটি নীরবে নিভৃতে মুক্তি পেয়ে গেছে, সেসময়ে ততটা আলোচিত হয়নি। পরবর্তীতে যখন ইউটিউবে সিনেমাটি অবমুক্ত করা হয়, তখন পজেটিভ রেসপন্সের বন্যা বয়ে যায়… সিনেমাটি দেখার পর সবাই আফসোস করে, আগে জানলে অবশ্যই সিনেমাটি বড়পর্দায় উপভোগ করতেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিম, নিপুণ, শতাব্দী ওয়াদুদ, আবুল হায়াত, শাহেদ শরীফ খান, শাহেদ আলী সহ আরো অনেকে। সিনেমাটি মোট তিন শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। আইএমডিবি তে এসিনেমার রেটিং ৯! ভোট দিয়েছেন ৩০৯২ জন।
এবার আসা যাক সর্বাধিক ভোট পাওয়া পাঁচ ছবির দিকে…
৫. ঢাকা অ্যাটাক (২০১৭): এই দশকের অন্যতম সাড়াজাগানো ছবি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও বোম ডিজপোজাল ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ অফিসার সানি সানোয়ার তার নিজের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এছবিটির গল্প ও চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। ছবিটি প্রযোজনাও করেছেন তিনি। মানসিকভাবে অসুস্থ এক অপরাধীর নিজের সাজানো দেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাষ্টারপ্ল্যান আটকানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় পুলিশ ও বোম ডিসপোজাল ইউনিটের একদল চৌকষ সদস্য। তারা কীভাবে দেশকে বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, এ গল্পই দেখা যায় এছবিতে। পুলিশ এ্যাকশন থ্রিলার জনরার ছবিটিতে অভিনয় কুরেছেন আরিফিন শুভ, এবিএম সুমন, তাসকিন রহমান, মাহিয়া মাহি, শতাব্দী ওয়াদুদ, কাজী নওশাবা আহমেদ সহ আরো অনেকে। ছবিটি মুক্তির পর এর খলচরিত্রে অভিনয় করা তাসকিন রহমান রাতারাতি তারকা বনে যান। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়। আইএমডিবি তে “ঢাকা অ্যাটাক” এর ভোট “অজ্ঞাতনামা” এর থেকে মাত্র একটি বেশি, ৩ হাজার ৯৩ টি।
৪. মাটির ময়না (২০০২): গত দশকের “সেরা ছবি” বললে কোনোভাবেই সেটা বাড়িয়ে বলা হবে না। বাংলাদেশী সিনেমার ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ধরার প্রথম পদক্ষেপ ছিল এটি। জনপ্রিয় মুভি রেটিং ওয়েবসাইট রোটেন টমেটোস এসিনেমাকে দিয়েছে ৮৯% ভোট! নন্দিত চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদের পরিচালনায় এছবিতে অভিনয় করেছেন নুরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম, লামিছা রিমঝিম সহ আরো অনেকে।
দুঃখের বিষয়, তখন আমাদের সিনেমায় অশ্লীলতার রমরমা পথচলা থাকা সত্ত্বেও, সেন্সর বোর্ড এসিনেমাকে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানতে পারে এমন কারণ দেখিয়ে সারাদেশে এর প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ ছবির গল্প লিখেছেন তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। সিনেমাটি মোট তিন শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ছবিটির গল্পের পরবর্তী অংশ “কাগজের ফুল” এর কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। এসিনেমার প্রি প্রডাকশনের কাজ করতে গিয়ে পরিচালক তারেক মাসুদ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। “মাটির ময়না” সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৮.৬, মোট ভোট দিয়েছে ৩ হাজার ৫২৮ জন।
৩. টেলিভিশন (২০১৩): ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইটে দেশী ছবির অবস্থান নিয়ে লিখছি, আর মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর কোনো সিনেমা নিয়ে কথা হবে না… তা কি হয়? বলা হয়ে থাকে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী সাধারণত সময়ের থেকে এ্যাডভান্স গল্প নিয়ে ছবি বানান, যার জন্যে দর্শক সিনেমার সাথে সহজে কানেক্ট করতে পারেন না। কিন্তু এসিনেমাটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এর গল্প আমাদের গ্রামেরই গল্প; এরকম কুসংস্কার, ফতোয়া আমাদের সমাজেই দেখা যায়। যার জন্যে এছবিটি দেখার পর আপামর জনসাধারণের সবাই কানেক্ট করতে পেরেছেন। সোস্যাল ড্রামা জনরার এছবিতে অভিনয় করেছেন কাজী শাহির হুদা রুমী, নুসরাত ইমরোজ তিশা, চঞ্চল চৌধুরৗ, মোশাররফ করিম সহ আরো অনেকে। আইএমডিবি তে এসিনেমার রেটিং ৮.২, ভোট দিয়েছেন ৪ হাজার ১১৯ জন।
২. মনপুরা (২০০৯): গত দুই দশকের সময়কালে মুক্তি পাওয়া একমাত্র ছবি, যেটি মাস-ক্লাস সর্বস্তরের জনগণের মন জয় করতে পেরেছে। ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবিটি একটানা ৯ মাস চলেছে, বলাকায় চলেছে একটানা ৬ মাস! মনিহারসহ ঢাকার বাইরের বড়বড় হলগুলোতে একটানা দেড়-দুই মাস সফলতার সাথে চলেছে এছবি। সিনেমাটি মুক্তির ১০০ দিন পুর্ণের পরও দেশের ৫০ টি প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল! গিয়াসউদ্দিন সেলিমের অমর সৃষ্টি, যেসিনেমার সাফল্যগাঁথা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
রোম্যান্টিক ড্রামা জনরার এছবিতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরৗ, ফারহানা মিলি, ফজলুর রহমান বাবু, মামুনুর রশীদ, মনির খান শিমুল সহ আরো অনেকে। এসিনেমার সবগুলো গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এর পরের বছরই এছবিটি কোলকাতায় রিমেক হয় “অচিন পাখী” নামে। সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৬, আর মোট ভোট দিয়েছেন ৪ হাজার ৮০৯ জন।
১. আয়নাবাজি (২০১৬): এসিনেমাকে আইএমডিবি তে যে পরিমাণে ভোট দেওয়া হয়েছে, লিস্টের ২-৬ পর্যন্ত থাকা ছবিগুলিতে দেওয়া সকল ভোট একত্র করলেও এর সমান হবে না! মোট ভোট দেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৬৬৪ বার! আইএমডিবি তে সিনেমার রেটিং ৯.২!
অমিতাভ রেজা চৌধুরীর এক অমর সৃষ্টি, পুরো ঢালিউড নড়েচড়ে বসেছিল এসিনেমা মুক্তির পর! এসিনেমার ব্যবসায়িক সফলতা খোদ সিনেমাসংশ্লিষ্টরাও মুক্তির আগে কল্পনা করেননি। ক্রাইম থ্রিলার ধাঁচের এ সিনেমায় মূল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। তাকে যোগ্য সাপোর্ট দিয়েছেন নাবিলা, পার্থ বড়ুয়া, ইফফাত তৃষা, লুৎফর রহমান জর্জ সহ আরো অনেকে। সিনেমাটি মোট ৭ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে।
সিনেমাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার ভালো একটি প্ল্যাটফর্ম হলো আইএমডিবি। এই লিস্টে জায়গা পাওয়া সবগুলো সিনেমাই মাস্টওয়াচ! না দেখে থাকলে এখনই দেখে ফেলুন, নাহলে মুভিপ্রেমী হিসেবে একসময় হয়তো আফসোসে পুড়বেন।
আপনি এই লিস্টের সব সিনেমা দেখেছেন তো?